Ajker Patrika

যে কারণে ঋষি সুনাকের শিকে ছিঁড়ল না

গোলাম ওয়াদুদ
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪: ০২
যে কারণে ঋষি সুনাকের শিকে ছিঁড়ল না

গত জুলাইয়ে একাধিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে মন্ত্রিসভার সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রিত্ব ত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এরপর শুরু হয় নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়া। কনজারভেটিভ পার্টির দলীয় প্রধান নির্বাচনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে টিকে ছিলেন দুই প্রার্থী—সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক।

কয়েক মাস প্রচারণা ও নির্বাচনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লিজ ট্রাস। গতকাল সোমবার চূড়ান্ত ভোটাভুটির ফলাফলে ঋষি সুনাককে হারিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ঋষি সুনাক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে স্পষ্টত জনপ্রিয় ছিলেন। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেছিলেন, তিনিই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেষ হাসি হাসলেন লিজ ট্রাস।

এদিকে ফলাফলের আগেই পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন ঋষি সুনাক। জনপ্রিয় এই নেতা বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, তিনি কনজারভেটিভ সরকারকে সমর্থন করার জন্য উন্মুখ। এমপি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলেও জানান। তবে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা উড়িয়ে দেননি।

কনজারভেটিভদের মধ্যে সুনাকের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কারণ কী—এমন প্রশ্ন অনেকের মধ্যে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সুনাকের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কারণ তুলে ধরছে। কারণগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি দেখানো হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুনাকের জনপ্রিয়তা কমার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ট্যাক্স লন্ডারিং, কর কমানোর সিদ্ধান্ত, গ্রিন কার্ড বিতর্ক, বিলাসবহুল জীবনযাপন ইত্যাদি। 

 স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির সঙ্গে ঋষি সুনাকফার্স্ট পোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সুনাকের নির্বাচনী প্রচারে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠেছিল তাঁর স্ত্রী এবং ভারতীয় ধনকুবের ও ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণ মূর্তির কন্যা অক্ষতা মূর্তি। সুনাকের বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রীর কোম্পানি থেকে ট্যাক্স কম নেওয়া বা না নেওয়ার অভিযোগ ছিল। দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে ঋষি সুনাককে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী এমপি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুনাকের সিংহভাগ সাফল্য অক্ষতার সঙ্গে তাঁর বিয়ের পর এসেছে। অক্ষতা ৭৯৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইনফোসিসের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক। সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়েও বেশি সম্পদশালী দাবি করা হয়েছে অক্ষতাকে। 

ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী হওয়ায় অক্ষতা তাঁর পরিবারের আইটি ব্যবসা থেকে সংগ্রহ করা লভ্যাংশের ট্যাক্সে লাখ লাখ পাউন্ড বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু গত বছর তিনি ১১ দশমিক ৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের লভ্যাংশ প্রদান করেছেন। ইস্যুটি বড় বিতর্ক সৃষ্টির পর অক্ষতা বিদেশি আয়ের ওপর আরও কর দিতে রাজি হন। তবে তত দিনে সুনাকের জনপ্রিয়তা যায় কমে। 

এদিকে লিজ ট্রাসের জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনে আরও একটি কারণ হচ্ছে, সুনাক নীতিগতভাবে কর কমানোর বিরুদ্ধে ছিলেন। ট্রাস বিশ্বাস করেন, ট্যাক্স কমানোর ফলে অতিরিক্ত ব্যয় কমবে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে। 

যদিও ট্রাসের তাৎক্ষণিক কর কমানোর জনবহুল পদক্ষেপ অর্থনীতিবিদদের অনুমোদন পায়নি। এটি নিশ্চিতভাবে রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বহুগুণে বাড়িয়েছে। 

ঠিক এই পর্যায়ে এসেই ট্রাস নির্বাচনী দৌড়ে সুনাক থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেন। ব্যবধান আরও বাড়ছে বুঝতে পেরে সুনাক ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ক্ষমতায় গেলে ২০২৯ সালের মধ্যে আয়করের মূল হার ২০ শতাংশ কমিয়ে দেবেন তিনি। 

সুনাক জানিয়েছিলেন, তাঁর তাৎক্ষণিক লক্ষ্য মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করা। যখন তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন বলেছিলেন, একবার মুদ্রাস্ফীতি কাটানো গেলে তাঁর সরকার ২০২৪ সালে আয়কর থেকে এক পেন্স কমিয়ে দেবে। এর পরে আরও তিন পেন্স আয়কর থেকে বাদ দেওয়া হবে ২০২৯ সালে। 

এ ছাড়া ঋষি সুনাক গ্রিন কার্ড বিতর্কেও জড়ান। অক্ষতা মূর্তির ট্যাক্স লন্ডারিং বিতর্কটি শেষ হতে না হতেই শুরু হয় গ্রিন কার্ড বিতর্ক। জানা যায়, যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার পরেও তাঁরা মার্কিন গ্রিন কার্ড রেখেছিলেন। কনজারভেটিভ পার্টির শীর্ষ সদস্যরা যুক্তরাজ্যের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ কঠিন করে দেন। 

একজন জ্যেষ্ঠ টোরি নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য অবজারভারকে বলেছিলেন, ‘তিনি (সুনাক) নির্লজ্জতা দেখিয়েছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েও এমনভাবে সব সাজিয়েছেন, তা থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ক্যারিয়ারের বিকল্প পথ খোলা রেখেছেন তিনি।’ 

জনসাধারণ ও সংবাদমাধ্যমের চাপে পড়েই পরে সুনাক নিশ্চিত করেন যে তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড ত্যাগ করেছেন। তবে তত দিনে দেরি যা হওয়ার হয়ে গেছে।  

ঋষি সুনাকের পরিহিত প্রায় ৬০০ ডলার মূল্যের জুতাসাবেক এই অর্থমন্ত্রীর ওপর ছিল বিলাসবহুল জীবনযাপনের অভিযোগও। গত জুলাই মাসে সুনাক উত্তর ইংল্যান্ডে একটি নির্মীয়মাণ অবকাঠামো পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে তাঁকে প্রায় ৬০০ ডলার মূল্যের একটি জুতা পরা অবস্থায় দেখা যায়। আর তাতেই ফের ব্রিটিশ মিডিয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।  

কনজারভেটিভ পার্টির নেতা মেয়র বেন হাউচেনের সমর্থন সংগ্রহ করতেই সেখানে গিয়েছিলেন ঋষি। তবে সবার নজর গিয়ে পড়ে সুনাকের ‘বিলাসী’ লোফারের ওপর। এটা প্রথমবার নয় যে সুনাক তাঁর ব্যয়বহুল জীবনযাপনের জন্য আলোচনায় এসেছেন। এর আগে ২০২০ সালে দেশের চ্যান্সেলর হিসেবে প্রাক-বাজেট ফটোগ্রাফে ২২০ ডলারের মগ ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। যুক্তরাজ্যের জনগণ যখন জীবনযাত্রার ব্যয় চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সুনাক উত্তর ইয়র্কশায়ারে ৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার খরচ করে একটি পুলও নির্মাণ করেছেন বলে খবরে বেরিয়েছে। 

এ ছাড়া নির্বাচনের প্রচারণার সময় একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে সুনাককে তাঁর ‘অভিজাত’ বন্ধুদের সম্পর্কে কথা বলতে দেখা যায়।

বিবিসি নির্মিত ‘মিডল ক্লাস-দেয়ার রাইজ অ্যান্ড স্প্রোলে’ ডকুমেন্টারিতে সুনাক বলেন, ‘আমার অভিজাত বন্ধু যেমন আছে, তেমনি উচ্চবিত্ত বন্ধুও আছে। আবার শ্রমিক শ্রেণির বন্ধুও আছে। আপনারা এসব জানেন। আচ্ছা ঠিক আছে, শ্রমিক শ্রেণি নয় তারা।’ এই ভিডিওটি নিয়েও নানা আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা গেছে। 

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে দৃশ্যত জনপ্রিয় থাকা সাবেক ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এসব বিতর্কেই অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে ছিটকে গেছেন বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। আর এসব বিতর্কের ফায়দা তুলেই ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হয়ে গেলেন লিজ ট্রাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ইরানি নারী এখন পানামার জঙ্গলে

ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষে নামা ‘তৌহিদী জনতার’ আড়ালে এরা কারা

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

এনসিপিকে চাঁদা দিচ্ছেন ধনীরা, ক্রাউডফান্ডিং করেও অর্থ সংগ্রহ করা হবে: নাহিদ ইসলাম

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত