আরিফ আবেদ আদিত্য
বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে টেমসের তীরে আসার প্রায় এক বছর হয়ে এল। গত বছর অক্টোবরে সূর্যালোক উদ্ভাসিত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক দেশ ছেড়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে হাড়কাঁপানো ধূসর ভূমিতে পদার্পণ করি। আমার আগমনের সময়টায় বিলাতে শীত আসি-আসি করছে—জাঁকিয়ে বসেনি। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আগেই বলেছিলেন, ইউরোপের শীত কোনো ছেলেখেলা নয়। গরমের দেশ থেকে গিয়ে শীত নিয়ে সামান্য হেলাফেলা করলেই সর্দি-কাশি আর জ্বরে জীবন জেরবার করে দেবে। কনকনে মাঘের ঠান্ডার চেয়েও অধিক হাড়কাঁপানো শুধু নয়, হাড় ফুটা করা শীত এখানে বিরাজ করে। কয়েক পরতের গরম কাপড়েও এই কনকনে ঠান্ডা নিবারণ সম্ভব হয় না। লন্ডনে যেদিন আসি, এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা একটা হালকা ঝাপটা এসে লাগে নাকে-মুখে। আগেভাগে প্রস্তুতির কয়েক প্রস্থ কাপড়ে অবগুণ্ঠিত শরীর টের না পেলেও ঠান্ডার দাপটের ঈষৎ বিজ্ঞাপন নাকের ডগা ছুঁয়ে ঝাঁজের আঁচ দিয়েছিল বৈকি!
আমার ইংল্যান্ডে আসার কারণ, দ্বিতীয় মাস্টার্স করা—একটা ডিগ্রি অর্জনের চেয়ে ইংরেজি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কিছুটা ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন-পর্যবেক্ষণ করা। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে—প্রায় দুই শ বছর যারা শাসন করল, যাদের সাংস্কৃতিক প্রভাববলয় কলোনিয়াল দেশগুলোতে এখনো বিরাজমান, তাদের যাপিত জীবনপদ্ধতি ও সমাজকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহই আমাকে এখানে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নামি রাত ১০টার দিকে। ইমিগ্রেশন, লাগেজ বেল্ট থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে বের হতে হতে সাড়ে ১১টা। বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বন্ধু ও সহকর্মী কিংস কলেজে পিএইচডি ফেলো জগদীশ। হিথরো ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন, ফ্লাইট সরাসরি বিমান বাংলাদেশের হওয়ায় লাইনে সবাই বাংলাদেশি নাগরিকই ছিলেন। নানা পেশার বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে। ইমিগ্রেশনের কাউন্টার অনেক; মাথার ওপরে বড় করে সাইনবোর্ডে স্থানে স্থানে লেখা ‘ইউকে বর্ডার’। লাইনে দাঁড়িয়ে লেখাটায় চোখ পড়তেই মনে হলো নতুন কোনো দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে উড়াল দেওয়ার আগ পর্যন্ত এমন মনে হয়নি।
লন্ডনে ইমিগ্রেশন অফিসাররা ভিসা-পাসপোর্ট চেক করার সময় যাত্রীদের অনেক ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। এতে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে বেশ সময় লেগে যায়। ইমিগ্রেশনের জেরায় আমার মতো পড়তে আসা শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রথমবার যারা ব্রিটেনে এসেছে, সবাইকেই দেখলাম কমবেশি উদ্বিগ্ন হতে। এর পেছনে কারণও আছে বৈকি! কারও প্রশ্নের উত্তর মনঃপূত না হলে তাকে আলাদা করে অন্য একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কালো উর্দির ওপর পুলিশ লেখা ব্যক্তিরা যখন কাউকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়, তখন পেছনে লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউএসএ, ইউকের ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ি নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই আসলে। তবে আমার কাছে যত দূর মনে হয়েছে, ভাষা সমস্যাই ইমিগ্রেশনে ভোগান্তির অন্যতম কারণ। অনেককে দেখলাম দোভাষীর আশ্রয় নিতে। লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই কেউ দোভাষী হিসেবে সাহায্য করবে কি না, জিজ্ঞেস করা হয়। ইমিগ্রেশন অফিসারদের নিজস্ব ব্রিটিশ উচ্চারণে বলা প্রশ্ন অনেকের পক্ষেই বোঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বুঝে বা না বুঝে ‘ইয়েস’, ‘নো’-এর মতো উত্তর দিয়ে কোনোমতে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার চিন্তা করতে গিয়েই অনেকে ঝামেলা বাড়ায়। এরা সঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত পাসপোর্টে ছাড়পত্রের সিল দেবেই না। আমার সামনে তখন ৮-১০ জন। এমন সময় জিজ্ঞেস করা হয়, কেউ দোভাষী হবে কি না। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা হওয়ার জোগাড়। যারা দোভাষী হিসেবে সাহায্য করেছে, দেখলাম, তারা তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেছে। তাই আমিও এবার সুযোগটা নিই। একজনকে সাহায্য করলাম। তাকে ইউকেতে কে থাকে, কোথায় থাকবে, কী জন্য এসেছে ইত্যাদি কয়েকটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেয়। এবার আমার পালা। ব্রিটিশদের একটা খুব ভালো দিক আছে। কাউকে সামান্য সাহায্য করলে, ফুটপাতে হাঁটার সময় একটু রাস্তা ছেড়ে দিলে, কোনো লাইনে আগে যেতে দিলে ধন্যবাদ দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আগের যাত্রীকে সাহায্য করেছি—এ জন্যই হয়তো ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বসা প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব স্থূলকায় শ্বেতাঙ্গ অফিসার আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে কেবল একটা প্রশ্নই করেন, ‘কোন বিষয়ে পড়তে এসেছ?’ উত্তর দেওয়ার আগেই সিল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিতে দিতে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে তিনি বলেন, ‘ওয়েলকাম টু ইউনাইটেড কিংডম মাই বয়।’ অপ্রত্যাশিত এমন উষ্ণ অভ্যর্থনায় দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি নিমেষে উবে গেল।
ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজসহ গেট পেরোতেই বন্ধু জগদীশের দেখা পাই। বেচারা তিন-চার ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছে। লন্ডনের বিখ্যাত টিউবে চড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। টিউব অনেকটা মেট্রোরেলের মতো—পার্থক্য হলো টিউব মাটির নিচ দিয়ে চলে। হিথরো থেকে বন্ধুর বাসা পূর্ব লন্ডনের ফরেস্ট গেটে আসতে আসতে রাত ১২টা পার হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, টিউবে সেই মধ্যরাতেও দেখলাম মেয়েরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছে। কোথাও কোনো ভয়-শঙ্কার লেশমাত্র নেই। এ ছাড়া লন্ডনে নেমেই একবারের দর্শনে যে বিষয়টা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, তা হলো টিউবের কামরায় দেখা জাতিগত বৈচিত্র্যের সমাহার। ধরা যাক, একেকটা কামরায় ১০ জন যাত্রী—তাদের আটজনই দেখা যাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রতিনিধিত্ব করছে। কী চুলের বাহার, কী বেশভূষা, গাত্রবর্ণ বা ভাষা ইত্যাদি সব মিলিয়ে মনে হবে একটি আন্তর্জাতিক কামরায় বসে আছি। লন্ডনে এই বিষয় বেশ উপভোগ্য লেগেছে—এই শহরে নিজেকে সংখ্যালঘু বা আগন্তুক মনে হয় না; ফলে হীনম্মন্যতা আসে না; যেমনটা ইংল্যান্ডের অন্য শহরগুলোতে কিছুটা অনুভব হয়। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বা এশীয়দের সমান পদচারণে মুখর এখানকার পাবলিক পরিবহন। চলার পথে কেউ বই পড়ছে, কেউ মোবাইলে গেমস খেলছে, কেউ হেডফোনে গান শুনছে—যে যার জগতে আত্মমগ্ন, কর্মক্লান্ত কেউবা বাসায় ফেরার আগে একটু ঝিম মেরে ঘুমিয়ে নিচ্ছে—গন্তব্যস্থলে পৌঁছামাত্র টুপ করে নেমে পড়ছে। আবার কোনো স্টেশন থেকে এক জোড়া কপোত-কপোতী উঠে সিট না পেয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করে নিচ্ছে। কারও প্রতি কারও কোনো বিকার-অনুযোগ নেই।
মূল সড়ক থেকে পাতাল স্টেশনে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য স্ট্র্যাটফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল রেলস্টেশন। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা উবার নিয়ে বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা। হিথরো থেকে ফরেস্টগেট যেতে কয়েকবার টিউব পরিবর্তন করতে হয়। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ, সরাসরি ট্যাক্সিতে গেলে অনেক ভাড়া। এখানকার টিউব স্টেশন মাটির গভীরে অবস্থিত। টিউবে চড়ার জন্য বেশ কয়েকটা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। আমাদের দেশের শপিং মলের এস্কেলেটরের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ দৈর্ঘ্যের হবে এসব চলন্ত সিঁড়ি। লন্ডনের পাতাল রেললাইন-টিউব ব্যবস্থা এক এলাহি কারবার। এগুলো দেখলে যে কারও মনে হবে মাটির নিচে আরেক লন্ডন শহর অবস্থিত। আক্ষরিক অর্থেই, মাটির ওপরে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে বা ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে মাটির নিচে টিউব-ট্রেন চলার কম্পন অনুভূত হয়। যদিও এগুলো মাটির নিচে প্রায় ২০-৩০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান গভীরে অবস্থিত। দিন নেই, রাত নেই—মাটির ওপরে ও নিচে বিরামহীনভাবে চলে লন্ডনের পাবলিক পরিবহন।
রাতে বন্ধুর বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করে পরদিন রওনা দিই নিজ গন্তব্য শহর—ক্যান্টাবরিতে। ক্যান্টাবরি সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম। ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসারের ‘ক্যান্টাবরি টেলস’-এর সেই ক্যান্টাবরি শহরে কাটে আমার ১১ মাস। এই শহরের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস।
ক্যান্টাবরিকে বলা হয় ‘লন্ডন বিফোর লন্ডন’। রাজধানী লন্ডন গড়ে ওঠার আগে ইংল্যান্ডের লন্ডন ছিল এই শহর। এই গল্প হবে পরের পর্বে।
(চলবে)
বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে টেমসের তীরে আসার প্রায় এক বছর হয়ে এল। গত বছর অক্টোবরে সূর্যালোক উদ্ভাসিত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক দেশ ছেড়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে হাড়কাঁপানো ধূসর ভূমিতে পদার্পণ করি। আমার আগমনের সময়টায় বিলাতে শীত আসি-আসি করছে—জাঁকিয়ে বসেনি। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আগেই বলেছিলেন, ইউরোপের শীত কোনো ছেলেখেলা নয়। গরমের দেশ থেকে গিয়ে শীত নিয়ে সামান্য হেলাফেলা করলেই সর্দি-কাশি আর জ্বরে জীবন জেরবার করে দেবে। কনকনে মাঘের ঠান্ডার চেয়েও অধিক হাড়কাঁপানো শুধু নয়, হাড় ফুটা করা শীত এখানে বিরাজ করে। কয়েক পরতের গরম কাপড়েও এই কনকনে ঠান্ডা নিবারণ সম্ভব হয় না। লন্ডনে যেদিন আসি, এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা একটা হালকা ঝাপটা এসে লাগে নাকে-মুখে। আগেভাগে প্রস্তুতির কয়েক প্রস্থ কাপড়ে অবগুণ্ঠিত শরীর টের না পেলেও ঠান্ডার দাপটের ঈষৎ বিজ্ঞাপন নাকের ডগা ছুঁয়ে ঝাঁজের আঁচ দিয়েছিল বৈকি!
আমার ইংল্যান্ডে আসার কারণ, দ্বিতীয় মাস্টার্স করা—একটা ডিগ্রি অর্জনের চেয়ে ইংরেজি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কিছুটা ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন-পর্যবেক্ষণ করা। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে—প্রায় দুই শ বছর যারা শাসন করল, যাদের সাংস্কৃতিক প্রভাববলয় কলোনিয়াল দেশগুলোতে এখনো বিরাজমান, তাদের যাপিত জীবনপদ্ধতি ও সমাজকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহই আমাকে এখানে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নামি রাত ১০টার দিকে। ইমিগ্রেশন, লাগেজ বেল্ট থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে বের হতে হতে সাড়ে ১১টা। বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বন্ধু ও সহকর্মী কিংস কলেজে পিএইচডি ফেলো জগদীশ। হিথরো ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন, ফ্লাইট সরাসরি বিমান বাংলাদেশের হওয়ায় লাইনে সবাই বাংলাদেশি নাগরিকই ছিলেন। নানা পেশার বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে। ইমিগ্রেশনের কাউন্টার অনেক; মাথার ওপরে বড় করে সাইনবোর্ডে স্থানে স্থানে লেখা ‘ইউকে বর্ডার’। লাইনে দাঁড়িয়ে লেখাটায় চোখ পড়তেই মনে হলো নতুন কোনো দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে উড়াল দেওয়ার আগ পর্যন্ত এমন মনে হয়নি।
লন্ডনে ইমিগ্রেশন অফিসাররা ভিসা-পাসপোর্ট চেক করার সময় যাত্রীদের অনেক ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। এতে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে বেশ সময় লেগে যায়। ইমিগ্রেশনের জেরায় আমার মতো পড়তে আসা শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রথমবার যারা ব্রিটেনে এসেছে, সবাইকেই দেখলাম কমবেশি উদ্বিগ্ন হতে। এর পেছনে কারণও আছে বৈকি! কারও প্রশ্নের উত্তর মনঃপূত না হলে তাকে আলাদা করে অন্য একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কালো উর্দির ওপর পুলিশ লেখা ব্যক্তিরা যখন কাউকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়, তখন পেছনে লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউএসএ, ইউকের ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ি নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই আসলে। তবে আমার কাছে যত দূর মনে হয়েছে, ভাষা সমস্যাই ইমিগ্রেশনে ভোগান্তির অন্যতম কারণ। অনেককে দেখলাম দোভাষীর আশ্রয় নিতে। লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই কেউ দোভাষী হিসেবে সাহায্য করবে কি না, জিজ্ঞেস করা হয়। ইমিগ্রেশন অফিসারদের নিজস্ব ব্রিটিশ উচ্চারণে বলা প্রশ্ন অনেকের পক্ষেই বোঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বুঝে বা না বুঝে ‘ইয়েস’, ‘নো’-এর মতো উত্তর দিয়ে কোনোমতে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার চিন্তা করতে গিয়েই অনেকে ঝামেলা বাড়ায়। এরা সঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত পাসপোর্টে ছাড়পত্রের সিল দেবেই না। আমার সামনে তখন ৮-১০ জন। এমন সময় জিজ্ঞেস করা হয়, কেউ দোভাষী হবে কি না। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা হওয়ার জোগাড়। যারা দোভাষী হিসেবে সাহায্য করেছে, দেখলাম, তারা তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেছে। তাই আমিও এবার সুযোগটা নিই। একজনকে সাহায্য করলাম। তাকে ইউকেতে কে থাকে, কোথায় থাকবে, কী জন্য এসেছে ইত্যাদি কয়েকটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেয়। এবার আমার পালা। ব্রিটিশদের একটা খুব ভালো দিক আছে। কাউকে সামান্য সাহায্য করলে, ফুটপাতে হাঁটার সময় একটু রাস্তা ছেড়ে দিলে, কোনো লাইনে আগে যেতে দিলে ধন্যবাদ দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আগের যাত্রীকে সাহায্য করেছি—এ জন্যই হয়তো ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বসা প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব স্থূলকায় শ্বেতাঙ্গ অফিসার আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে কেবল একটা প্রশ্নই করেন, ‘কোন বিষয়ে পড়তে এসেছ?’ উত্তর দেওয়ার আগেই সিল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিতে দিতে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে তিনি বলেন, ‘ওয়েলকাম টু ইউনাইটেড কিংডম মাই বয়।’ অপ্রত্যাশিত এমন উষ্ণ অভ্যর্থনায় দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি নিমেষে উবে গেল।
ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজসহ গেট পেরোতেই বন্ধু জগদীশের দেখা পাই। বেচারা তিন-চার ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছে। লন্ডনের বিখ্যাত টিউবে চড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। টিউব অনেকটা মেট্রোরেলের মতো—পার্থক্য হলো টিউব মাটির নিচ দিয়ে চলে। হিথরো থেকে বন্ধুর বাসা পূর্ব লন্ডনের ফরেস্ট গেটে আসতে আসতে রাত ১২টা পার হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, টিউবে সেই মধ্যরাতেও দেখলাম মেয়েরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছে। কোথাও কোনো ভয়-শঙ্কার লেশমাত্র নেই। এ ছাড়া লন্ডনে নেমেই একবারের দর্শনে যে বিষয়টা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, তা হলো টিউবের কামরায় দেখা জাতিগত বৈচিত্র্যের সমাহার। ধরা যাক, একেকটা কামরায় ১০ জন যাত্রী—তাদের আটজনই দেখা যাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রতিনিধিত্ব করছে। কী চুলের বাহার, কী বেশভূষা, গাত্রবর্ণ বা ভাষা ইত্যাদি সব মিলিয়ে মনে হবে একটি আন্তর্জাতিক কামরায় বসে আছি। লন্ডনে এই বিষয় বেশ উপভোগ্য লেগেছে—এই শহরে নিজেকে সংখ্যালঘু বা আগন্তুক মনে হয় না; ফলে হীনম্মন্যতা আসে না; যেমনটা ইংল্যান্ডের অন্য শহরগুলোতে কিছুটা অনুভব হয়। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বা এশীয়দের সমান পদচারণে মুখর এখানকার পাবলিক পরিবহন। চলার পথে কেউ বই পড়ছে, কেউ মোবাইলে গেমস খেলছে, কেউ হেডফোনে গান শুনছে—যে যার জগতে আত্মমগ্ন, কর্মক্লান্ত কেউবা বাসায় ফেরার আগে একটু ঝিম মেরে ঘুমিয়ে নিচ্ছে—গন্তব্যস্থলে পৌঁছামাত্র টুপ করে নেমে পড়ছে। আবার কোনো স্টেশন থেকে এক জোড়া কপোত-কপোতী উঠে সিট না পেয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করে নিচ্ছে। কারও প্রতি কারও কোনো বিকার-অনুযোগ নেই।
মূল সড়ক থেকে পাতাল স্টেশনে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য স্ট্র্যাটফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল রেলস্টেশন। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা উবার নিয়ে বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা। হিথরো থেকে ফরেস্টগেট যেতে কয়েকবার টিউব পরিবর্তন করতে হয়। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ, সরাসরি ট্যাক্সিতে গেলে অনেক ভাড়া। এখানকার টিউব স্টেশন মাটির গভীরে অবস্থিত। টিউবে চড়ার জন্য বেশ কয়েকটা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। আমাদের দেশের শপিং মলের এস্কেলেটরের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ দৈর্ঘ্যের হবে এসব চলন্ত সিঁড়ি। লন্ডনের পাতাল রেললাইন-টিউব ব্যবস্থা এক এলাহি কারবার। এগুলো দেখলে যে কারও মনে হবে মাটির নিচে আরেক লন্ডন শহর অবস্থিত। আক্ষরিক অর্থেই, মাটির ওপরে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে বা ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে মাটির নিচে টিউব-ট্রেন চলার কম্পন অনুভূত হয়। যদিও এগুলো মাটির নিচে প্রায় ২০-৩০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান গভীরে অবস্থিত। দিন নেই, রাত নেই—মাটির ওপরে ও নিচে বিরামহীনভাবে চলে লন্ডনের পাবলিক পরিবহন।
রাতে বন্ধুর বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করে পরদিন রওনা দিই নিজ গন্তব্য শহর—ক্যান্টাবরিতে। ক্যান্টাবরি সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম। ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসারের ‘ক্যান্টাবরি টেলস’-এর সেই ক্যান্টাবরি শহরে কাটে আমার ১১ মাস। এই শহরের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস।
ক্যান্টাবরিকে বলা হয় ‘লন্ডন বিফোর লন্ডন’। রাজধানী লন্ডন গড়ে ওঠার আগে ইংল্যান্ডের লন্ডন ছিল এই শহর। এই গল্প হবে পরের পর্বে।
(চলবে)
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে