‘আঁখির মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না সেন্ট্রাল হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা’

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ০০: ০১

চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু দায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল এড়াতে পারে না বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ বিএমডিসির নিবন্ধন নবায়ন না থাকার পরেও প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে চিকিৎসকদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। হাসপাতালের পাশাপাশি তিনজন চিকিৎসক এবং আঁখির স্বামী ইয়াকুবকেও মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে। 

গত ২ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে হাবিবা স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালের অবকাঠামো, জনবল, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো অসামঞ্জস্য রয়েছে কি না তা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বলা হয়েছে। 

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি এই তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এমনকি প্রতিবেদন গণমাধ্যমের হাতে আসায় বিষ্ময় প্রকাশ করেন। 

এদিকে তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম আরেকটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটিকে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে রাজধানীর গ্রীন রোডের সেন্ট্রাল হাসপতাল এবং ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে মাহবুবা রহমান আঁখির চিকিৎসায় আবহেলা জনিত অভিযোগ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে হাসপাতালের অবকাঠামো, জনবল, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো অসামঞ্জস্যও রয়েছে কিনা তা যথাযথভাবে যাচাই করতে বলা হয়েছে। 

উক্ত মৃত্যুর ঘটনায় গত ২১ জুন তারিখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (আইন অনুবিভাগ) আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ৪ জুলাই থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত সময়ে প্রয়াত মাহাবুবা রহমান আঁখির স্বামী, স্বামীর ভাই ও অভিযুক্ত চিকিৎসকগণ এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এ ছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। 

ঘটনার দিন ০৯.০৬. ২০২৩ তারিখ উল্লিখিত রোগী (আঁখি) সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসবেন এবং তার স্বামীর সঙ্গে ডা. সংযুক্তা সাহার ড্রাইভার কাম ম্যানেজার জমিরের কথা হয়। এ বিষয়ে অভিযোগে তার স্বামীর সঙ্গে সংযুক্তা সাহারও কথা হয়েছিল। ডা. সংযুক্তা সাহা রোগীনিকে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু তখন কেউই ডা. সংযুক্ত সাহা ওই দিন বিদেশে যাবেন এটা বলেননি অর্থাৎ তথ্যটি গোপন করেন। 

তদন্ত কমিটি তাদের মতামতে উল্লেখ করেছেন, প্রয়াত মাহাবুবা রহমান আঁখির চিকিৎসাজনিত ত্রুটির ক্ষেত্রে ডা. সংযুক্তা সাহার অনৈতিক কর্মকাণ্ড দায়ী। তিনি সংশ্লিষ্ট রোগী ও তার অভিভাবককে স্বাভাবিক প্রসবের পক্ষে অতিরঞ্জিত সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে প্রচারণামূলক ভিডিওর মাধ্যমে আকৃষ্ট করেছেন। 

ঘটনার দিন (৯ জুন ২০২৩) আঁখির স্বামী স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য সেন্ট্রাল হাসপাতালে আনার বিষয়ে ডা. সংযুক্তা এবং ড্রাইভার কান ম্যানেজার জমিরের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু ওই দিন ডা. সংযুক্তার বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি গোপন করেন। এমনকি তার অবর্তমানে এই রোগীর চিকিৎসা ডা. শাহাজাদীকে করতে নির্দেশ দিয়ে যান। ডা. সংযুক্তা নিয়মিতই তার অনুপস্থিতিতে তার নামে চিকিৎসা দিতে অন্যদের নির্দেশ দিয়ে যেতেন। 

সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডা. সংযুক্তা সাহার এবং বিএমডিসি নিবন্ধন নবায়ন না থাকার পরেও চিকিৎসা প্রদানের অনুমতি দিয়ে অনৈতিক কাজ করেছে। সেন্ট্রাল হাসপাতালে নির্ধারিত দিনে সংযুক্তা সাহার উপস্থিত না থাকার বিষয়টি গোপন করেছে। নিয়মিতভাবে ডা. সংযুক্তা সাহা অনুপস্থিত থাকলেও তার নামে রোগী ভর্তি করে অন্য ডাক্তারদের দ্বারা চিকিৎসা করিয়েছে। এমনকি ডা. সংযুক্তা বেআইনি ভাবে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে চিকিৎসা বিষয়ক প্রচারণা করে জেনেও তাকে নিষেধ না করে চিকিৎসার সুযোগ দিয়ে এসেছে। 

তদন্ত কমিটি মনে করে আঁখির মৃত্যুর জন্য তার স্বামী ইয়াকুব আলীও দায়ী। তিনি সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত দেখাতেন না। রোগীর দেরিতে প্রসবের কারণে সিজার লাগতে পারে, তিতাস উপজেলার নিবন্ধিত স্বাস্থ্য কর্মীর এ পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছেন এবং জটিলতা জেনেও স্বাভাবিক প্রসব করাতে দৃঢ় থেকেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও দীর্ঘায়িত প্রসূতি রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াই দীর্ঘ পথ সাধারণ গাড়িতে নিয়ে আসেন। 

ঘটনার দিন ডা. শাহাজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতির বিষয়টি গোপন করেছেন। ডা. সংযুক্তা সাহা উপস্থিত আছেন এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। রোগীকে প্রথমবার দেখে পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপস্থিত করতে হাসপাতালকে অনুরোধ করেননি। 

রোগী এবং স্বজনদের স্বাভাবিক প্রসবের প্রতি আগ্রহে প্রভাবিত হয়ে রোগীর প্রকৃত অবস্থা বুঝতে না পারা এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া ডা. মুনা সাহাও সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতির তথ্য গোপন করেছেন। ডা. সংযুক্তা সাহা উপস্থিত আছেন এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন। 

তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন) হোসেন আলী খোন্দকার মন্তব্য প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, আমি প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি। এর বাইরে কিছু বলার এখতিয়ার আমার নেই। কমিটির আরও তিনজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও একই ধরনের মন্তব্য করেন। তবে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন সদস্য বলেন, এই প্রতিবেদন আরও সুস্পষ্ট করার সুযোগ ছিল।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত