সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
শিলিগুড়িতে শ্যামলীর কাউন্টারে নামতে নামতে সেখানকার সময় বেলা দুটো কি আড়াইটা তখন। পেটে ছুঁচো লাফাচ্ছে দুজনেরই। সঙ্গে মাথাব্যথা বোনাস হিসেবে হাজির। মিলন ভাই কথা বলিয়ে দিলেন অমরদার সঙ্গে। অমরদা বললেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না। আমি আপনাদের একটা ছোট গ্রুপে ঢুকিয়ে দিচ্ছি।’ আকাশ ভাইদের দলটা পাঁচজনের। সৌরভ ভাইরা ছিলেন দুজন। আমরা দুজন।
মোট নয়জন হয়ে গেলাম। কাগজপত্র সব অমরদার হাতে সঁপে দিয়ে আমরা রাস্তা পার হয়ে কাউন্টারের উল্টো পাশে খেতে গেলাম। ‘ঢাকা হোটেল’ নাম দেখে খুব আগ্রহ করে খেতে ঢুকেছিলাম। কিন্তু আমরা হতাশ! কোনোরকমে পেটপূজা করে দৌড় দিলাম আবার কাউন্টারে। পাছে আমাদের ফেলে না চলে যায় বাকিরা। কিন্তু না। এত মানুষের কাগজপত্র ঠিক করতে সময় লাগছিল অনেক।
কাগজপত্র ঠিকঠাক হলে অটোরিকশা দিয়ে চলে গেলাম সিকিম প্রবেশের অনুমতি আনতে। কাউন্টার থেকে খুব একটা দূরে না। আমাদের কাগজপত্র ও পাসপোর্টগুলো জমা রেখেছিলাম অমরদার কাছে। অমরদা আর মিলন ভাই খেটেমেটে সিকিম প্রবেশের অনুমতি আনলেন আমাদের জন্য। বেশি সময় লাগেনি। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে অনুমতি পেয়ে গেলাম। সেখান থেকে চলে গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বললে ভুল হবে অবশ্য। সেখানে সব ছিল জিপ। অমরদা মাঝারি সাইজের দুটি জিপ ভাড়া করলেন। দুই জিপে নয়জনের দলটা ভাগ হয়ে গেলাম। একটা জিপে আটজন আঁটে। একটু বড় জিপ হলে নয়জন যাওয়া যায়। কিন্তু তখন মিলন ভাই আর অমরদা যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। অমরদা আবার আরও একটা বড় দলের দায়িত্বে ছিলেন। দুই দল নিয়ে তিনি সিকিমের পথে রওনা হলেন।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা চলতে শুরু করলাম সিকিমের উদ্দেশে। শুরু থেকে পুরোটা ভ্রমণে আমি আর ভুবন সামনের সিটে বসেছি। আমাদের কেউ আলাদা করতেই চাইত না! আসল কথা, অন্যদের তুলনায় ‘চিকন’ স্বাস্থ্যের অধিকারী বলে আমাদের দুজনকে সবাই সামনে বসতে দিত। আর অনায়াসে বাকিরা পেছনে মোটামুটি আরাম করে বসতেন।
যাওয়ার পথে বেশ কিছু হনুমান মন্দির চোখে পড়ল। যেতে যেতে দেখলাম দুপাশে বন। একটা জায়গা পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি দেখতে পেলাম ওই বনের মধ্যেই। যে সড়ক ধরে যাচ্ছিলাম সেটার নাম দেওয়া ছিল ‘এনএইচ ১০’, অর্থাৎ ন্যাশনাল হাইওয়ে ১০। শিলিগুড়ি থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছিলাম আমরা। সড়কের অবস্থান দেখে বুঝতে পারছিলাম। একপর্যায়ে দেখলাম দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তা। জিপের চালক বললেন, ‘উ দার্জিলিং কা রাস্তা হ্যায়’। আমরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরে ওপরে উঠছিলাম। এটা ছিল সিকিমের পথ। আর ডান দিকে গেলে দার্জিলিং।
সন্ধ্যা নেমে আসছিল ক্রমশ। এর মধ্যে যতটুকু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিলাম, তাতে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছিল! সবাই আহা, উহু, মাশাআল্লাহ বলতে বলতে পথ পার করছিলাম। না চাইলেও মুখ দিয়ে এসব শব্দ বের হচ্ছিল সবার। এতটুকুও একঘেয়েমি লাগছিল না। ঘুমিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, যতই লম্বা সফর হোক না কেন। সবার এহেন অবস্থা দেখে চালক বললেন, ‘ইয়ে তো কুছ ভি নেহি হ্যায়। আগে আপ সিকিম যা কে তো দেখো!’ ‘তাই?’ আগ্রহ কয়েক হাজার গুণ যেন বেড়ে গেল। চলতি পথে চালক আংকেলের সঙ্গেও কথা হয়ে গেল আমাদের। উনি আমাদের বাংলা বোঝেন অল্পস্বল্প কিন্তু বলতে পারেন না। তাঁর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলাই একমাত্র উপায়। রাস্তাঘাটে আবার অনেকের সঙ্গে দেখলাম নেপালি ভাষায় কথা বলতে। ওপরে থাকতে থাকতে নাকি ওই ভাষাটা আয়ত্ত করেছেন।
এমনিতে উনি বাঙালি না। সিকিমের বাসিন্দাও না। সম্ভবত পাঞ্জাবি ছিলেন। এখন ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু থাকেন সিকিমে। রাজধানী গ্যাংটকেই তাঁর বাড়ি এখন। পরিবারসহ বহু বছর ধরে আছেন। গাড়ি চালানোই তাঁর পেশা। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি। সিকিমের এই পাহাড়ি পথ হয়তো চোখ বুজে পাড়ি দিতে পারবেন!
অন্ধকার হয়ে এলে বাইরে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তাই আংকেলজিকে সবাই অনুরোধ করলাম গান ছাড়তে। মুশকিল হলো, তাঁর কাছে প্রায় সবই নেপালি গান ছিল। ভাষা বোঝা দুষ্কর। তবু আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছি। ভাষা না বুঝলেও গানগুলোর সুর এনজয় করেছি। মাঝে মাঝে আংকেলকে জিজ্ঞেস করেছি অর্থ। তিনিও সুন্দর করে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো রোমান্টিক গানের ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি ইতস্তত বোধ করছিলেন অনুবাদ করতে। বলছিলেন, ‘আপ নেহি সামঝোগে। ইয়ে রোমান্টিক গানা হ্যায়।’ তারপর সবাই বুঝিয়ে বললাম, ‘আমরা তো এত বাচ্চা নই আংকেল। সবাই বিবাহিত। রোমান্টিক কথার অর্থ বোঝার বয়স হয়েছে।’ এরপর তিনি ঠিকই বুঝিয়ে দিলেন, ‘লাড়কা অউর লাড়কি এক দুসরেকো চিঠি লেখনেকো কেহতে হ্যায়।’ ও আচ্ছা, এতটুকু সহজ রোমান্টিক কথা তো বুঝতেই পারি! তারপর বললেন, প্রেমিকযুগল দেখা করতে চায়, বিয়ে করতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
মাঝপথে নেমে এক জায়গায় চা পান করে নিলাম সবাই। চা ভালো ছিল। ওদের ‘আদ্রাকওয়ালি’ চা। দুধ চায়ের মধ্যেই আদা আর এলাচির ঘ্রাণ আসে। তখন চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও পাহাড়ের গায়ে আলো জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল পাহাড়ের গায়ে তারার ফুল ফুটেছে। শহরে ঢোকার আগ পর্যন্ত এমন দৃশ্য উপভোগ করতে পেরেছি। আসলে সেগুলো ছিল একেকটা বাড়ির আলো। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘর বেঁধেছে যারা, তাদের বাড়ির আলো। ভাবা যায়, এই পাহাড়ের তুলনায় বাড়িগুলো কত ক্ষুদ্র! এর চেয়েও ক্ষুদ্র আমরা মানুষেরা। এই বিশাল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওপরে উঠতে উঠতে এগুলোই ভাবছিলাম।
সিকিমে ঢোকার অনুমতি নিয়ে তো সিকিম রাজ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম। কিন্তু সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে ঢোকার আগেও একটা অনুমতি লাগে। র্যাংপো নামের শহরে এসে গ্যাংটকে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়েছে আমাদের। আমাদের অবশ্য কিছু করতে হয়নি। যা করার অমরদা আর মিলন ভাই মিলেই করেছেন। আধা ঘণ্টার মতো র্যাংপোতে ছিলাম। জিপ থেকে নেমে রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। খুব সুন্দর একটা রাস্তা। ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে। দুপাশের দালানগুলো তাই কায়দা করে গড়া। এদিক-সেদিক বুনো গাছে ফুটে থাকা বুনো ফুলগুলো যেন আমার দিকে চেয়ে ছিল! কী সুন্দর যে দেখতে! মায়াময়।
অনুমতি নেওয়া হলে গ্যাংটকে পৌঁছানোর তাড়া। রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে নাকি সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। বড়জোর নয়টা পর্যন্ত কিছু কিছু রেস্তোরাঁ খোলা পাওয়া যেতে পারে। আংকেল জানালেন, এই শীতের রাজ্যে সবাই জলদি খেয়ে জলদি ঘুমাতে যায়। আর খুব সকালে উঠে কাজে নেমে পড়ে। যে হোটেলে থাকব সেখানেও রাত নয়টার মধ্যে ফরমাশ করতে হয়। দশটার মধ্যে নাকি তাঁদের হেঁশেল বন্ধ করে দেয়। গাড়িতে আমরা চিপস খেয়ে ক্ষুধা মোটামুটি দমিয়ে রেখেছিলাম। যাই হোক, আটটার পরে গ্যাংটকে প্রবেশ করতে পারলাম। পুরোটা পথ ‘কত দূর কতদূর’ করতে করতে যাচ্ছিলাম। আর আংকেলজি ‘অউর এক ঘণ্টা’, ‘অউর বিশ-পচ্চিশ মিনিট’ বলে বলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টায় হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন। অমরদা আগেই মল রোডের ডোমা রেসিডেন্সি নামের হোটেলে কথা বলে রেখেছিলেন। আমরা একপ্রকার তড়িঘড়ি করে হোটেলে উঠলাম।
খুব দ্রুত গোসল সেরে দুজনে প্রস্তুত হয়ে গেলাম খাওয়ার জন্য। নিচে নেমে দেখি যে যার মতো খাবার খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না। অনেকেই বলছিলেন সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তখন সবে নয়টার মতো বাজে। কপালে বুঝি খাবার নেই ভাবতে ভাবতে অমরদাকে সাহায্য করছিলাম উত্তরে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য। দশটা যখন বাজে প্রায় তখন ভাবলাম হোটেলের রেস্তোরাঁয় গিয়েই দেখি না খাবার জুটে কি না। একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে অমরদা বলে-কয়ে আমাদের কয়েকজনের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তাঁরা হেঁশেল বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন তখন। একটু অপেক্ষা করে ভাত, ডাল, রুই মাছ পেলাম। ওই খাবারটা ভালো ছিল। একটা আমের আচার দিয়েছিল সঙ্গে। ইশ, কী টক! দাঁত শিরশিরিয়ে উঠেছিল। আর যারা বাইরে থেকে খেয়ে আসতে পেরেছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাটা ছিল এমন, ‘ভাই, লবণ খেয়ে আসছি। সঙ্গে একটু ফ্রায়েড রাইস মেশানো ছিল!’ এরপর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি ভারতীয়রা যে কত লবণপ্রেমী! বিশেষ করে পরে শিলিগুড়িতে থেকে। সিকিমের খাবারে খুব একটা বেশি ছিল না লবণ। সহ্য করার মতো আর কি!
খেয়েদেয়ে রুমে চলে গেলাম। ভুবন শিলিগুড়ি থেকে ভোডাফোনের সিম কিনে এনেছিল। এটাই নাকি পাহাড়ি রাজ্যে সবচেয়ে ভালো নেটওয়ার্ক। কিন্তু হায়! আমরা ঠিকমতো কোনো নেটওয়ার্কই পেলাম না। বিশেষ করে ঘরের ভেতর থাকলে তো পাওয়াই যেত না। কোনোরকমে ভাইয়াকে খুদেবার্তা পাঠিয়ে জানালাম যে আমরা ঠিকঠাকভাবে পৌঁছে গেছি। সবাইকে যেন জানিয়ে দেয়। এরপর ফোনে অ্যালার্ম লাগিয়ে দুজনেই গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম। সকাল সাতটায় রওনা হতে হবে লাচুংয়ের উদ্দেশে।
(চলবে)
আরও পড়ুন:
শিলিগুড়িতে শ্যামলীর কাউন্টারে নামতে নামতে সেখানকার সময় বেলা দুটো কি আড়াইটা তখন। পেটে ছুঁচো লাফাচ্ছে দুজনেরই। সঙ্গে মাথাব্যথা বোনাস হিসেবে হাজির। মিলন ভাই কথা বলিয়ে দিলেন অমরদার সঙ্গে। অমরদা বললেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না। আমি আপনাদের একটা ছোট গ্রুপে ঢুকিয়ে দিচ্ছি।’ আকাশ ভাইদের দলটা পাঁচজনের। সৌরভ ভাইরা ছিলেন দুজন। আমরা দুজন।
মোট নয়জন হয়ে গেলাম। কাগজপত্র সব অমরদার হাতে সঁপে দিয়ে আমরা রাস্তা পার হয়ে কাউন্টারের উল্টো পাশে খেতে গেলাম। ‘ঢাকা হোটেল’ নাম দেখে খুব আগ্রহ করে খেতে ঢুকেছিলাম। কিন্তু আমরা হতাশ! কোনোরকমে পেটপূজা করে দৌড় দিলাম আবার কাউন্টারে। পাছে আমাদের ফেলে না চলে যায় বাকিরা। কিন্তু না। এত মানুষের কাগজপত্র ঠিক করতে সময় লাগছিল অনেক।
কাগজপত্র ঠিকঠাক হলে অটোরিকশা দিয়ে চলে গেলাম সিকিম প্রবেশের অনুমতি আনতে। কাউন্টার থেকে খুব একটা দূরে না। আমাদের কাগজপত্র ও পাসপোর্টগুলো জমা রেখেছিলাম অমরদার কাছে। অমরদা আর মিলন ভাই খেটেমেটে সিকিম প্রবেশের অনুমতি আনলেন আমাদের জন্য। বেশি সময় লাগেনি। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে অনুমতি পেয়ে গেলাম। সেখান থেকে চলে গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বললে ভুল হবে অবশ্য। সেখানে সব ছিল জিপ। অমরদা মাঝারি সাইজের দুটি জিপ ভাড়া করলেন। দুই জিপে নয়জনের দলটা ভাগ হয়ে গেলাম। একটা জিপে আটজন আঁটে। একটু বড় জিপ হলে নয়জন যাওয়া যায়। কিন্তু তখন মিলন ভাই আর অমরদা যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। অমরদা আবার আরও একটা বড় দলের দায়িত্বে ছিলেন। দুই দল নিয়ে তিনি সিকিমের পথে রওনা হলেন।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা চলতে শুরু করলাম সিকিমের উদ্দেশে। শুরু থেকে পুরোটা ভ্রমণে আমি আর ভুবন সামনের সিটে বসেছি। আমাদের কেউ আলাদা করতেই চাইত না! আসল কথা, অন্যদের তুলনায় ‘চিকন’ স্বাস্থ্যের অধিকারী বলে আমাদের দুজনকে সবাই সামনে বসতে দিত। আর অনায়াসে বাকিরা পেছনে মোটামুটি আরাম করে বসতেন।
যাওয়ার পথে বেশ কিছু হনুমান মন্দির চোখে পড়ল। যেতে যেতে দেখলাম দুপাশে বন। একটা জায়গা পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি দেখতে পেলাম ওই বনের মধ্যেই। যে সড়ক ধরে যাচ্ছিলাম সেটার নাম দেওয়া ছিল ‘এনএইচ ১০’, অর্থাৎ ন্যাশনাল হাইওয়ে ১০। শিলিগুড়ি থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছিলাম আমরা। সড়কের অবস্থান দেখে বুঝতে পারছিলাম। একপর্যায়ে দেখলাম দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তা। জিপের চালক বললেন, ‘উ দার্জিলিং কা রাস্তা হ্যায়’। আমরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরে ওপরে উঠছিলাম। এটা ছিল সিকিমের পথ। আর ডান দিকে গেলে দার্জিলিং।
সন্ধ্যা নেমে আসছিল ক্রমশ। এর মধ্যে যতটুকু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিলাম, তাতে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছিল! সবাই আহা, উহু, মাশাআল্লাহ বলতে বলতে পথ পার করছিলাম। না চাইলেও মুখ দিয়ে এসব শব্দ বের হচ্ছিল সবার। এতটুকুও একঘেয়েমি লাগছিল না। ঘুমিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, যতই লম্বা সফর হোক না কেন। সবার এহেন অবস্থা দেখে চালক বললেন, ‘ইয়ে তো কুছ ভি নেহি হ্যায়। আগে আপ সিকিম যা কে তো দেখো!’ ‘তাই?’ আগ্রহ কয়েক হাজার গুণ যেন বেড়ে গেল। চলতি পথে চালক আংকেলের সঙ্গেও কথা হয়ে গেল আমাদের। উনি আমাদের বাংলা বোঝেন অল্পস্বল্প কিন্তু বলতে পারেন না। তাঁর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলাই একমাত্র উপায়। রাস্তাঘাটে আবার অনেকের সঙ্গে দেখলাম নেপালি ভাষায় কথা বলতে। ওপরে থাকতে থাকতে নাকি ওই ভাষাটা আয়ত্ত করেছেন।
এমনিতে উনি বাঙালি না। সিকিমের বাসিন্দাও না। সম্ভবত পাঞ্জাবি ছিলেন। এখন ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু থাকেন সিকিমে। রাজধানী গ্যাংটকেই তাঁর বাড়ি এখন। পরিবারসহ বহু বছর ধরে আছেন। গাড়ি চালানোই তাঁর পেশা। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি। সিকিমের এই পাহাড়ি পথ হয়তো চোখ বুজে পাড়ি দিতে পারবেন!
অন্ধকার হয়ে এলে বাইরে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তাই আংকেলজিকে সবাই অনুরোধ করলাম গান ছাড়তে। মুশকিল হলো, তাঁর কাছে প্রায় সবই নেপালি গান ছিল। ভাষা বোঝা দুষ্কর। তবু আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছি। ভাষা না বুঝলেও গানগুলোর সুর এনজয় করেছি। মাঝে মাঝে আংকেলকে জিজ্ঞেস করেছি অর্থ। তিনিও সুন্দর করে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো রোমান্টিক গানের ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি ইতস্তত বোধ করছিলেন অনুবাদ করতে। বলছিলেন, ‘আপ নেহি সামঝোগে। ইয়ে রোমান্টিক গানা হ্যায়।’ তারপর সবাই বুঝিয়ে বললাম, ‘আমরা তো এত বাচ্চা নই আংকেল। সবাই বিবাহিত। রোমান্টিক কথার অর্থ বোঝার বয়স হয়েছে।’ এরপর তিনি ঠিকই বুঝিয়ে দিলেন, ‘লাড়কা অউর লাড়কি এক দুসরেকো চিঠি লেখনেকো কেহতে হ্যায়।’ ও আচ্ছা, এতটুকু সহজ রোমান্টিক কথা তো বুঝতেই পারি! তারপর বললেন, প্রেমিকযুগল দেখা করতে চায়, বিয়ে করতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
মাঝপথে নেমে এক জায়গায় চা পান করে নিলাম সবাই। চা ভালো ছিল। ওদের ‘আদ্রাকওয়ালি’ চা। দুধ চায়ের মধ্যেই আদা আর এলাচির ঘ্রাণ আসে। তখন চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও পাহাড়ের গায়ে আলো জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল পাহাড়ের গায়ে তারার ফুল ফুটেছে। শহরে ঢোকার আগ পর্যন্ত এমন দৃশ্য উপভোগ করতে পেরেছি। আসলে সেগুলো ছিল একেকটা বাড়ির আলো। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘর বেঁধেছে যারা, তাদের বাড়ির আলো। ভাবা যায়, এই পাহাড়ের তুলনায় বাড়িগুলো কত ক্ষুদ্র! এর চেয়েও ক্ষুদ্র আমরা মানুষেরা। এই বিশাল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওপরে উঠতে উঠতে এগুলোই ভাবছিলাম।
সিকিমে ঢোকার অনুমতি নিয়ে তো সিকিম রাজ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম। কিন্তু সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে ঢোকার আগেও একটা অনুমতি লাগে। র্যাংপো নামের শহরে এসে গ্যাংটকে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়েছে আমাদের। আমাদের অবশ্য কিছু করতে হয়নি। যা করার অমরদা আর মিলন ভাই মিলেই করেছেন। আধা ঘণ্টার মতো র্যাংপোতে ছিলাম। জিপ থেকে নেমে রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। খুব সুন্দর একটা রাস্তা। ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে। দুপাশের দালানগুলো তাই কায়দা করে গড়া। এদিক-সেদিক বুনো গাছে ফুটে থাকা বুনো ফুলগুলো যেন আমার দিকে চেয়ে ছিল! কী সুন্দর যে দেখতে! মায়াময়।
অনুমতি নেওয়া হলে গ্যাংটকে পৌঁছানোর তাড়া। রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে নাকি সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। বড়জোর নয়টা পর্যন্ত কিছু কিছু রেস্তোরাঁ খোলা পাওয়া যেতে পারে। আংকেল জানালেন, এই শীতের রাজ্যে সবাই জলদি খেয়ে জলদি ঘুমাতে যায়। আর খুব সকালে উঠে কাজে নেমে পড়ে। যে হোটেলে থাকব সেখানেও রাত নয়টার মধ্যে ফরমাশ করতে হয়। দশটার মধ্যে নাকি তাঁদের হেঁশেল বন্ধ করে দেয়। গাড়িতে আমরা চিপস খেয়ে ক্ষুধা মোটামুটি দমিয়ে রেখেছিলাম। যাই হোক, আটটার পরে গ্যাংটকে প্রবেশ করতে পারলাম। পুরোটা পথ ‘কত দূর কতদূর’ করতে করতে যাচ্ছিলাম। আর আংকেলজি ‘অউর এক ঘণ্টা’, ‘অউর বিশ-পচ্চিশ মিনিট’ বলে বলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টায় হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন। অমরদা আগেই মল রোডের ডোমা রেসিডেন্সি নামের হোটেলে কথা বলে রেখেছিলেন। আমরা একপ্রকার তড়িঘড়ি করে হোটেলে উঠলাম।
খুব দ্রুত গোসল সেরে দুজনে প্রস্তুত হয়ে গেলাম খাওয়ার জন্য। নিচে নেমে দেখি যে যার মতো খাবার খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না। অনেকেই বলছিলেন সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তখন সবে নয়টার মতো বাজে। কপালে বুঝি খাবার নেই ভাবতে ভাবতে অমরদাকে সাহায্য করছিলাম উত্তরে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য। দশটা যখন বাজে প্রায় তখন ভাবলাম হোটেলের রেস্তোরাঁয় গিয়েই দেখি না খাবার জুটে কি না। একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে অমরদা বলে-কয়ে আমাদের কয়েকজনের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তাঁরা হেঁশেল বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন তখন। একটু অপেক্ষা করে ভাত, ডাল, রুই মাছ পেলাম। ওই খাবারটা ভালো ছিল। একটা আমের আচার দিয়েছিল সঙ্গে। ইশ, কী টক! দাঁত শিরশিরিয়ে উঠেছিল। আর যারা বাইরে থেকে খেয়ে আসতে পেরেছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাটা ছিল এমন, ‘ভাই, লবণ খেয়ে আসছি। সঙ্গে একটু ফ্রায়েড রাইস মেশানো ছিল!’ এরপর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি ভারতীয়রা যে কত লবণপ্রেমী! বিশেষ করে পরে শিলিগুড়িতে থেকে। সিকিমের খাবারে খুব একটা বেশি ছিল না লবণ। সহ্য করার মতো আর কি!
খেয়েদেয়ে রুমে চলে গেলাম। ভুবন শিলিগুড়ি থেকে ভোডাফোনের সিম কিনে এনেছিল। এটাই নাকি পাহাড়ি রাজ্যে সবচেয়ে ভালো নেটওয়ার্ক। কিন্তু হায়! আমরা ঠিকমতো কোনো নেটওয়ার্কই পেলাম না। বিশেষ করে ঘরের ভেতর থাকলে তো পাওয়াই যেত না। কোনোরকমে ভাইয়াকে খুদেবার্তা পাঠিয়ে জানালাম যে আমরা ঠিকঠাকভাবে পৌঁছে গেছি। সবাইকে যেন জানিয়ে দেয়। এরপর ফোনে অ্যালার্ম লাগিয়ে দুজনেই গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম। সকাল সাতটায় রওনা হতে হবে লাচুংয়ের উদ্দেশে।
(চলবে)
আরও পড়ুন:
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে