দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়, এটা ‘নরহত্যা’ অথবা ‘হত্যা’

আশরাফ-উল-আলম
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২১, ০০: ০৫

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অর্ধ শতাধিক প্রাণহানি হয়েছেন। মালিকপক্ষ এটিকে দুর্ঘটনা বলেই দাবি করছে। আর এ ধরনের দুর্ঘটনায় ‘দায়িত্বে অবহেলা জনিত কারণে মৃত্যু’, এই অভিযোগে মামলা হয়ে থাকে। কিন্তু বেঁচে যাওয়া শ্রমিক ও স্থানীয়দের বর্ণনায় এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, রীতিমতো হত্যা। আইনজীবীরাও মনে করছেন, অভিযোগ সত্য হলে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের মালিক ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নরহত্যা বা খুনের মামলা হওয়া উচিত। 

বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, জুস ও পানীয় উৎপাদনকারী এই কারখানায় ছিল প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ও রাসায়নিক। এ ধরনের কারখানায় হঠাৎ আগুন লাগতে পারে। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক ব্যবস্থা থাকাটা বাধ্যতামূলক। থাকতে হয় শ্রমিকদের যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় শ্রমিক-কর্মচারীরা যাতে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন সেই ধরনের ব্যবস্থাও থাকতে হয়। হাশেম ফুডের সেই কারখানায় সে ধরনের ব্যবস্থা ছিল কি–না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

আগুন থেকে রেহাই পাওয়া শ্রমিকেরা গণমাধ্যমে বলেছেন, আগুন লাগার পর কারখানা থেকে অনেকেই বের হতে পারেননি। ভবনের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। 
অথচ কারখানা আইন, ১৯৬৫ এর ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের ৬২ ধারায় একটি কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে তা বলে দেওয়া হয়েছে। এই ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, কারখানা ভবনের প্রতিটার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অন্তত একটি বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমন ব্যবস্থা থাকতে হবে। উপধারা (৩)–এ বলা হয়েছে, বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকে রাখা যাবে না। বহির্গমনের পথ বাধাগ্রস্ত কিংবা পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না। উপধারা (৪)–এ বলা হয়েছে প্রত্যেক দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে। বহির্গমনের পথ লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। উপধারা (৬)–এ বলা হয়েছে শ্রমিকেরা যাতে সহজে বহির্গমনের পথে পৌঁছাতে পারে সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। উপধারা (৭) ও (৮)–এ বলা হয়েছে, শ্রমিকেরা অগ্নিকাণ্ডের সময় যাতে সহজে কারখানা ত্যাগ করতে পারে সেই প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং প্রতি ছয় মাসে একবার করে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া দিতে হবে। 

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরের সিটিজেন চার্টার কারখানা কীভাবে পরিচালিত হবে তার দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এই চার্টারেও বলা হয়েছে, কোনো কারখানায় কাজ চলাকালীন কারখানার বহির্গমন পথসহ সব দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে। কারখানার সব সিঁড়িপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও চলাচলে বাধামুক্ত রাখতে হবে। চার্টারে আরও বলা হয়েছে, বহুতল ভবনে স্থাপিত কারখানায় বিভিন্ন দুর্ঘটনা বিশেষ করে অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিকল্প বহির্গমন দরজার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতি কক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে। 

বিভিন্ন আইন ও বিধি অনুযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা যথেষ্ট ব্যবস্থা হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের এই কারখানায় ছিল কি–না তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অগ্নিকাণ্ডের পর ওই কারখানার বহির্গমনের যে পথ ছিল তা বন্ধ ছিল বলেই প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানি থেকে জানা যায়। বহির্গমনের পথ বন্ধ করা আইনের চোখে অপরাধ। 

এ ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ব্যাপারে আইনি যেসব ধারা রয়েছে তা দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারায় বর্ণিত অপরাধ। ৩০৪ এর (ক) ধারা হচ্ছে অবহেলা জনিত মৃত্যু অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি নরহত্যা বলে গণ্য নয়–এমন কোনো বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজ করে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, সে ব্যক্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। কারখানায় আগুন লেগে সাধারণভাবে যদি কেউ মারা যায় এবং এই আগুন লাগার পেছনে যদি অবহেলা থাকে তাহলে এই ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা যায়। 

আর ৩০৪ ধারা হচ্ছে অপরাধজনক নরহত্যা। খুন নয় এমন শাস্তিযোগ্য নরহত্যার সাজা হচ্ছে, যে ব্যক্তি খুন নয় এমন শাস্তিযোগ্য নরহত্যা করে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা দশ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং পাশাপাশি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে। 

অগ্নিকাণ্ডের এই দুর্ঘটনার ফলে এত মৃত্যু দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটেছে। দ্বিতীয়ত অগ্নিকাণ্ডে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে এমনটি জানা সত্ত্বেও যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকে, যদি বিকল্প বা বহির্গমন সিঁড়ি না থাকে তবে সেটা নরহত্যা বলেই বিবেচিত হবে। এটা ইচ্ছাকৃত খুন বা হত্যা নয়। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানার সিঁড়ি বা মূল ফটক তালাবদ্ধ করে দেওয়া–এটি নরহত্যার শামিল। আর ইচ্ছাকৃতভাবে তালা বন্ধ করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হত্যার শামিল। আর এই হত্যাকাণ্ডের দায় কারখানা মালিক বা কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না। এতগুলো শ্রমিককে আগুনে পুড়তে দেখেও কারখানার মূল গেটের তালা বন্ধ করে রাখা তেমন শাস্তির মুখোমুখি করানো দরকার দায়ী ব্যক্তিদের। এমনটাই বলছেন আইনজীবীরা। 

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ফৌজদারি আইনজীবী ও ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের সাবেক পিপি এহসানুল হক সমাজী আজকের পত্রিকাকে বলেন, সাধারণ চোখে অগ্নিকাণ্ড একটি দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি হলে দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় দায়িত্বে অবহেলা জনিত মৃত্যুর দায় কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। আর যদি আইন ও বিধান অনুযায়ী কারখানার দরজা-জানালা খোলা না রেখে বরং অগ্নিকাণ্ডের পর মূল ফটক বন্ধ করে দেয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং উদ্ধারকর্মীদের বক্তব্য অনুযায়ী প্রমাণ হয় তাহলে নরহত্যা (কালপ্যাবল হোমিসাইড) বলে বিবেচিত হবে। আইনজীবী সমাজী বলেন, দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা সে ক্ষেত্রে মামলায় যুক্ত হবে। অবশ্য কোন ধারায় বিচারে সোপর্দ করা হবে তা নির্ভর করে তদন্তের ওপর। 

সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, আগুন লাগার পর কারখানার মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। এটি একটি হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, যারা ফটকে তালা মেরেছেন তাঁরা এটা জানেন যে ভেতরে শ্রমিকেরা কর্মরত। তালা বন্ধ করা মানে ওই সব শ্রমিককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে এটা অবশ্যই হত্যাকাণ্ড। এই কারখানায় আগুন লাগার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তা হচ্ছে দায়িত্বে অবহেলা, কারখানার ভেতরে অগ্নিকাণ্ডের ফলে মানুষের মৃত্যু হবে জেনেও ফটক তালাবদ্ধ করে রাখা। যেটা নরহত্যা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কারও নির্দেশে তালা বন্ধ করে দেয় তাহলে সেটা হবে হত্যাকাণ্ড। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত