‘কাল সারা দিন আমি আর আম্মা কিছুই খাইনি’

রিমন রহমান, রাজশাহী
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৮: ৩৯
Thumbnail image

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা হারান তৃতীয় লিঙ্গের রোকন। তারপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আর পাঁচজনের মতো রোকন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। রাজশাহী বাস টার্মিনালের সামনে বাবার রেখে যাওয়া ছোট্ট টিনের দোকানটি চালিয়েই মা শেফালি বেগম আর নিজের পেট চালাতেন। এখন আর দোকানটি চলে না। আয়-রোজগার না থাকায় চলছে না মা-ছেলের পেটও।

গতকাল সোমবার দুপুরে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন রোকন। তাঁর সঙ্গে কথা হয় নগরের অলোকার মোড়ে। তিনি বলেন, ‘দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একটা কাজের জন্য ঘুরছি। কিন্তু কাজ পাচ্ছি না। কাজ না থাকায় বাড়িতে খাবার জুটছে না। গতকাল (রোববার) আমি আর আম্মা কিছুই খাইনি।’ এ কথা বলতেই দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে রোকনের।

রোকন বলেন, তাঁর বাড়ি নগরের বালিয়াপুকুরে। বাড়িতে তাঁর বড় ও ছোট দুই ভাই আছেন। তাঁরা স্ত্রীদের নিয়ে আলাদা হয়েছেন। মায়ের দায়িত্ব নিয়েছেন রোকনই। এক বছর আগে বাবা মো. কালু মারা যান। শিরোইলে বাস টার্মিনালের সামনে রেখে যান ছোট্ট একটা টিনের ঘর। সেই দোকানের হাল ধরে সংসারের দায়িত্ব নেন ১৮ বছরের রোকন।

বছরখানেক ভালোই চলেছে। চা-সিগারেট বিক্রি করে দিনে ৫০০-৭০০ টাকা রোজগার করেছেন। গত জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হলে দোকানে মানুষের আড্ডা থেমে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার এলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে সন্ধ্যার পর দোকানে ক্রেতা একেবারেই কমে যায়। ৫ হাজার টাকা ঋণ ছিল রোকনের। পাওনাদারের চাপে সেই ঋণ পরিশোধ করেন। এখন দোকান চালানোর কোনো মূলধন নেই। দোকান বন্ধ রেখে অন্য কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি।

রোকন জানান, দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ও তাঁর মা শেফালি পাড়ার একটি মাঠের কলমি শাক তুলে বিক্রি করেছেন। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকার শাক বিক্রি করতে পেরেছেন। সে টাকায় কয়েক দিন চলেছে তাঁদের। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে ওই মাঠের সব শাক শেষ হয়ে যায়। এরপর পাড়ার একটি চটপটির দোকানে কাজ নেন রোকন। রোজ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে পেতেন ১০০ টাকা। কয়েক দিন এই কাজের পর চটপটির দোকানদার জানিয়ে দেন, তাঁরও ব্যবসার অবস্থা ভালো না। রোকনের আর কাজে আসা লাগবে না।

রোকন আরও বলেন, ‘আগে আমার দোকানে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হতো। আমি আর আম্মা সুখেই ছিলাম। মারামারির পর থেকে দোকানটা শেষ হয়ে গেল। লোকজন কমে গেল। লাভ কমে গেল। এখন এক পয়সা আয় নাই। একটা কাজের জন্য কয়েকটা হোটেলে ঘুরলাম। তৃতীয় লিঙ্গ বলে কেউ কাজে নিল না। কেউ বলল, ব্যবসার অবস্থা খারাপ। লোক লাগবে না। কেউ বলল, হিজড়াদের কাজ দেওয়া যাবে না। আমি তো ভাই শাড়ি-চুড়ি পরে টাকা তুলে বেড়াচ্ছি না। কাজ করে খেতে চাই। কিন্তু কেউ কাজ দিচ্ছে না।’

সামর্থ্য থাকলে দোকানটি আবার চালু করতেন জানিয়ে রোকন বলেন, ‘দোকান চালু করতে গেলে ক্যাশ লাগবে। সেই টাকা আমার নাই। টাকা নাই বলে চাল-তরকারি কিনতে পারিনি। কাল সারা দিন আমি আর আম্মা কিছুই খায়নি। আজ আটার ব্যবস্থা হয়েছে। সকালে রুটি খেয়েছি। সারা দিন আজ রুটিই খাব।’ এ সময় রোকনের দুই চোখ ভিজে যায়। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মোছেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত