রানাকুমার সিংহ
একটি অন্ধ ভিখারি রোজ মন্দিরে পূজা করতে যায়। প্রতিদিন ভক্তিভরে পূজা শেষ করে মন্দিরের দরজায় প্রণাম করে সে ফিরে আসে; মন্দিরের পুরোহিত সেটা ভাল করে লক্ষ্য করে দেখেন। এইভাবে কত বৎসর কেটে গেছে কেউ জানে না। একদিন পুরোহিত ভিখারিকে ডেকে বললেন, “দেখ হে! দেবতা তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। তুমি কোন একটা বর চাও। কিন্তু, মনে রেখো, একটিমাত্র বর পাবে।” ভিখারি বেচারা বড় মুস্কিলে পড়ল। কি যে চাইবে, কিছুতেই আর ঠিক করতে পারে না। একবার ভাবল, দৃষ্টি ফিরে চাইবে; আবার ভাবল, টাকাকড়ি চাইবে; আবার ভাবল, আত্মীয়স্বজন ছেলেপিলের দীর্ঘ জীবন এইসব চাইবে, কিছুতেই আর ঠিক করতে পারে না। তখন সে বলল, “আচ্ছা, আমি কাল ভাল করে ভেবে এসে বর চাইব। এখন কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না, কি চাই।” অনেক ভেবেচিন্তে সে মনে মনে একটা ঠিক করে নিল। তারপর মন্দিরে গিয়ে পুরোহিতকে বলল, “পরতে ঠাকুর! আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছি: আপনি আমার বড় উপকার করলেন। যে একটি বরের কথা বলেছেন সেটি এখন আমি চাইব মনে রাখবেন, একটিমাত্র বর আমি চাচ্ছি। আমি এই বর চাই যে মরবার আগে যেন আমার নাতিকে ছয়তলা বাড়ির মধ্যে বসে সোনার থালায় পায়স খেতে স্বচক্ষে দেখে যেতে পারি।” এই এক বরে ভিখারি চোখের দৃষ্টি ফিরে পেল, ধনজন পেল, ছেলেপিলে, নাতি-নাতনি পেল, দীর্ঘজীবন।—‘একটি বর’ শিরোনামের গল্পটি সুকুমার রায়ের। একটানে পড়ে ফেলার মতো এমন গল্পই তিনি বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়েছেন। টানটান আবেশের এসব গল্পে আনন্দের পাশাপাশি বুদ্ধির খেলা পাঠকের আগ্রহ উস্কে দেয় এখনো।
তেমনিভাবে উপদেশ শুনতে কারোরই ভাল লাগার কথা না, বিশেষ করে শিশুদের। কিন্তু সুকুমার রায় যদি উপদেশ দেন তবে সেই উপদেশ শুনতেই হয়! সুকুমার রায় গল্প-ছড়া-নাটক-প্রবন্ধে শিশুদের এমন কতকিছুই শিখিয়েছেন। কঠিন উপদেশের বাইরে এসে গল্প-কবিতার ছলে শিখিয়েছেন উচিত-অনুচিত। পেনসিল কামড়ানো কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ করে নেমে জুতা ছিঁড়ে ফেলা একদম ভালো কাজ নয়—এ উপদেশ দিতে গিয়ে ‘যতীনের জুতো’ নামক একটি গল্পই সুকুমার রায় লিখে ফেলেছেন। গল্পটির কিয়দংশ এমন—যতীন দেখল সে কোন অচেনা দেশে এসে পড়েছে। সেখানে চারদিকে অনেক মুচি বসে আছে। তারা যতীনকে দেখে কাছে এল, তারপর তার পা থেকে ছেঁড়া চটিজোড়া খুলে নিয়ে সেগুলোকে যত্ন করে ঝাড়তে লাগল। তাদের মধ্যে একজন মাতব্বর গোছের, সে যতীনকে বলল, “তুমি দেখছি ভারি দুষ্টু। জুতোজোড়ার এমন দশা করেছ? দেখ দেখি, আর একটু হলে বেচারিদের প্রাণ বেরিয়ে যেত।” যতীনের ততক্ষণে একটু সাহস হয়েছে। সে বলল, “জুতোর আবার প্রাণ থাকে নাকি?” মুচিরা বলল, “তা না তো কি? তোমরা বুঝি মনে কর, তোমরা যখন জুতো পায়ে দিয়ে জোরে ছোটো তখন ওদের লাগে না? খুব লাগে। লাগে বলেই তো ওরা মচ্মচ্ করে। যখন তুমি চটি পায়ে দিয়ে দুড়্দুড়্ করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছিলে আর তোমার পায়ের চাপে ওর পাশ কেটে গিয়েছিল, তখন কি ওর লাগেনি? খুব লেগেছিল। সেইজন্যেই ও তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। যত রাজ্যের ছেলেদের জিনিসপত্রের ভার আমাদের উপর। তারা সে সবের অযত্ন করলে আমরা তাদের শিক্ষা দেই।” মুচি যতীনের হাতে ছেঁড়া চটি দিয়ে বলল, “নাও, সেলাই কর।” যতীন রেগে বলল, “আমি জুতো সেলাই করি না, মুচিরা করে।” মুচি একটু হেসে বলল, “একি তোমাদের দেশ পেয়েছ যে করব না বললেই হল? এই ছুঁচ সুতো নাও, সেলাই কর।” যতীনের রাগ তখন কমে এসেছে, তার মনে ভয় হয়েছে। সে বলল, “আমি জুতো সেলাই করতে জানি না।” মুচি বলল, “আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, সেলাই তোমাকে করতেই হবে।” যতীন ভয়ে ভয়ে জুতো সেলাই করতে বসল। তার হাতে ছুঁচ ফুটে গেল, ঘাড় নিচু করে থেকে থেকে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল, অনেক কষ্টে সারাদিনে একপাটি চটি সেলাই হল। তখন সে মুচিকে বলল, “কাল অন্যটা করব। এখন ক্ষিদে পেয়েছে।” মুচি বলল, “সে কি! সব কাজ শেষ না করে তুমি খেতেও পাবে না, ঘুমোতেও পাবে না। একপাটি চটি এখনও বাকি আছে। তারপর তোমাকে আস্তে আস্তে চলতে শিখতে হবে, যেন আর কোনো জুতোর উপর অত্যাচার না কর। তারপর দরজীর কাছে গিয়ে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে হবে। তারপর আর কি কি জিনিস নষ্ট কর দেখা যাবে।”...এভাবেই স্বভাবসুলভ টানটান ভঙ্গিতে গল্পটি এগিয়ে যায় আর যতীনও বুঝতে পারে কোনো কাজ সহজ নয়। অবহেলা করে কোনো জিনিসই নষ্ট করা ঠিক নয়। এরপর সে আর পেনসিল কামড়ায় না, জুতোও ছিঁড়ে না। কোমল শিশু মননে এত সুন্দরভাবে শুভচিন্তা গেঁথে দেওয়ার কাজটি সুকুমার রায়ই বাংলা সাহিত্যে সংযুক্ত করেছেন।
সুকুমার রায়ের গল্প নিয়ে তো কিছু কথা হলো। ছড়াকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান অবধারিতভাবে শীর্ষে। সকলের প্রিয় ছড়াকারই শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যে ননসেন্সের প্রবর্তকও তিনি। ব্রিটিশ সাহিত্যিক এডওয়ার্ড লিয়রের লেখা ‘বুক অব ননসেন্স’-এর হাত ধরেই বিশ্বের শিশুরা সাহিত্যে পেয়েছিল এক অদ্ভুত দেশের খোঁজ। ননসেন্সকে জনপ্রিয় করার পেছনে আরও একটি নাম-লুই ক্যারল। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ নামের যে উদ্ভট উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তা আজও সবার কাছে জনপ্রিয়। নানা কমিকস, কার্টুন আর সিনেমার কল্যাণে এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ইংরেজিতে যেমন ক্যারল অথবা এডওয়ার্ড লিয়র তেমনই বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়। তিনি বাংলা ননসেন্স সাহিত্যের সম্রাট। সুকুমার তাঁর ননসেন্স ও উদ্ভট ধরনের রচনায় এডওয়ার্ড লিয়রের ‘বুক অব ননসেন্স’, লুইস ক্যারলের ‘অ্যালিস ঐ দ্য লুকিং গ্লাস’ কিংবা ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ প্রভৃতি লেখার দ্বারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছেন, আবার হয়ত রয়েছে চ্যাপলিনের খামখেয়ালিপনার প্রভাবও। কিন্তু তাঁর লেখা ও আঁকায় যেন তাঁর সৃষ্ট উদ্ভট চরিত্র ও ছবিগুলি অনেক বেশি সরস ও গতিশীল। এ প্রসঙ্গে সুকুমার রায়ের একমাত্র সন্তান আরেক কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় বলেন—আসলে, যে-কথা আগেই বলেছি, সুকুমারের ননসেন্সের অনেকখানি সুকুমারেরই সৃষ্টি। প্রভাবের কথাই যদি বলতে হয় তাহলে শুধু বাংলার ট্র্যাডিশনের কথা বললে চলে না, বিদেশী সাহিত্য, পান্টোমাইম, চার্লি চ্যাপলিন, বিলিতি কমিকস (মার্কিন কমিক পুস্তকের ক্যাটজেন-জ্যামার কিস যে মোমবাতি-চোষা ডানপিটে ছেলের প্রেরণার উৎস সেটা আবোল তাবোলের ছবি দেখলেই বোঝা যায়)–এসবই সুকুমারের ননসেন্সের পুষ্টি সাধন করেছে। ননসেন্সের রসগ্রহণ বাঙালি পাঠক করতে পারবে কি না সে সম্বন্ধে সুকুমারের সংশয় ছিল; তাই এ জাতীয় আবোল তাবোলের ভূমিকায় তাঁকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল—ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে রবীন্দ্রনাথও তাঁর শেষ বয়সের উদ্ভট ছড়ার সংকলন ’খাপছাড়া’-তে এই ধরনের একটা কৈফিয়তের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন।
তবে, শুধু ননসেন্স নয়, সুকুমার তাঁর সাহিত্যে ছোটদের জন্য এমন এক বিচিত্র জগৎ গড়ে গেছেন, যার আনন্দ থেকে শিশুদের বঞ্চিত করা উচিত নয়। সুকুমার রায় তাঁর ছড়া-নাটক-গল্পে প্রাণী অথবা পৌরাণিক প্রাণীর ব্যবহার করেছেন। নিজের কল্পনাজগতের উদ্ভট প্রাণিকুলের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করান তার লেখায়-আঁকায়। সুকুমারের এমন অনন্য আবিষ্কার তাঁর লেখাকে আকর্ষণীয় ও রসময় করে তোলে। যেমন তিনি লিখেছেন—
হলদে সবুজে ওরাং ওটাং
ইট পাটকেল চিৎ পটাং
গন্ধ গোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি
নন্দী ভৃঙ্গী সারেগামা
নেই মামা তাই কানা মামা
চিনে বাদাম সর্দি কাশি
ব্লটিং পেপার বাঘের মাসি
মুশকিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।
এমন ননসেন্সময় বক্তব্য বড় গভীর। গভীরে যেতে যেতে পাঠক জিনিয়াস হয়ে ওঠেন নিশ্চয়ই! আলোচিত এমন সব উদ্ভট বিষয় নিয়ে সুকুমার রায় প্রণীত আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি, খাই‐খাই, অবাক জলপান, লক্ষণের শক্তিশেল, ঝালাপালা ও অনান্য নাটক, হ য ব র ল, শব্দ কল্প দ্রুম, বহুরূপী, ভাষার অতাচার ইত্যাদি গ্রন্থ বাংলা শিশুসাহিত্যের অমর সৃষ্টি।
বাংলাসাহিত্যে সুকুমার রায়ের তুলনা কেবল সুকুমার রায়ই। সন্দেশ পত্রিকায় তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা প্রকাশ পেত। ছোটদের উপযোগী করে সহজভাবে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন সেসব লেখায়। সুকুমার অনায়াসে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে শিশুদের জন্য রসপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতেন। বিজ্ঞান বিষয়ে সন্দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘বেগের কথা’। সহজভাবে ছোটদের তিনি ‘বেগ’ সম্বন্ধে বুঝিয়েছেন এভাবে—যে লোক সৌখিন, সামান্য কষ্টেই কাতর হইয়া পড়ে তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলা হয় ‘ফুলের ঘায় মূর্ছা যায়।’ রঘুবংশে আছে যে দশরথের মা ইন্দুমতী সত্যসত্যই ফুলের ঘায়ে কেবল মূর্ছা নয়, একেবারে মারাই গিয়াছিলেন। ইন্দ্রের পারিজাতমালা আকাশ হইতে তাঁহার গায়ে পড়ায় তাঁহার মৃত্যু হয়। প্রথম যখন এই বর্ণনাটা শুনিয়াছিলাম তখন ইহাকে অসম্ভব কল্পনা বলিয়া বোধ হইয়াছিল; কিন্তু এখন ভাবিয়া দেখিতেছি ইহা নিতান্ত অসম্ভব কিছু নয়। তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্রমাসের তাল যদি ধুপ্ করিয়া পিঠে পড়ে তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারাগাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উঁচু হইতে পড়িতে থাকে তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে। যে হাড়ের টুকরাটি দোতলা হইতে একতলায় মানুষের মাথায় পড়িলে বিশেষ কোনই অনিষ্ট হয় না—সেইটিই যখন চিলের মুখ হইতে পড়িতে পড়িতে অনেক নীচে প্রবল বেগে আসিয়া নামে তখন তাহার আঘাতে মানুষ রীতিমত জখম হইতে পারে। ফুলের মালাটিকেও যদি যথেষ্ট উঁচু হইতে ফেলিয়া দেওয়া যায় তবে তাহার আঘাতটি যে একেবারেই মোলায়েম হইবে না, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।
অল্পদিনের লেখালেখির জীবনে সুকুমার রায় পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, দেশ-বিদেশের উপকথার চরিত্র ইত্যাদি বিষয়েও অমূল্য সব রচনা লিখে গিয়েছেন। সুকুমারই ‘পাগলা দাশু’র মতো নতুন ধারণার স্কুল স্টোরি লিখেছেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তিনি ডুবো জাহাজ তথা সাবমেরিনের মতো বিষয় নিয়ে চমকপ্রদ লেখা শিশুদের জন্য উপহার দিয়েছেন। ভূমিকম্প, নীহারিকা, আলোর গতি ইত্যাদি বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা তাঁর হাতে দুর্দান্ত হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সুকুমার রায় একজন প্রকৃতিপ্রেমিক লেখক ছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎও ছিল তাঁর চিন্তার জগতে। তেমনি একটি লেখা ‘কাঠের কথা’। সেই লেখায় তিনি পৃথিবী একদিন বৃক্ষশূন্য হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘কেউ কেউ হয়ত বলবে, “দূর ছাই! কাঠের কথা আবার শুনব কি? ভারি ত জিনিস, তাই নিয়ে আবার কথা!” তা বলতে পার কিন্তু কাঠ যে মানুষের কাজের পক্ষে কত বড় দরকারী জিনিস, তা একবার ভেবে দেখেছ কি? এখন না হয় সভ্য মানুষে কয়লা, কেরোসিন, গ্যাস বা ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যবহার শিখেছে; কিন্তু তার আগে ত জ্বালানি কাঠ না হলে মানুষের রান্নাবান্না কলকারখানা কিচ্ছুই চলত না, শীতের দেশে মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হত। এই ত কিছুকাল আগেও কাঠের জাহাজ না হলে মানুষে সমুদ্রে যেতে পারত না, কাঠের কড়ি বরগা থাম না হলে তার ঘর বাড়ি তৈরি হত না। বলতে পার, এখন ত এ সবের জন্য কাঠের ব্যবহার কমে আসছে তা সত্যি! এমনকি, ঘরের দরজা-জানালা আসবাবপত্র পর্যন্ত যে ক্রমে কাঠের বদলে অন্য জিনিস দিয়ে তৈরি হতে থাকবে তাতেও কোন সন্দেহ নাই। আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই হয়ত দেখবে, ঘরে ঘরে নানারকম ঢালাই-করা মেটে পাথরের আসবাবপত্র! কিন্তু তবুও দেখা যায় যে খুব ‘সভ্য’ জাতিদের মধ্যেও কাঠের ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলছে, কমবার লক্ষণ একটাও দেখা যায় না। প্রতি বৎসরে এত কোটি মণ কাঠ মানুষে খরচ করে এবং তার জন্য এত অসংখ্য গাছ কাটতে হয় যে অনেকে আশঙ্কা করেন, হয়ত বেহিসাবী যথেচ্ছ গাছ কাটতে কাটতে কোন দিন পৃথিবীতে কাঠের দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হবে! এরকম যে সত্যি সত্যিই হতে পারে, তার প্রমাণ নানা দেশে পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকার যুক্তরাজ্যে এক সময়ে এমন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বন ছিল আর তাতে এত অসংখ্য গাছ ছিল যে লোকে বলত এ দেশের কাঠ অফুরন্ত—এরা সমস্ত পৃথিবীময় কাঠ চালান দিয়েও কোনদিন এত গাছ কেটে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু সে দেশের লোকে এমন বে-আন্দাজভাবে এর মধ্যে বন জঙ্গল সব কেটে প্রায় উজাড় করে ফেলেছে যে এখন তারা নিজেরাই অন্য দেশ থেকে কাঠ আমদানী করতে বাধ্য হচ্ছে।’
রসসম্রাট সুকুমার রায়ের চিরাচরিত রসের মধ্যেও ব্রিটিশবিরোধিতার ছাপ পাওয়া যায়। এমন একটি লেখা হলো ‘একুশের আইন’। সেখানে তিনি লিখেছেন—
শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
একুশ টাকা দণ্ড তার।।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে
হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে
দম্দমাদম্ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে—
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।।
এই পদ্যেই তিনি আরও লেখেন—
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা—
হিসেব কষায় একুশ পাতা।।
সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা শিশুসাহিত্যের বরপুত্র। সুকুমার-পূর্ব যুগে হরিনাথ মজুমদার, সর্বানন্দ রায়, মুনশী নামদার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদন মোহন দত্ত, অক্ষয় কুমার দত্ত, মদন মোহন তর্কালঙ্কার, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রমুখের হাত ধরে বাংলা শিশুসাহিত্যের পথচলা এগিয়েছিল। সেই গতিকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তায় সুকুমার সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই বাংলা শিশুসাহিত্য এগিয়ে চলছে বিগত এক শতাব্দী ধরে। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সুকুমারের প্রায় সমসাময়িক। সুকুমার সময়ের চাইতে আধুনিক ছিলেন। গত এক শ বছর বাংলা শিশুসাহিত্য নতুন নতুন শাখায় বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি সেগুলোকে আরো বর্ণিল করেছে।
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, বিখ্যাত চরিত্র ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় ‘সমগ্র শিশুসাহিত্য সুকুমার রায়’ বইয়ের মুখবন্ধের শেষ লাইনগুলোতে যা লিখেছেন, সেই বাক্যগুলো ছাড়া এই রচনার ইতি টানা সহজ হবে না। সেখানে তিনি লিখেছেন—সুকুমার রায়ের কোনো রচনাই তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণাঙ্গ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নি। আবোল তাবোল প্রথম প্রকাশের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৩। অর্থাৎ সুকুমারের মৃত্যুর ঠিক নয় দিন পরে। ছাপা বই দেখে না গেলেও, তার তিনরঙা মলাট, তার অঙ্গসজ্জা, পাদপূরক দু-চার লাইনের কিছু ছড়া, টেলপিসের ছবি ইত্যাদি সবই তিনি করে গিয়েছিলেন শয্যাশায়ী অবস্থায়। তাঁর শেষ রচনা ছিল আবোল তাবোলের শেষ কবিতা, যার বিচিত্র মিশ্র রস বাংলা সাহিত্যে চির-কালের বিস্ময়ের বস্তু হয়ে থাকবে। এটি রচনার সময় যে তাঁর উপর মৃত্যুর ছায়া পড়েছিল তার ইঙ্গিত এর শেষ কয়েক ছত্রে আছে—
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম
গানের পালা সাঙ্গ মোর
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোনো রসস্রষ্টার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
একটি অন্ধ ভিখারি রোজ মন্দিরে পূজা করতে যায়। প্রতিদিন ভক্তিভরে পূজা শেষ করে মন্দিরের দরজায় প্রণাম করে সে ফিরে আসে; মন্দিরের পুরোহিত সেটা ভাল করে লক্ষ্য করে দেখেন। এইভাবে কত বৎসর কেটে গেছে কেউ জানে না। একদিন পুরোহিত ভিখারিকে ডেকে বললেন, “দেখ হে! দেবতা তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। তুমি কোন একটা বর চাও। কিন্তু, মনে রেখো, একটিমাত্র বর পাবে।” ভিখারি বেচারা বড় মুস্কিলে পড়ল। কি যে চাইবে, কিছুতেই আর ঠিক করতে পারে না। একবার ভাবল, দৃষ্টি ফিরে চাইবে; আবার ভাবল, টাকাকড়ি চাইবে; আবার ভাবল, আত্মীয়স্বজন ছেলেপিলের দীর্ঘ জীবন এইসব চাইবে, কিছুতেই আর ঠিক করতে পারে না। তখন সে বলল, “আচ্ছা, আমি কাল ভাল করে ভেবে এসে বর চাইব। এখন কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না, কি চাই।” অনেক ভেবেচিন্তে সে মনে মনে একটা ঠিক করে নিল। তারপর মন্দিরে গিয়ে পুরোহিতকে বলল, “পরতে ঠাকুর! আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছি: আপনি আমার বড় উপকার করলেন। যে একটি বরের কথা বলেছেন সেটি এখন আমি চাইব মনে রাখবেন, একটিমাত্র বর আমি চাচ্ছি। আমি এই বর চাই যে মরবার আগে যেন আমার নাতিকে ছয়তলা বাড়ির মধ্যে বসে সোনার থালায় পায়স খেতে স্বচক্ষে দেখে যেতে পারি।” এই এক বরে ভিখারি চোখের দৃষ্টি ফিরে পেল, ধনজন পেল, ছেলেপিলে, নাতি-নাতনি পেল, দীর্ঘজীবন।—‘একটি বর’ শিরোনামের গল্পটি সুকুমার রায়ের। একটানে পড়ে ফেলার মতো এমন গল্পই তিনি বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়েছেন। টানটান আবেশের এসব গল্পে আনন্দের পাশাপাশি বুদ্ধির খেলা পাঠকের আগ্রহ উস্কে দেয় এখনো।
তেমনিভাবে উপদেশ শুনতে কারোরই ভাল লাগার কথা না, বিশেষ করে শিশুদের। কিন্তু সুকুমার রায় যদি উপদেশ দেন তবে সেই উপদেশ শুনতেই হয়! সুকুমার রায় গল্প-ছড়া-নাটক-প্রবন্ধে শিশুদের এমন কতকিছুই শিখিয়েছেন। কঠিন উপদেশের বাইরে এসে গল্প-কবিতার ছলে শিখিয়েছেন উচিত-অনুচিত। পেনসিল কামড়ানো কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ করে নেমে জুতা ছিঁড়ে ফেলা একদম ভালো কাজ নয়—এ উপদেশ দিতে গিয়ে ‘যতীনের জুতো’ নামক একটি গল্পই সুকুমার রায় লিখে ফেলেছেন। গল্পটির কিয়দংশ এমন—যতীন দেখল সে কোন অচেনা দেশে এসে পড়েছে। সেখানে চারদিকে অনেক মুচি বসে আছে। তারা যতীনকে দেখে কাছে এল, তারপর তার পা থেকে ছেঁড়া চটিজোড়া খুলে নিয়ে সেগুলোকে যত্ন করে ঝাড়তে লাগল। তাদের মধ্যে একজন মাতব্বর গোছের, সে যতীনকে বলল, “তুমি দেখছি ভারি দুষ্টু। জুতোজোড়ার এমন দশা করেছ? দেখ দেখি, আর একটু হলে বেচারিদের প্রাণ বেরিয়ে যেত।” যতীনের ততক্ষণে একটু সাহস হয়েছে। সে বলল, “জুতোর আবার প্রাণ থাকে নাকি?” মুচিরা বলল, “তা না তো কি? তোমরা বুঝি মনে কর, তোমরা যখন জুতো পায়ে দিয়ে জোরে ছোটো তখন ওদের লাগে না? খুব লাগে। লাগে বলেই তো ওরা মচ্মচ্ করে। যখন তুমি চটি পায়ে দিয়ে দুড়্দুড়্ করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছিলে আর তোমার পায়ের চাপে ওর পাশ কেটে গিয়েছিল, তখন কি ওর লাগেনি? খুব লেগেছিল। সেইজন্যেই ও তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। যত রাজ্যের ছেলেদের জিনিসপত্রের ভার আমাদের উপর। তারা সে সবের অযত্ন করলে আমরা তাদের শিক্ষা দেই।” মুচি যতীনের হাতে ছেঁড়া চটি দিয়ে বলল, “নাও, সেলাই কর।” যতীন রেগে বলল, “আমি জুতো সেলাই করি না, মুচিরা করে।” মুচি একটু হেসে বলল, “একি তোমাদের দেশ পেয়েছ যে করব না বললেই হল? এই ছুঁচ সুতো নাও, সেলাই কর।” যতীনের রাগ তখন কমে এসেছে, তার মনে ভয় হয়েছে। সে বলল, “আমি জুতো সেলাই করতে জানি না।” মুচি বলল, “আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, সেলাই তোমাকে করতেই হবে।” যতীন ভয়ে ভয়ে জুতো সেলাই করতে বসল। তার হাতে ছুঁচ ফুটে গেল, ঘাড় নিচু করে থেকে থেকে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল, অনেক কষ্টে সারাদিনে একপাটি চটি সেলাই হল। তখন সে মুচিকে বলল, “কাল অন্যটা করব। এখন ক্ষিদে পেয়েছে।” মুচি বলল, “সে কি! সব কাজ শেষ না করে তুমি খেতেও পাবে না, ঘুমোতেও পাবে না। একপাটি চটি এখনও বাকি আছে। তারপর তোমাকে আস্তে আস্তে চলতে শিখতে হবে, যেন আর কোনো জুতোর উপর অত্যাচার না কর। তারপর দরজীর কাছে গিয়ে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে হবে। তারপর আর কি কি জিনিস নষ্ট কর দেখা যাবে।”...এভাবেই স্বভাবসুলভ টানটান ভঙ্গিতে গল্পটি এগিয়ে যায় আর যতীনও বুঝতে পারে কোনো কাজ সহজ নয়। অবহেলা করে কোনো জিনিসই নষ্ট করা ঠিক নয়। এরপর সে আর পেনসিল কামড়ায় না, জুতোও ছিঁড়ে না। কোমল শিশু মননে এত সুন্দরভাবে শুভচিন্তা গেঁথে দেওয়ার কাজটি সুকুমার রায়ই বাংলা সাহিত্যে সংযুক্ত করেছেন।
সুকুমার রায়ের গল্প নিয়ে তো কিছু কথা হলো। ছড়াকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান অবধারিতভাবে শীর্ষে। সকলের প্রিয় ছড়াকারই শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যে ননসেন্সের প্রবর্তকও তিনি। ব্রিটিশ সাহিত্যিক এডওয়ার্ড লিয়রের লেখা ‘বুক অব ননসেন্স’-এর হাত ধরেই বিশ্বের শিশুরা সাহিত্যে পেয়েছিল এক অদ্ভুত দেশের খোঁজ। ননসেন্সকে জনপ্রিয় করার পেছনে আরও একটি নাম-লুই ক্যারল। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ নামের যে উদ্ভট উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তা আজও সবার কাছে জনপ্রিয়। নানা কমিকস, কার্টুন আর সিনেমার কল্যাণে এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ইংরেজিতে যেমন ক্যারল অথবা এডওয়ার্ড লিয়র তেমনই বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়। তিনি বাংলা ননসেন্স সাহিত্যের সম্রাট। সুকুমার তাঁর ননসেন্স ও উদ্ভট ধরনের রচনায় এডওয়ার্ড লিয়রের ‘বুক অব ননসেন্স’, লুইস ক্যারলের ‘অ্যালিস ঐ দ্য লুকিং গ্লাস’ কিংবা ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ প্রভৃতি লেখার দ্বারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছেন, আবার হয়ত রয়েছে চ্যাপলিনের খামখেয়ালিপনার প্রভাবও। কিন্তু তাঁর লেখা ও আঁকায় যেন তাঁর সৃষ্ট উদ্ভট চরিত্র ও ছবিগুলি অনেক বেশি সরস ও গতিশীল। এ প্রসঙ্গে সুকুমার রায়ের একমাত্র সন্তান আরেক কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় বলেন—আসলে, যে-কথা আগেই বলেছি, সুকুমারের ননসেন্সের অনেকখানি সুকুমারেরই সৃষ্টি। প্রভাবের কথাই যদি বলতে হয় তাহলে শুধু বাংলার ট্র্যাডিশনের কথা বললে চলে না, বিদেশী সাহিত্য, পান্টোমাইম, চার্লি চ্যাপলিন, বিলিতি কমিকস (মার্কিন কমিক পুস্তকের ক্যাটজেন-জ্যামার কিস যে মোমবাতি-চোষা ডানপিটে ছেলের প্রেরণার উৎস সেটা আবোল তাবোলের ছবি দেখলেই বোঝা যায়)–এসবই সুকুমারের ননসেন্সের পুষ্টি সাধন করেছে। ননসেন্সের রসগ্রহণ বাঙালি পাঠক করতে পারবে কি না সে সম্বন্ধে সুকুমারের সংশয় ছিল; তাই এ জাতীয় আবোল তাবোলের ভূমিকায় তাঁকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল—ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে রবীন্দ্রনাথও তাঁর শেষ বয়সের উদ্ভট ছড়ার সংকলন ’খাপছাড়া’-তে এই ধরনের একটা কৈফিয়তের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন।
তবে, শুধু ননসেন্স নয়, সুকুমার তাঁর সাহিত্যে ছোটদের জন্য এমন এক বিচিত্র জগৎ গড়ে গেছেন, যার আনন্দ থেকে শিশুদের বঞ্চিত করা উচিত নয়। সুকুমার রায় তাঁর ছড়া-নাটক-গল্পে প্রাণী অথবা পৌরাণিক প্রাণীর ব্যবহার করেছেন। নিজের কল্পনাজগতের উদ্ভট প্রাণিকুলের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করান তার লেখায়-আঁকায়। সুকুমারের এমন অনন্য আবিষ্কার তাঁর লেখাকে আকর্ষণীয় ও রসময় করে তোলে। যেমন তিনি লিখেছেন—
হলদে সবুজে ওরাং ওটাং
ইট পাটকেল চিৎ পটাং
গন্ধ গোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি
নন্দী ভৃঙ্গী সারেগামা
নেই মামা তাই কানা মামা
চিনে বাদাম সর্দি কাশি
ব্লটিং পেপার বাঘের মাসি
মুশকিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।
এমন ননসেন্সময় বক্তব্য বড় গভীর। গভীরে যেতে যেতে পাঠক জিনিয়াস হয়ে ওঠেন নিশ্চয়ই! আলোচিত এমন সব উদ্ভট বিষয় নিয়ে সুকুমার রায় প্রণীত আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি, খাই‐খাই, অবাক জলপান, লক্ষণের শক্তিশেল, ঝালাপালা ও অনান্য নাটক, হ য ব র ল, শব্দ কল্প দ্রুম, বহুরূপী, ভাষার অতাচার ইত্যাদি গ্রন্থ বাংলা শিশুসাহিত্যের অমর সৃষ্টি।
বাংলাসাহিত্যে সুকুমার রায়ের তুলনা কেবল সুকুমার রায়ই। সন্দেশ পত্রিকায় তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা প্রকাশ পেত। ছোটদের উপযোগী করে সহজভাবে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন সেসব লেখায়। সুকুমার অনায়াসে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে শিশুদের জন্য রসপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতেন। বিজ্ঞান বিষয়ে সন্দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘বেগের কথা’। সহজভাবে ছোটদের তিনি ‘বেগ’ সম্বন্ধে বুঝিয়েছেন এভাবে—যে লোক সৌখিন, সামান্য কষ্টেই কাতর হইয়া পড়ে তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলা হয় ‘ফুলের ঘায় মূর্ছা যায়।’ রঘুবংশে আছে যে দশরথের মা ইন্দুমতী সত্যসত্যই ফুলের ঘায়ে কেবল মূর্ছা নয়, একেবারে মারাই গিয়াছিলেন। ইন্দ্রের পারিজাতমালা আকাশ হইতে তাঁহার গায়ে পড়ায় তাঁহার মৃত্যু হয়। প্রথম যখন এই বর্ণনাটা শুনিয়াছিলাম তখন ইহাকে অসম্ভব কল্পনা বলিয়া বোধ হইয়াছিল; কিন্তু এখন ভাবিয়া দেখিতেছি ইহা নিতান্ত অসম্ভব কিছু নয়। তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্রমাসের তাল যদি ধুপ্ করিয়া পিঠে পড়ে তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারাগাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উঁচু হইতে পড়িতে থাকে তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে। যে হাড়ের টুকরাটি দোতলা হইতে একতলায় মানুষের মাথায় পড়িলে বিশেষ কোনই অনিষ্ট হয় না—সেইটিই যখন চিলের মুখ হইতে পড়িতে পড়িতে অনেক নীচে প্রবল বেগে আসিয়া নামে তখন তাহার আঘাতে মানুষ রীতিমত জখম হইতে পারে। ফুলের মালাটিকেও যদি যথেষ্ট উঁচু হইতে ফেলিয়া দেওয়া যায় তবে তাহার আঘাতটি যে একেবারেই মোলায়েম হইবে না, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।
অল্পদিনের লেখালেখির জীবনে সুকুমার রায় পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, দেশ-বিদেশের উপকথার চরিত্র ইত্যাদি বিষয়েও অমূল্য সব রচনা লিখে গিয়েছেন। সুকুমারই ‘পাগলা দাশু’র মতো নতুন ধারণার স্কুল স্টোরি লিখেছেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তিনি ডুবো জাহাজ তথা সাবমেরিনের মতো বিষয় নিয়ে চমকপ্রদ লেখা শিশুদের জন্য উপহার দিয়েছেন। ভূমিকম্প, নীহারিকা, আলোর গতি ইত্যাদি বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা তাঁর হাতে দুর্দান্ত হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সুকুমার রায় একজন প্রকৃতিপ্রেমিক লেখক ছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎও ছিল তাঁর চিন্তার জগতে। তেমনি একটি লেখা ‘কাঠের কথা’। সেই লেখায় তিনি পৃথিবী একদিন বৃক্ষশূন্য হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘কেউ কেউ হয়ত বলবে, “দূর ছাই! কাঠের কথা আবার শুনব কি? ভারি ত জিনিস, তাই নিয়ে আবার কথা!” তা বলতে পার কিন্তু কাঠ যে মানুষের কাজের পক্ষে কত বড় দরকারী জিনিস, তা একবার ভেবে দেখেছ কি? এখন না হয় সভ্য মানুষে কয়লা, কেরোসিন, গ্যাস বা ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যবহার শিখেছে; কিন্তু তার আগে ত জ্বালানি কাঠ না হলে মানুষের রান্নাবান্না কলকারখানা কিচ্ছুই চলত না, শীতের দেশে মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হত। এই ত কিছুকাল আগেও কাঠের জাহাজ না হলে মানুষে সমুদ্রে যেতে পারত না, কাঠের কড়ি বরগা থাম না হলে তার ঘর বাড়ি তৈরি হত না। বলতে পার, এখন ত এ সবের জন্য কাঠের ব্যবহার কমে আসছে তা সত্যি! এমনকি, ঘরের দরজা-জানালা আসবাবপত্র পর্যন্ত যে ক্রমে কাঠের বদলে অন্য জিনিস দিয়ে তৈরি হতে থাকবে তাতেও কোন সন্দেহ নাই। আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই হয়ত দেখবে, ঘরে ঘরে নানারকম ঢালাই-করা মেটে পাথরের আসবাবপত্র! কিন্তু তবুও দেখা যায় যে খুব ‘সভ্য’ জাতিদের মধ্যেও কাঠের ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলছে, কমবার লক্ষণ একটাও দেখা যায় না। প্রতি বৎসরে এত কোটি মণ কাঠ মানুষে খরচ করে এবং তার জন্য এত অসংখ্য গাছ কাটতে হয় যে অনেকে আশঙ্কা করেন, হয়ত বেহিসাবী যথেচ্ছ গাছ কাটতে কাটতে কোন দিন পৃথিবীতে কাঠের দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হবে! এরকম যে সত্যি সত্যিই হতে পারে, তার প্রমাণ নানা দেশে পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকার যুক্তরাজ্যে এক সময়ে এমন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বন ছিল আর তাতে এত অসংখ্য গাছ ছিল যে লোকে বলত এ দেশের কাঠ অফুরন্ত—এরা সমস্ত পৃথিবীময় কাঠ চালান দিয়েও কোনদিন এত গাছ কেটে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু সে দেশের লোকে এমন বে-আন্দাজভাবে এর মধ্যে বন জঙ্গল সব কেটে প্রায় উজাড় করে ফেলেছে যে এখন তারা নিজেরাই অন্য দেশ থেকে কাঠ আমদানী করতে বাধ্য হচ্ছে।’
রসসম্রাট সুকুমার রায়ের চিরাচরিত রসের মধ্যেও ব্রিটিশবিরোধিতার ছাপ পাওয়া যায়। এমন একটি লেখা হলো ‘একুশের আইন’। সেখানে তিনি লিখেছেন—
শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
একুশ টাকা দণ্ড তার।।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে
হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে
দম্দমাদম্ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে—
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।।
এই পদ্যেই তিনি আরও লেখেন—
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা—
হিসেব কষায় একুশ পাতা।।
সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা শিশুসাহিত্যের বরপুত্র। সুকুমার-পূর্ব যুগে হরিনাথ মজুমদার, সর্বানন্দ রায়, মুনশী নামদার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদন মোহন দত্ত, অক্ষয় কুমার দত্ত, মদন মোহন তর্কালঙ্কার, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রমুখের হাত ধরে বাংলা শিশুসাহিত্যের পথচলা এগিয়েছিল। সেই গতিকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তায় সুকুমার সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই বাংলা শিশুসাহিত্য এগিয়ে চলছে বিগত এক শতাব্দী ধরে। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সুকুমারের প্রায় সমসাময়িক। সুকুমার সময়ের চাইতে আধুনিক ছিলেন। গত এক শ বছর বাংলা শিশুসাহিত্য নতুন নতুন শাখায় বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি সেগুলোকে আরো বর্ণিল করেছে।
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, বিখ্যাত চরিত্র ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় ‘সমগ্র শিশুসাহিত্য সুকুমার রায়’ বইয়ের মুখবন্ধের শেষ লাইনগুলোতে যা লিখেছেন, সেই বাক্যগুলো ছাড়া এই রচনার ইতি টানা সহজ হবে না। সেখানে তিনি লিখেছেন—সুকুমার রায়ের কোনো রচনাই তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণাঙ্গ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নি। আবোল তাবোল প্রথম প্রকাশের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৩। অর্থাৎ সুকুমারের মৃত্যুর ঠিক নয় দিন পরে। ছাপা বই দেখে না গেলেও, তার তিনরঙা মলাট, তার অঙ্গসজ্জা, পাদপূরক দু-চার লাইনের কিছু ছড়া, টেলপিসের ছবি ইত্যাদি সবই তিনি করে গিয়েছিলেন শয্যাশায়ী অবস্থায়। তাঁর শেষ রচনা ছিল আবোল তাবোলের শেষ কবিতা, যার বিচিত্র মিশ্র রস বাংলা সাহিত্যে চির-কালের বিস্ময়ের বস্তু হয়ে থাকবে। এটি রচনার সময় যে তাঁর উপর মৃত্যুর ছায়া পড়েছিল তার ইঙ্গিত এর শেষ কয়েক ছত্রে আছে—
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম
গানের পালা সাঙ্গ মোর
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোনো রসস্রষ্টার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
হিমালয় পাই এর নতুন বই’ ডিটাচমেন্ট টু ডিপার্চার’ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি বাজারে এনেছে জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থা আদর্শ প্রকাশনী। বইটিতে মূলত উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহর পরিভ্রমণের প্রেক্ষিতে লেখকের সোশিওলজিকাল, পলিটিক্যাল কালচারাল, হিস্টরিকাল, এনথ্রোপলজিকাল যেসব পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়েছে সেগুলোকেই সোশ্যাল থিসিসরূ
১৩ দিন আগে‘স্বাধীনতা সাম্য সম্প্রীতির জন্য কবিতা’ স্লোগান নিয়ে শুরু হচ্ছে জাতীয় কবিতা উৎসব ২০২৫। আগামী ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কবিতার এই আসর। আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এটি জানানো হয়েছে...
২০ দিন আগেবাংলা একাডেমি ২০২৪ সালের ষাণ্মাসিক ফেলোশিপ এবং ছয়টি পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং ভাষা গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ফেলোশিপ পাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, নাটক এবং কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য মোট ছয়টি পুরস্কার দেওয়া হচ্
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪সূক্ষ্মচিন্তার খসড়াকে ধারণ করে শিল্প-সাহিত্য ভিত্তিক ছোটকাগজ ‘বামিহাল’। বগুড়ার সবুজ শ্যামল মায়াময় ‘বামিহাল’ গ্রামের নাম থেকেই এর নাম। ‘বামিহাল’ বিশ্বাস করে বাংলার আবহমান জীবন, মানুষ-প্রকৃতি কিংবা সুচিন্তার বিশ্বমুখী সূক্ষ্ম ভাবনার প্রকাশই আগামীর সবুজ-শ্যামল মানববসতি বিনির্মাণ করতে পারে...
২১ ডিসেম্বর ২০২৪