Ajker Patrika

১০ মাসে দুই লঞ্চ দুর্ঘটনা, মুন্সিগঞ্জের ৫২ জনের মৃত্যু  

প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ
১০ মাসে দুই লঞ্চ দুর্ঘটনা, মুন্সিগঞ্জের ৫২ জনের মৃত্যু  

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জের ১৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এর আগে গত বছরের ২৯ জুন বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিংবার্ড লঞ্চ দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গত ১০ মাসে দু’টি পৃথক লঞ্চ দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ৫২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে ফিটনেস বিহীন ছোট লঞ্চ চলাচল এবং নৌপথের ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা নদীতে সিমেন্ট কোম্পানির অসংখ্য জাহাজ যত্রতত্র রাখায় আবারও দুর্ঘটনার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা বলেন, মুন্সিগঞ্জে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার কারণেই নিয়মিত এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কের ভোগান্তি এড়াতে নৌপথ ব্যবহার করে এই জেলার বেশিভাগ মানুষ। আর নৌপথ অনিরাপদ হওয়ায় বাড়ছে দুর্ঘটনা।

মুন্সিগঞ্জ নাগরিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক এডভোকেট সুজন হায়দার জনি বলেন, রাজধানী ঢাকার কাছের জেলা মুন্সিগঞ্জ। দেশের সর্বোচ্চ আসন রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এই জেলার মানুষ। কিন্তু এই জেলার জনগণের ভাগ্য স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পরিবর্তন হয়নি। নৌপথে নারায়ণগঞ্জ হয়ে অথবা মিরকাদিম লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে সরাসরি ঢাকা যেতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তির শেষ নেই। এই দুই নৌপথও এখন সিন্ডিকেটের দখলে। একটি প্রভাবশালী লঞ্চ মালিক সিন্ডিকেট  দীর্ঘদিনের পুরনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলো দিয়ে এই পথে যাত্রী পারাপার করছে।

সুজন হায়দার আরও বলেন, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার দুই পাশে নদী দখল করে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। শিল্প মালিকরা এই নদীগুলোকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করছেন। নদী দখল করে শত শত পণ্যবাহী জাহাজ নির্বিঘ্নে নোঙর করে রাখা হয় মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে। এ কারণে নদীপথ সরু হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটে দুর্ঘটনা। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, নেতা থাকার  পরেও আমাদের জেলা অভিভাবক শূন্য হয়ে আছে।

মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটের ইজারাদার দীল মোহাম্মদ কোম্পানি বলেন, মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করে।  এরমধ্যে ২৩টি লঞ্চ ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্যের। মাত্র দুইটি লঞ্চ ৬০ ফুটের উপরে। লঞ্চগুলো দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। লঞ্চের আকার ছোট হওয়ার কারণে  প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। লঞ্চগুলো আকার বড় করার জন্য বিআইডব্লিটিএকে বারবার বলা হচ্ছে। তারপরও তারা  বড় লঞ্চের অনুমোদন দিচ্ছেন না। সেই সাথে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথের ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যার মোহনায় সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো তাদের জাহাজগুলো যত্রতত্র অবস্থায় রেখেছে। যার ফলে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চগুলো চলাচল করছে। এতে করে যেকোনো সময় আবারও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

এরআগে গত বছরের ২৯ জুন সকালে এম এল মর্নিংবার্ড নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। সে দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ৩৪ জনের প্রাণহানী ঘটে।

দুর্ঘটনার পর ৩০ জুন সদরঘাট নৌ-পুলিশের এসআই শামসুল আলম বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারী মাসে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এ মামলার এজাহারে দায়িত্বে অবহেলা ও বেপরোয়াভাবে মর্নিংবার্ড লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়ে প্রাণহানির জন্য ১৮৬০ সালের দ-বিধির ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এক বছরের মধ্যে বড় দুটি নৌ-দুর্ঘটনা মুন্সিগঞ্জের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া ফেলেছে। সামনের দিনগুলোতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়াও লঞ্চগুলোর আকৃতি বড় করতে বিআইডব্লিউটিকে বলা হয়েছে। পাশাপাশি যারা নদীর মধ্যে যত্রতত্র জাহাজ রেখে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্প্রতি দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে মুন্সিগঞ্জের ১৮ জন। দুর্ঘটনা কবলিত প্রতিটি পরিবারকে ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দাফন-কাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এ পরিবারগুলোর অন্য যে কোন ধরণের মানবিক সহযোগিতা মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।

উল্লেখ্য, গত রবিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সাবিত আল হাসান যাত্রীবাহী লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ যাচ্ছিল। লঞ্চটি মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি আসলে এসকে-৩ নামের একটি কার্গোর ধাক্কায় ডুবে যায়। এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৮ জনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৫ জন।

নিহতরা হলেন- মুন্সিগঞ্জ সদরের নড়াইতলীর মুকলেছ মিয়ার মেয়ে রুনা আক্তার (২৪), চৌদ্দামোড়ার সমুর আলীর ছেলে সোলেমান বেপারী (৬০) ও তার স্ত্রী বেবী বেগম (৬০), মালপাড়ার হারাধন সাহার ছেলে সুনিতা সাহা (৪০), মসুরার অলি উল্লাহর স্ত্রী পাকিজা (৪৫), উত্তর চর মসুরার আরিফ হোসেনের স্ত্রী বিথি (১৮) ও তার মেয়ে আরিফা (১), সদরের প্রীতিময় শর্মার স্ত্রী প্রতিমা শর্মা (৫৩), চর কিশোরগঞ্জ মোল্লাকান্দির ফাজিলার ছেলে শামসুদ্দিন (৯০), তার স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), দক্ষিণ কেওয়ারের দেবিন্দ্র দাসের ছেলের নারায়ণ দাস (৬৫), তার স্ত্রী পার্বতী রাণী দাস (৪৫), রিকাবিবাজারের শাহ আলম মৃধা (৫৫), রতনপাতার স্ত্রী মহারাণী (৩৭), শেয়াগাঁও পূর্বপাড়ার মিঠুন মিয়ার স্ত্রী ছাউদা আক্তার লতা (১৮), পূর্ব নয়াগাঁওয়ের দুখু মিয়ার মেয়ে সাদিয়া (১৮),  দক্ষিণ গাঁওয়ের দুলু মিয়ার মেয়ে জোলা বেগম (৩৪) ও মালপাড়ার বিকাশ সাহা (২২)।

এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন- মালপাড়ার হারাধন সাহার ছেলে আকাশ সাহা (১২), সিরাজদিখান তালতলার মুছা শেখের ছেলে জাকির হোসেন (৪৫), সদরের ইসলামপুরের নুরুল ইসলামের ছেলে তানভীর হোসেন, মালপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে রিজভী (২০), মধ্য কোডপাড়ার মতিউর রহমানের ছেলে ইউনুস কাজী।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত