বনে কুড়িয়ে পাওয়া শুকনো কাঠ বিক্রি করে সংসার চলে তাদের

হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২২, ২০: ০৪
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২২, ১৩: ০৭

কোমলমতি শিশুদের ২৫-৩০ জনের একটি দল। সবার মাথায় আড়ি বাঁধা শুকনো কাঠের বোঝা। পায়ে হাঁটু সমান কাদা মাটি লেগে রয়েছে। কেউ কেউ বোঝার ভারে নুয়ে পড়ছে। তীব্র রোদে বন থেকে শুকনো কাঠের সেই বোঝা মাথায় নিয়ে সাঁকো পার হতে দেখা যায় সবাইকে। বনের পাশে খোলা জায়গায় একটু ক্লান্তি দুর করতে মাথার বোঝা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়েছে সবাই। 

আলাপ হয় নোয়াখালী হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপের সেই শিশুদের সঙ্গে। তারা জানায়, সংসারের বাড়তি উপার্জনের জন্য বনের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে সবাই। তাদের মধ্যে একজন মো. রিটন (৮)। রিটনরে বাড়ি উপজেলার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ধানসিঁড়ি কিল্লার ওপর। 

রিটন জানায়, গত বছর তাঁর বাবা মো. ছায়েদের মৃত্যু হয়েছে প্রবাসে। পাঁচ ভাই-বোনের সংসারের দায়িত্ব পড়ে মায়ের ওপর। অধিকাংশ সময় অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হয় তাদের। প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় অনেকটা জোড়া তালি দিয়ে চলে তাদের সংসার। সংসারের সহযোগিতা করতে আট বছর বয়সে রিটন উপার্জনে নেমেছে। প্রতিদিন বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে ৫০-৬০ টাকা বিক্রি করে। দিন শেষে রিটনের উপার্জনের সেই টাকা মায়ের সংসার চালাতে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করে। 

রিটনের মতো নিঝুম দ্বীপের অনেক শিশু এখন বন বিভাগের লাগানো কেউড়া বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহের কাজ করে। কেউ সেই কাঠ বিক্রি করে প্রতি আঁটি ৬০-১০০ টাকা দরে। কেউ সংসারের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। দ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এসব শিশুরা ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর গ্রাম হয়ে যায় বনের মধ্যে। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বনের ভেতর থেকে খুঁজে আনেন শুকনো কাঠ। সবার হাতে থাকে দা ও আঁটি বাঁধা রশি। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় এসব শিশুদের সঙ্গে। 

বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে সেগুলো নিয়ে বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে চলছে হাতিয়ার কয়েকজন শিশুএদের অনেকের বয়স ১০-১২ এর মধ্যে। এর মধ্যে একজন ফিয়া বেগম (৭)। বড় বোন ঝুমুরের সঙ্গে সেও এসেছে বনের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করতে। মাথায় ছোট একটি আড়ি নিয়ে বন থেকে বের হওয়ার পর কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ভালোভাবে কথা বলতে পারে না সে। কাপা কাপা কণ্ঠে ফিয়া জানায়, শতকুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। এখন স্কুলে যায় না। বাবা জেলের কাজ করেন, জমিজমাও নেই। সংসারের প্রতিদিনের জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে বড় বোনের সঙ্গে তাকেও বনে যেতে হয়। বাড়ি ধানসিঁড়ি কিল্লার ওপর। বন থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে। কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি যেতে তিনবার পথে থামতে হয় তাকে। পথে তিনটি সাঁকো পার হতে হয়। সাঁকো পার হতে বড় বোন ঝুমুর তাকে সহযোগিতা করেন। 

স্বপন (১৫) নামে এক এজন জানায়, ধান কাটা মৌসুম থেকে শুরু করে ছেওয়া মাছ ধরা পর্যন্ত তিন মাস বনের এই শুকনো কাঠ সংগ্রহের এই কাজ করে তারা। এদের অনেকে স্কুল মাদ্রাসায় পড়া লেখা করলেও করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে এখন অনেকে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। 

স্বপন আরও জানায়, বনের কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বনরক্ষীদের রোষানলে পড়তে হয়। গত দুই মাস আগে একবার বনের মধ্য থেকে বনরক্ষীরা তাকে ধরে নিয়ে নামার বাজারে বেঁধে রাখে। পরে স্থানীয় অনেকের সুপারিশে তিন ঘণ্টা পার ছেড়ে দেওয়া হয়। 

এ ব্যাপারে নিঝুম দ্বীপ (চর ওসমান) বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা মাসুদ রায়হান জানান, বন থেকে শিশুরা মাঝে মধ্যে কিছু শুকনো কাঠ ব্যবহারের জন্য নিয়ে যায়। এ জন্য কোনো শিশুকে বেঁধে রাখা বা আটক করা হয়নি। তবে কেউ কাচা বড় গাছ কাটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। 

এ বিষয়ে নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আফছার দিনাজ বলেন, নিঝুম দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল। করোনা মহামারির কারণে অনেক দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। এ জন্য শিশুরা মাছ শিকার, কাঁকড়া ধরা ও বনের শুকনো কাঠ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উদ্যোগ নিয়েছি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মেরামত করে পুনরায় চালু করার জন্য। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত