‘অনবরত গুলি হচ্ছে, বাসায় গিয়ে কথা বলব’, মায়ের সঙ্গে ফয়েজের শেষ কথা

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ১৭: ০২

২১ জুলাই। ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা ৬ টা। ফোনের ওপাশ থেকে ছেলে ফয়েজ বলছেন, ‘মা অনবরত গুলি হচ্ছে। বাসায় গিয়ে পরে কথা বলব।’ এরপর গুলির শব্দ শোনা গেলেও ছেলের কণ্ঠ আর শোনা যায়নি। 

মো. ফয়েজ (৩১) লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে উত্তর চর আবাবিল ইউপির ঝাউডগী গ্রামের বাসিন্দা। এ গ্রামের আলাউদ্দিন ও সবুরা বেগম দম্পতির ছেলে তিনি। প্রায় ১২ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়েছিলেন ফয়েজ। সেই থেকেই স্যানিটারি মিস্ত্রির (পাইপ ফিটার) কাজ করতেন তিনি। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের খবর পেয়ে ছেলে ফয়েজকে কল দিয়েছিলেন মা সবুরা বেগম। 

ফয়েজের মা সবুরা বেগম জানান, ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় মোবাইলে ফোনে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় বিকট শব্দের একটি গুলির পর ছেলের সঙ্গে তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে ছেলে বলছিল, ‘‘মা অনবরত গুলি হচ্ছে। আমি কাজ শেষ করে বের হয়েছি। এখন ফোন রাখো। বাসায় গিয়ে পরে কথা বলব।’’ ছেলের সঙ্গে সে দিনের ফোনে কথা বলা আর অতীতের নানা স্মৃতি নিয়ে বিলাপ করে কেঁদেই চলছেন বৃদ্ধা সবুরা বেগম। 

আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে হাসপাতালে নিয়েছিলেন তাঁর পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম। 

ছেলের সঙ্গে মো. ফয়েজ। ছবি: সংগৃহীতমোবাইল ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মো. কাশেম বলেন, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তিনি আহত মো. ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি মাথায় ও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হন বলে চিকিৎসক তাঁকে জানিয়েছেন। ময়নাতদন্ত শেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁর লাশ রায়পুরের ঝাউডগি গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। 

তিনি আরও জানান, ফয়েজ তাঁর সঙ্গে দুই বছর ধরে কাজ করছিলেন। দিনে ৭০০ টাকা মজুরি পেতেন। সামান্য এই আয় দিয়ে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ২১ জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সাইনবোর্ড এলাকার একটি ভবনে কাজ শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। 

অপরদিকে ছেলেকে হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন বাবা বৃদ্ধ আলাউদ্দিন। দুচোখে তিনি কেবলই অন্ধকার দেখছেন। কী হবে তাঁর বিধবা পুত্রবধূ ও শিশু নাতির। কে জোগাড় করে দিবে তাদের মুখের আহার। এসব ভাবতে ভাবতে দিন কাটে তাঁর। আর দুচোখ বেয়ে ঝরে চলছে জল। 

স্বামী ফয়েজের মৃত্যুর পর নুরনাহার ও তাঁর ১৮ মাস বয়সী ছেলে রাফি মাহমুদের ঠাঁই মিলেছে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। 

মোবাইল ফোনে কথা হলে কেঁদে কেঁদে নুর নাহার বলেন, ‘স্বামী আমার আশ্রয়, সম্বল সবকিছু ছিল। তাকে গুলি করে মারল। কোন দোষে মারল তাকে, কে এই জবাব দেবে? কার কাছে এই নির্মম হত্যার বিচার চাইব।’ 

আজ বৃহস্পতিবার সকালে ফয়েজের বাড়িতে দেখা যায়, বাড়ির পাশেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ফয়েজকে। সেখানে কবর দেখতে আসছেন স্বজনরা। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন আর দোয়া করে চলে যাচ্ছেন। 

ঘটনার ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও কান্না থামেনি ফয়েজের মা সবুরা বেগমের। আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, ‘গুলি করে আমার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে। ছেলে তো আর ফিরে আসবে না। ওর অসহায় বউ আর ছেলেকে কে দেখবে?’  

ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুটি গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল। ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে বিচার চাইব? আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে আমি চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে ছেলেকে হারালাম। আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’ 

রায়পুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সামছুল আরেফিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্যানিটারি মিস্ত্রি ফয়েজ নামের এক ব্যক্তি ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে বলে শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত