মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
ফেসবুক মেসেঞ্জারের ইনবক্সে একের পর এক কুরুচিকর এসএমএস, ফোন নম্বর চেয়ে বার্তা, জবাব না দিলে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা ছবিগুলো এডিট করে বাজে ছবি বানিয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি—এমন সব ঘটনায় ভয় পেয়ে নিজের পুরোনো অ্যাকাউন্টটি ডি-অ্যাকটিভ করেন বর্ণালি (ছদ্মনাম)। এমন ঘটনার শিকার বর্ণালি একা নন। প্রায় সব নারীকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন হেনস্তার শিকার হতে হয় কম-বেশি। এ কারণে অনেক নারীর কাছেই ইনবক্স এক আতঙ্কের নাম।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের জীবনে এসেছে যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন। বিশেষত যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে নিমেষেই অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যেকোনো সময় যোগাযোগ করা যাচ্ছে। ছোট একটি ডিভাইসের মাধ্যমে ঘরে বসে অনায়াসেই পাওয়া যাচ্ছে গোটা বিশ্বের সব খবর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃতি এনে দিয়েছে ব্যক্তিক যোগাযোগের এক নতুন যুগ। দিনের যেকোনো সময় ইনবক্সে আসছে পরিচিত-অপরিচিতজনদের বার্তা। কিন্তু এই ইনবক্সই কখনো কখনো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে হরহামেশাই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনেক সময়ই বিষয়গুলো আর শুধু হেনস্তায় সীমাবদ্ধ থাকছে না। একধরনের নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করছে এটি। অনেকের জীবনই গেছে পাল্টে। ভেঙে গেছে কারও কারও সংসার। ছিন্ন হয়ে গেছে পারিবারিক বন্ধন। আর মানসিক সংকট তো রয়েছেই। এই মানসিক পীড়া কখনো কখনো এতটাই বড় আকার নিচ্ছে যে, কখনো কখনো আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
একটু পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক। নারীদের জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিতে ২০২০ সালের নভেম্বরে যাত্রা করেছিল বাংলাদেশ পুলিশের সেবা ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের ফেসবুক পেজে মোট ১৯ হাজার ৮৯৭টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৩৫ হাজার ৪০০টি ফোনকল ও ৪৭৭টি ই-মেইল অভিযোগ এসেছে।
শুরুতেই বলা হয়েছে ভুক্তভোগী বর্ণালির কথা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার। এ বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একদিন হঠাৎ আমার এক বান্ধবী ফোনে জানতে চাইল আমার কী হয়েছে। আমার ফেসবুকে নতুন আইডি কেন? ওর কথায় বুঝলাম, আমার নামে ফেসবুকে নতুন আইডি তৈরি করা হয়েছে। এই নতুন আইডি থেকে আমার পরিচিতজনদের বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠানো হচ্ছে।’
অনুসন্ধান করে ঘটনার সত্যতা পান বর্ণালি। ভাবতে থাকেন কে এই কাজ করল? ক্ষোভ ও হতাশা গ্রাস করল তাঁকে। কিন্তু ঘটনা আরও বাকি ছিল। হঠাৎ করেই বর্ণালির ইনবক্সে উল্টোপাল্টা এসএমএস আসতে শুরু করল; সঙ্গে হুমকি। বর্ণালির ভাষ্য, ‘হুমকি দিয়ে বলে, ফোন নম্বর না দিলে আমার ছবি এডিট করে বাজে ছবি বানিয়ে ফেসবুকের নানা গ্রুপে পোস্ট দেবে। একপর্যায়ে আমি খুব ভয় পাই। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। কার কাছে যাব। একপর্যায়ে আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভ করে দিই। পরে আর কখনোই ওই আইডি চালু করিনি।’
নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে বর্ণালি বলেন, ‘আজকাল যেভাবে নতুন নতুন উপায়ে সাইবার ক্রাইম হচ্ছে, তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কেউই নিরাপদ না। বিশেষ করে নারীরা। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু এ নিয়ে কতজনই-বা প্রতিবাদ করে? অনেকেই হয়তো আমার মতো চুপচাপ নিজেকে গুটিয়ে ফেলে।’
আবার অনেকে অপরিচিত নয়, পরিচিতজনদের কাছ থেকেই হেনস্তার শিকার হন। এমনই একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নীলা (ছদ্মনাম)। নারীদের নিয়ে সমাজসেবামূলক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। মতবিরোধের জেরে চাকরি বদলের পর ওই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীরাই তাঁকে হেনস্তা করেন। নীলা জানান, ‘একপর্যায়ে আমার ননদকে ফোন দিয়ে আমার নামে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেন সাবেক সহকর্মীরা। পারিবারিক অশান্তি চরম পর্যায়ে চলে যায়।’ বিষয়টিতে এখনো বেশ ক্ষুব্ধ নীলা বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হলো, এটি কোনো পুরুষের কাজ ছিল না। এটা ছিল ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিছু নারীর কাজ।’
নীলা ও বর্ণালি দুজনই নিজেকে গুটিয়ে ফেলে সংকটের আপাত সমাধান খুঁজেছেন। কিন্তু এই গুটিয়ে ফেলাই কি সমাধান? নিশ্চিতভাবেই না। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এমন হেনস্তার প্রতিবাদ করেন বেশ সোচ্চারে। নিজের হাতে থাকা বিকল্পগুলো ব্যবহার করে হেনস্তাকারীর বিরুদ্ধে দরকারি পদক্ষেপও নেন। এমনই একজন শিউলি (ছদ্মনাম)। পেশায় সাংবাদিক শিউলি এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফেসবুকের একটি গ্রুপে তাঁর বিয়ের ছবি ব্যবহার করে ট্রল শুরু হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে বিষয়টি জেনে শিউলি ওই গ্রুপে ঢুকে দেখেন, বিয়ের দিন খাবারের টেবিলের একটি ছবি ব্যবহার করে ট্রল করা হচ্ছে। ওই পোস্টের মন্তব্যের ঘর আজেবাজে মন্তব্যে ভরা। শিউলি তাঁর বরকে জানান। বিয়েতে নিজেদের কাছের বন্ধু ও পরিবারের লোকজন ছাড়া আর কেউ না থাকায় তাঁরা ভেবে পাচ্ছিলেন না, কে করল এ কাজ। গ্রুপের অ্যাডমিনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলল—এটা আমাদের গ্রুপ, আমরা যা খুশি তাই করব। পরে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর ছবিটি তারা সরিয়ে ফেলে।
শিউলি বলেন, ‘কেন অনুমতি ছাড়া আমাদের বিয়ের ছবি এভাবে ট্রল করল? দেশে কি আইন বলতে কিছুই নেই?’ এটাই একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। বর্ণালির মতো তাঁর ছবি ব্যবহার করেও অন্য কেউ অ্যাকাউন্ট খুলেছিল ফেসবুকে। বন্ধুদের মাধ্যমে জেনে পরে রিপোর্ট করে সেই ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেন তিনি।
পেশাজীবীরাই যেখানে এমন হেনস্তার শিকার হন, সেখানে কিশোরী বা তরুণীদের কথা না বললেও চলে। কম বয়সী মেয়েদের ইনবক্সে এমন হেনস্তা নিয়মিত ঘটনা বলা যায়। এ থেকে বড় বড় অপরাধের ঘটনাও ঘটে। অনেক সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় ও ইনবক্সে আলাপের সূত্র ধরে কিশোরী বা তরুণীরা ঘর ছাড়ে এবং পড়ে বড় বিপদে। কারও কারও প্রাণও চলে যায় এতে। এমনই একজন সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষার্থী রুপা (ছদ্মনাম)। বেশ সচেতন রুপা বললেন, ‘সাইবার বুলিংয়ের কবলে প্রায়ই পড়তে হয়। সমস্যা হচ্ছে, এদের ধরা যায় না। এই ধরতে না পারার যন্ত্রণাও কম না।’ অবশ্য রুপাও নিজের আইডি পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার নারীরা প্রায়ই সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এতে নারীদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিবর্তন ঘটে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক সময় আত্মহত্যা করারও সিদ্ধান্ত নেন অনেকে। হয়রানির শিকার নারীদের মানসিক উত্তরণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরাসরি ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির মতোই অনলাইনে হয়রানি সমানভাবে ক্ষতিকর এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এর প্রতিকারের জন্য আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। যারা অনলাইনে নারীদের কটূক্তি বা অবমানকর মন্তব্য করে। তাদের সুস্থ সামাজিক ও মানসিক বিকাশে ঘাটতি রয়েছে। নিজেদের দীনতা ঢাকতে বিকারগ্রস্ত মনমানসিকতায় তারা অন্যের অপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এই সংকট ভয়াবহ। নিজের ব্যবসার স্বার্থেই ফেসবুক পেজে নিজের বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বর দিতে হয়। নিয়মিত ইনবক্স চেক করতে হয়। অপরিচিত ব্যক্তির বার্তা বলে কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এরই সুযোগ নেয় হেনস্তাকারীরা। আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে বিভিন্ন লেখায় নানাজন এই অভিযোগ করেছেন। এটা নতুন কিছু নয়।
নারী উদ্যোক্তা পদ্মাবতীর সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। বললেন, ‘অনলাইনে হয়রানি অতি সাধারণ ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে কত বড় অসামাজিক আচরণ করে, সেটা উদ্যোক্তা না হলে বুঝতে পারতাম না। নিজের অভিজ্ঞতাটা বলি। মেয়েদের পোশাক ও আনুষঙ্গিক জিনিস নিয়ে আমার অনলাইন উদ্যোগ। ব্যবসার প্রয়োজনে ছবি, ফোন নম্বর ইত্যাদি দিতে হয়। কিছু মানুষ একে পাবলিক সম্পত্তি ভেবে নেয়। অপ্রয়োজনীয় ফোন, মেসেজের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় যোগাযোগ নষ্ট হয়। ইনবক্সে আসতে থাকে অতি নোংরা মেসেজ। ক্রেতা সেজে প্রথমে কথা শুরু করে। প্রথম প্রথম খুব হতাশ লাগত। এখন অবশ্য ক্রেতা ও ছদ্মবেশীর তফাত বুঝতে পারি। চোখে পড়লে রিপোর্ট করি। কাজ কতটা হয় জানি না। ফেসবুক পেজ, আইডি, ইনস্টাগ্রাম—সব প্ল্যাটফর্মেই এক অবস্থা। যাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ, তারাও সামাজিক মাধ্যমে অন্যরকম হয়ে যায়।’
নিজের বাবার অসুস্থতার সময়ে হওয়া কিছু অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বাজে বললেন পদ্মাবতী। বললেন, ‘বাবার চিকিৎসার জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে হতো নিয়মিত। তখন অনেকগুলো গ্রুপে আমার নম্বর দিতে হয়েছিল। মানুষের অমানবিকতা দেখে তখন অবাক হতাম। নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। গভীর রাতে ফোন দিয়ে একেকজন একেক কথা বলতে শুরু করত। প্রথমেই রক্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত। তাই কল কাটতেও পারতাম না। এ রকম কত শতবার হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। একটা পর্যায়ে মরিয়া হয়ে সবকিছু এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম।’
এমন উদাহরণ হাজারটা দেওয়া যাবে। এই হেনস্তার ধরনেও আছে ভিন্নতা। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্যমতে, গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে ভুক্তভোগীর ছবি বা পরিচিতি ব্যবহার করে বেনামে আইডি খুলে বা ভুয়া আইডি সংশ্লিষ্ট অভিযোগ ৬ হাজার ৩৭৫টি বা ৪৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক ১ হাজার ৫৫৪টি বা ১১ শতাংশ, পূর্বপরিচয় বা সম্পর্কের জেরে বা অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো বা ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ ২ হাজার ২৩৫টি বা ১৫ শতাংশ। আর মোবাইল ফোনে হেনস্তা, লেখা, ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির ১ হাজার ৬৬৬টি বা ১১ শতাংশ, বিভিন্ন মাধ্যমে অশ্লীল শব্দ, লেখা, ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির ১ হাজার ২১৯টি বা ৮ শতাংশ অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে অন্য ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে ১ হাজার ৬৬৪ টি, যা মোট অভিযোগ সংখ্যার ১২ শতাংশ।
এই অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তিন্নি (ছদ্মনাম) যা বললেন, তা অন্তত আশ্বস্ত করছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হওয়া হেনস্তা ব্যক্তিগত ফোনেও শুরু হলে আর অপেক্ষা না করে তিনি পুলিশকে জানান। পুলিশ তাঁকে হেনস্তাকারীর নম্বর ব্লক করার পরামর্শ দেয় এবং এড়িয়ে যেতে বলে। তিন্নি বলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো, এদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবেনি পুলিশ। আমার পরিচিত এক আত্মীয় র্যাবে ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে শায়েস্তা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কোনো আইনি সহায়তা পাইনি।’
তবে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মীর আবু তৌহিদ জানালেন, সংস্থাটির তালিকাভুক্ত সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৯৭ জন। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৭১৩ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়ে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪১৬ জন পরে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সর্বমোট ৯ হাজার ৬৫৩ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৬৪৪ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। অভিযোগগুলো তদন্তাধীন।
নিজেদের সেবা সম্পর্কে মীর আবু তৌহিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের পক্ষ থেকে আমরা সব সময় ভুক্তভোগীর সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকি। এই ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা শুরুতে থানায় যেতে চান না। অভিযোগ জানার পর আমরা ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই। প্রয়োজন অনুযায়ী মামলা, জিডি বা উপযুক্ত আইনি পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিই। ভুক্তভোগীর সঙ্গে থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। এমনকি আসামি অন্য কোনো জেলায় অবস্থান করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আসামিকে আটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রয়োজনে সেখানেও জিডি বা মামলার বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করি।’ তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগ আসেন সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার হয়ে। কারও হয়তো আইডি হ্যাক হয়েছে, কারও নামে হয়তো নতুন আইডি খোলা হয়েছে, আবার কারও নামে হয়তো অনলাইনে ছড়াচ্ছে বাজে কোনো ছবি। এ ক্ষেত্রে আমরা টেকনিক্যাল সহযোগিতা করি।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের হেনস্তা করা আইনত অপরাধ। হয়রানির শিকার নারীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘অনলাইনে নারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে বা ভুয়া আইডিতে ছবি আপলোড করে হয়রানি করা হয়। এটি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ফেসবুক, টুইটার বা অন্য কোনো মাধ্যমে কারও নামে মানহানিকর বা অপমানজনক কিছু লেখা বা প্রকাশ করা বা মন্তব্য করা যেমন অপরাধ, তেমন নিতান্ত বিরক্ত করা, সেটাও অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) (ক) ধারায় এই ধরনের কাজকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথম অপরাধের জন্য তিন বছর পর্যন্ত জেল ও ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। আর একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তির মাত্রাও বাড়বে। এ ছাড়া টেলিফোনে বিরক্ত করলেও তা টেলিযোগাযোগ আইনের ৭০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য উল্লেখ করে ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের পুলিশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আছে এ ধরনের অপরাধ তদন্ত করার। কিন্তু থানাগুলোর পরিবেশ নারীদের জন্য সৌহার্দ্যপূর্ণ না হওয়ায় মেয়েরা পুলিশের কাছে যেতে চায় না। আবার আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত হয়রানির বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেন না, যেহেতু সমাজের সব স্তরে নারীকে দোষারোপের একটা প্রবণতা আছে। এটা ঠিক নয়। হয়রানির শিকার নারীদের সচেতন হওয়া জরুরি। হয়রানির শিকার নারীটি ভুক্তভোগী। ভুক্তভোগীর তো কোনো দোষ নাই, লজ্জারও কোনো কারণ নাই। এই কথাটা ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রচার করতে হবে। আর সচেতনতা তৈরি করতে হবে নারী-পুরুষ সবার মধ্যে।’
ফেসবুক মেসেঞ্জারের ইনবক্সে একের পর এক কুরুচিকর এসএমএস, ফোন নম্বর চেয়ে বার্তা, জবাব না দিলে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা ছবিগুলো এডিট করে বাজে ছবি বানিয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি—এমন সব ঘটনায় ভয় পেয়ে নিজের পুরোনো অ্যাকাউন্টটি ডি-অ্যাকটিভ করেন বর্ণালি (ছদ্মনাম)। এমন ঘটনার শিকার বর্ণালি একা নন। প্রায় সব নারীকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন হেনস্তার শিকার হতে হয় কম-বেশি। এ কারণে অনেক নারীর কাছেই ইনবক্স এক আতঙ্কের নাম।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের জীবনে এসেছে যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন। বিশেষত যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে নিমেষেই অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যেকোনো সময় যোগাযোগ করা যাচ্ছে। ছোট একটি ডিভাইসের মাধ্যমে ঘরে বসে অনায়াসেই পাওয়া যাচ্ছে গোটা বিশ্বের সব খবর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃতি এনে দিয়েছে ব্যক্তিক যোগাযোগের এক নতুন যুগ। দিনের যেকোনো সময় ইনবক্সে আসছে পরিচিত-অপরিচিতজনদের বার্তা। কিন্তু এই ইনবক্সই কখনো কখনো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে হরহামেশাই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনেক সময়ই বিষয়গুলো আর শুধু হেনস্তায় সীমাবদ্ধ থাকছে না। একধরনের নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করছে এটি। অনেকের জীবনই গেছে পাল্টে। ভেঙে গেছে কারও কারও সংসার। ছিন্ন হয়ে গেছে পারিবারিক বন্ধন। আর মানসিক সংকট তো রয়েছেই। এই মানসিক পীড়া কখনো কখনো এতটাই বড় আকার নিচ্ছে যে, কখনো কখনো আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
একটু পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক। নারীদের জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিতে ২০২০ সালের নভেম্বরে যাত্রা করেছিল বাংলাদেশ পুলিশের সেবা ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের ফেসবুক পেজে মোট ১৯ হাজার ৮৯৭টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৩৫ হাজার ৪০০টি ফোনকল ও ৪৭৭টি ই-মেইল অভিযোগ এসেছে।
শুরুতেই বলা হয়েছে ভুক্তভোগী বর্ণালির কথা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার। এ বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একদিন হঠাৎ আমার এক বান্ধবী ফোনে জানতে চাইল আমার কী হয়েছে। আমার ফেসবুকে নতুন আইডি কেন? ওর কথায় বুঝলাম, আমার নামে ফেসবুকে নতুন আইডি তৈরি করা হয়েছে। এই নতুন আইডি থেকে আমার পরিচিতজনদের বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠানো হচ্ছে।’
অনুসন্ধান করে ঘটনার সত্যতা পান বর্ণালি। ভাবতে থাকেন কে এই কাজ করল? ক্ষোভ ও হতাশা গ্রাস করল তাঁকে। কিন্তু ঘটনা আরও বাকি ছিল। হঠাৎ করেই বর্ণালির ইনবক্সে উল্টোপাল্টা এসএমএস আসতে শুরু করল; সঙ্গে হুমকি। বর্ণালির ভাষ্য, ‘হুমকি দিয়ে বলে, ফোন নম্বর না দিলে আমার ছবি এডিট করে বাজে ছবি বানিয়ে ফেসবুকের নানা গ্রুপে পোস্ট দেবে। একপর্যায়ে আমি খুব ভয় পাই। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। কার কাছে যাব। একপর্যায়ে আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভ করে দিই। পরে আর কখনোই ওই আইডি চালু করিনি।’
নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে বর্ণালি বলেন, ‘আজকাল যেভাবে নতুন নতুন উপায়ে সাইবার ক্রাইম হচ্ছে, তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কেউই নিরাপদ না। বিশেষ করে নারীরা। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু এ নিয়ে কতজনই-বা প্রতিবাদ করে? অনেকেই হয়তো আমার মতো চুপচাপ নিজেকে গুটিয়ে ফেলে।’
আবার অনেকে অপরিচিত নয়, পরিচিতজনদের কাছ থেকেই হেনস্তার শিকার হন। এমনই একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নীলা (ছদ্মনাম)। নারীদের নিয়ে সমাজসেবামূলক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। মতবিরোধের জেরে চাকরি বদলের পর ওই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীরাই তাঁকে হেনস্তা করেন। নীলা জানান, ‘একপর্যায়ে আমার ননদকে ফোন দিয়ে আমার নামে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেন সাবেক সহকর্মীরা। পারিবারিক অশান্তি চরম পর্যায়ে চলে যায়।’ বিষয়টিতে এখনো বেশ ক্ষুব্ধ নীলা বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হলো, এটি কোনো পুরুষের কাজ ছিল না। এটা ছিল ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিছু নারীর কাজ।’
নীলা ও বর্ণালি দুজনই নিজেকে গুটিয়ে ফেলে সংকটের আপাত সমাধান খুঁজেছেন। কিন্তু এই গুটিয়ে ফেলাই কি সমাধান? নিশ্চিতভাবেই না। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এমন হেনস্তার প্রতিবাদ করেন বেশ সোচ্চারে। নিজের হাতে থাকা বিকল্পগুলো ব্যবহার করে হেনস্তাকারীর বিরুদ্ধে দরকারি পদক্ষেপও নেন। এমনই একজন শিউলি (ছদ্মনাম)। পেশায় সাংবাদিক শিউলি এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফেসবুকের একটি গ্রুপে তাঁর বিয়ের ছবি ব্যবহার করে ট্রল শুরু হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে বিষয়টি জেনে শিউলি ওই গ্রুপে ঢুকে দেখেন, বিয়ের দিন খাবারের টেবিলের একটি ছবি ব্যবহার করে ট্রল করা হচ্ছে। ওই পোস্টের মন্তব্যের ঘর আজেবাজে মন্তব্যে ভরা। শিউলি তাঁর বরকে জানান। বিয়েতে নিজেদের কাছের বন্ধু ও পরিবারের লোকজন ছাড়া আর কেউ না থাকায় তাঁরা ভেবে পাচ্ছিলেন না, কে করল এ কাজ। গ্রুপের অ্যাডমিনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলল—এটা আমাদের গ্রুপ, আমরা যা খুশি তাই করব। পরে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর ছবিটি তারা সরিয়ে ফেলে।
শিউলি বলেন, ‘কেন অনুমতি ছাড়া আমাদের বিয়ের ছবি এভাবে ট্রল করল? দেশে কি আইন বলতে কিছুই নেই?’ এটাই একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। বর্ণালির মতো তাঁর ছবি ব্যবহার করেও অন্য কেউ অ্যাকাউন্ট খুলেছিল ফেসবুকে। বন্ধুদের মাধ্যমে জেনে পরে রিপোর্ট করে সেই ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেন তিনি।
পেশাজীবীরাই যেখানে এমন হেনস্তার শিকার হন, সেখানে কিশোরী বা তরুণীদের কথা না বললেও চলে। কম বয়সী মেয়েদের ইনবক্সে এমন হেনস্তা নিয়মিত ঘটনা বলা যায়। এ থেকে বড় বড় অপরাধের ঘটনাও ঘটে। অনেক সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় ও ইনবক্সে আলাপের সূত্র ধরে কিশোরী বা তরুণীরা ঘর ছাড়ে এবং পড়ে বড় বিপদে। কারও কারও প্রাণও চলে যায় এতে। এমনই একজন সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষার্থী রুপা (ছদ্মনাম)। বেশ সচেতন রুপা বললেন, ‘সাইবার বুলিংয়ের কবলে প্রায়ই পড়তে হয়। সমস্যা হচ্ছে, এদের ধরা যায় না। এই ধরতে না পারার যন্ত্রণাও কম না।’ অবশ্য রুপাও নিজের আইডি পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার নারীরা প্রায়ই সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এতে নারীদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিবর্তন ঘটে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক সময় আত্মহত্যা করারও সিদ্ধান্ত নেন অনেকে। হয়রানির শিকার নারীদের মানসিক উত্তরণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরাসরি ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির মতোই অনলাইনে হয়রানি সমানভাবে ক্ষতিকর এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এর প্রতিকারের জন্য আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। যারা অনলাইনে নারীদের কটূক্তি বা অবমানকর মন্তব্য করে। তাদের সুস্থ সামাজিক ও মানসিক বিকাশে ঘাটতি রয়েছে। নিজেদের দীনতা ঢাকতে বিকারগ্রস্ত মনমানসিকতায় তারা অন্যের অপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এই সংকট ভয়াবহ। নিজের ব্যবসার স্বার্থেই ফেসবুক পেজে নিজের বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বর দিতে হয়। নিয়মিত ইনবক্স চেক করতে হয়। অপরিচিত ব্যক্তির বার্তা বলে কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এরই সুযোগ নেয় হেনস্তাকারীরা। আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে বিভিন্ন লেখায় নানাজন এই অভিযোগ করেছেন। এটা নতুন কিছু নয়।
নারী উদ্যোক্তা পদ্মাবতীর সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। বললেন, ‘অনলাইনে হয়রানি অতি সাধারণ ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে কত বড় অসামাজিক আচরণ করে, সেটা উদ্যোক্তা না হলে বুঝতে পারতাম না। নিজের অভিজ্ঞতাটা বলি। মেয়েদের পোশাক ও আনুষঙ্গিক জিনিস নিয়ে আমার অনলাইন উদ্যোগ। ব্যবসার প্রয়োজনে ছবি, ফোন নম্বর ইত্যাদি দিতে হয়। কিছু মানুষ একে পাবলিক সম্পত্তি ভেবে নেয়। অপ্রয়োজনীয় ফোন, মেসেজের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় যোগাযোগ নষ্ট হয়। ইনবক্সে আসতে থাকে অতি নোংরা মেসেজ। ক্রেতা সেজে প্রথমে কথা শুরু করে। প্রথম প্রথম খুব হতাশ লাগত। এখন অবশ্য ক্রেতা ও ছদ্মবেশীর তফাত বুঝতে পারি। চোখে পড়লে রিপোর্ট করি। কাজ কতটা হয় জানি না। ফেসবুক পেজ, আইডি, ইনস্টাগ্রাম—সব প্ল্যাটফর্মেই এক অবস্থা। যাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ, তারাও সামাজিক মাধ্যমে অন্যরকম হয়ে যায়।’
নিজের বাবার অসুস্থতার সময়ে হওয়া কিছু অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বাজে বললেন পদ্মাবতী। বললেন, ‘বাবার চিকিৎসার জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে হতো নিয়মিত। তখন অনেকগুলো গ্রুপে আমার নম্বর দিতে হয়েছিল। মানুষের অমানবিকতা দেখে তখন অবাক হতাম। নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। গভীর রাতে ফোন দিয়ে একেকজন একেক কথা বলতে শুরু করত। প্রথমেই রক্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত। তাই কল কাটতেও পারতাম না। এ রকম কত শতবার হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। একটা পর্যায়ে মরিয়া হয়ে সবকিছু এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম।’
এমন উদাহরণ হাজারটা দেওয়া যাবে। এই হেনস্তার ধরনেও আছে ভিন্নতা। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্যমতে, গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে ভুক্তভোগীর ছবি বা পরিচিতি ব্যবহার করে বেনামে আইডি খুলে বা ভুয়া আইডি সংশ্লিষ্ট অভিযোগ ৬ হাজার ৩৭৫টি বা ৪৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক ১ হাজার ৫৫৪টি বা ১১ শতাংশ, পূর্বপরিচয় বা সম্পর্কের জেরে বা অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো বা ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ ২ হাজার ২৩৫টি বা ১৫ শতাংশ। আর মোবাইল ফোনে হেনস্তা, লেখা, ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির ১ হাজার ৬৬৬টি বা ১১ শতাংশ, বিভিন্ন মাধ্যমে অশ্লীল শব্দ, লেখা, ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির ১ হাজার ২১৯টি বা ৮ শতাংশ অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে অন্য ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে ১ হাজার ৬৬৪ টি, যা মোট অভিযোগ সংখ্যার ১২ শতাংশ।
এই অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তিন্নি (ছদ্মনাম) যা বললেন, তা অন্তত আশ্বস্ত করছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হওয়া হেনস্তা ব্যক্তিগত ফোনেও শুরু হলে আর অপেক্ষা না করে তিনি পুলিশকে জানান। পুলিশ তাঁকে হেনস্তাকারীর নম্বর ব্লক করার পরামর্শ দেয় এবং এড়িয়ে যেতে বলে। তিন্নি বলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো, এদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবেনি পুলিশ। আমার পরিচিত এক আত্মীয় র্যাবে ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে শায়েস্তা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কোনো আইনি সহায়তা পাইনি।’
তবে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মীর আবু তৌহিদ জানালেন, সংস্থাটির তালিকাভুক্ত সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৯৭ জন। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৭১৩ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়ে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪১৬ জন পরে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সর্বমোট ৯ হাজার ৬৫৩ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৬৪৪ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। অভিযোগগুলো তদন্তাধীন।
নিজেদের সেবা সম্পর্কে মীর আবু তৌহিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের পক্ষ থেকে আমরা সব সময় ভুক্তভোগীর সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকি। এই ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা শুরুতে থানায় যেতে চান না। অভিযোগ জানার পর আমরা ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই। প্রয়োজন অনুযায়ী মামলা, জিডি বা উপযুক্ত আইনি পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিই। ভুক্তভোগীর সঙ্গে থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। এমনকি আসামি অন্য কোনো জেলায় অবস্থান করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আসামিকে আটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রয়োজনে সেখানেও জিডি বা মামলার বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করি।’ তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগ আসেন সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার হয়ে। কারও হয়তো আইডি হ্যাক হয়েছে, কারও নামে হয়তো নতুন আইডি খোলা হয়েছে, আবার কারও নামে হয়তো অনলাইনে ছড়াচ্ছে বাজে কোনো ছবি। এ ক্ষেত্রে আমরা টেকনিক্যাল সহযোগিতা করি।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের হেনস্তা করা আইনত অপরাধ। হয়রানির শিকার নারীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘অনলাইনে নারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে বা ভুয়া আইডিতে ছবি আপলোড করে হয়রানি করা হয়। এটি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ফেসবুক, টুইটার বা অন্য কোনো মাধ্যমে কারও নামে মানহানিকর বা অপমানজনক কিছু লেখা বা প্রকাশ করা বা মন্তব্য করা যেমন অপরাধ, তেমন নিতান্ত বিরক্ত করা, সেটাও অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) (ক) ধারায় এই ধরনের কাজকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথম অপরাধের জন্য তিন বছর পর্যন্ত জেল ও ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। আর একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তির মাত্রাও বাড়বে। এ ছাড়া টেলিফোনে বিরক্ত করলেও তা টেলিযোগাযোগ আইনের ৭০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য উল্লেখ করে ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের পুলিশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আছে এ ধরনের অপরাধ তদন্ত করার। কিন্তু থানাগুলোর পরিবেশ নারীদের জন্য সৌহার্দ্যপূর্ণ না হওয়ায় মেয়েরা পুলিশের কাছে যেতে চায় না। আবার আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত হয়রানির বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেন না, যেহেতু সমাজের সব স্তরে নারীকে দোষারোপের একটা প্রবণতা আছে। এটা ঠিক নয়। হয়রানির শিকার নারীদের সচেতন হওয়া জরুরি। হয়রানির শিকার নারীটি ভুক্তভোগী। ভুক্তভোগীর তো কোনো দোষ নাই, লজ্জারও কোনো কারণ নাই। এই কথাটা ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রচার করতে হবে। আর সচেতনতা তৈরি করতে হবে নারী-পুরুষ সবার মধ্যে।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে কোমরতাঁতে বোনা কাপড় খুবই জনপ্রিয়। আর এ কাপড় বোনেন পাহাড়ি নারীরা। তবে আধুনিক বয়নশিল্পের প্রভাব এবং সুতাসহ কাঁচামালের দাম বাড়ায় এখন আর পোষাতে পারছেন না তাঁরা। সরকারের পক্ষ থেকেও নেই এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার কোনো উদ্যোগ। তাই হারাতে বসেছে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী এ শিল
১৯ মিনিট আগেহবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে পড়ে গুরুতর আঘাত পেয়ে সাদিকুর রহমান সাদিক (৩৫) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার সন্দলপুরে নবীগঞ্জ-হবিগঞ্জ সড়কে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
২৫ মিনিট আগেডিসেম্বরের ২০ তারিখ বিয়ে। অনুষ্ঠানের জন্য ঠিক করা হয়েছে ক্লাবও। পরিবারের পক্ষ থেকে চলছিল কেনাকাটাসহ বিয়ের নানা আয়োজন। এরমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ইশরাত জাহান তামান্না (২০)। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
১ ঘণ্টা আগেরাজশাহীতে দুই পক্ষের মীমাংসার সময় বিএনপির এক নেতাকে ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরের ভদ্রা এলাকায় রাজশাহী মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বজলুর রহমান মন্টুর ওপর এ হামলা হয়। তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
১ ঘণ্টা আগে