Ajker Patrika

অবৈধ পথে ইতালি যাত্রা: স্বপ্নভঙ্গ স্বপনের পঙ্গুত্ব বরণ

মাদারীপুর প্রতিনিধি
স্ত্রী-সন্তানের পাশে পঙ্গুত্ব বরণকারী স্বপন। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্ত্রী-সন্তানের পাশে পঙ্গুত্ব বরণকারী স্বপন। ছবি: আজকের পত্রিকা

লিবিয়া হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন স্বপন (৪০)। সেখানে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ও নির্যাতন সহ্য করে, লাখ লাখ টাকা খুইয়ে, পঙ্গুত্ব বরণ করে শেষে দেশে ফিরেছেন তিনি। এদিকে ধারদেনা করে দালালদের হাতে ২৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর সদরের পাঁচখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম পাঁচখোলা গ্রামের ওমর আলী সরদার ও হনুফা বেগমের ছেলে স্বপন। পাশের তাঁতিবাড়ি এলাকার রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী সোহাগ হোসেন ও একই উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের দেলোয়ার সরদারের সঙ্গে পরিচয় হয় স্বপনের। এর পর থেকে তাঁকে ইতালি যাওয়ার জন্য লোভ দেখানো হয়। তাঁদের ফাঁদে পড়ে ১২ লাখ টাকায় চুক্তি করেন তিনি। প্রথমে সোহাগের কাছে ১২ লাখ, পরে দোলোয়ারকে ৩ লাখ টাকা দেন। প্রায় ১৫ মাস আগে ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন স্বপন। এরপর দুবাইতে দালালদের একটি ক্যাম্পে পাঁছ দিন রাখা হয় তাঁকে। পরে তাঁকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে প্রায় তিন মাস চলে অত্যাচার, পুলিশের ধাওয়া ও পরে জেলহাজত।

২৮ দিন লিবিয়ায় জেলহাজতে থাকতে হয় স্বপনকে। এরপর বিভিন্ন দেশের ১২৮ জনকে একটি ভবনে রাখা হয়। এক রাতে পুলিশ ওই ভবনে তল্লাশি চালায়। এ সময় অনেকের সঙ্গে তিনিও দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন। স্থানীয় একজনের সহযোগিতায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেই থেকে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না তিনি। এরপর দালাল সোহাগ ও দেলোয়ার আর কোনো খোঁজ রাখেননি স্বপনের। একটু সুস্থ হলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব জানান। তখন দালালেরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান। কিন্তু আর কোনো খোঁজ নেননি দালালেরা।

স্বপনের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, কোনো উপায় না পেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আরেক দালালের সন্ধান পান স্বপনের স্ত্রী মিনু বেগম। মাদারীপুর সদরের খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের সাগর মল্লিকের সঙ্গে স্বপনের স্ত্রীর কথা হয়। তিনি জানান, স্বপনকে দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য ১০ লাখ টাকা লাগবে। ধারদেনা, ঋণ ও মিনুর বাবার বাড়ির জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অসুস্থ অবস্থায় কোনো রকম ওষুধ ছাড়াই স্বপনকে ফেলে রাখা হয় একটি ঘরের টয়লেটের পাশে ছোট একটি জায়গায়। কোনো দিন খেতে দিত আবার দিত না। মেরুদণ্ড ও হাত-পা ভেঙে যাওয়ায় ব্যথায় চিৎকার করলেও ওষুধ দেওয়া হতো না। এভাবে যায় প্রায় ছয় মাস। এরপর গত ১১ অক্টোবর তাঁকে দেশে পাঠানো হয়। এয়ারপোর্ট থেকেই চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে গত রোববার তাঁকে মাদারীপুরের নিজ বাড়িতে আনা হয়।

টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাও সম্ভব হচ্ছে না স্বপনের। উঠে বসতে পারেন না তিনি। সারা দিন বিছানায় সুয়ে থাকতে হয়। একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তির এই করুণ অবস্থা হওয়ায় পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। তারা খেয়ে-না খেয়ে কোনো রকমে জীবন যাপন করছেন। ভবিষ্যতে তাদের কীভাবে দিন যাবে, তা তারা জানেন না। স্বপ্নের দেশ ইতালিতে অবৈধভাবে যাওয়ার পথে আজ তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শুধুমাত্র থাকার জন্য বাড়িটি ছাড়া আজ তাদের কিছুই নেই। উল্টো ধার-দেনা আর কিস্তির টাকার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারটি।

এ ব্যাপারে স্বপনের স্ত্রী মিনু বেগম বলেন, ‘দালাল সোহাগ ও দেলোয়ার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না। টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। আরেক দালাল সাগর মল্লিকে ১০ লাখ টাকা দিই। সাগরের দুলাভাই আশরাফ দুবাই থাকেন। আর আশরাফের ভাই বাহার লিবিয়ায় থাকেন। তাদের মাধ্যমে অসুস্থ স্বপনকে দেশে আনার কথা হয়। কিন্তু তারা ছয় মাস ঘুরিয়ে তবেই স্বপনকে দেশে এনেছে। আমার স্বামী এখন বিছানা থেকে উঠতে পারে না। হাঁটতে পারে না। মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রয়োজন থেরাপি দেওয়ার। কিন্তু টাকার জন্য কিছুই করতে পারছি না। স্বপনের টাকাতেই চলতো সংসার। সেই মানুষটি আজ ইতালি যাওয়ার পথে অকেজো হয়ে গেছে। এখন তার চিকিৎসা তো দূরের কথা ঠিকমতো খেতেই পারি না। আর এই দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা কীভাবে করাব। আমাদের পুরো সংসার আজ শেষ হয়ে গেল। আমি দালালদের বিচার চাই। আর সকলের সহযোগিতা চাই। যাতে করে স্বপনকে একটু চিকিৎসা করাতে পারি।’

অসুস্থ স্বপনের মেয়ে মোহনা আক্তার বলেন, ‘আমরা বাবাকে এভাবে আর দেখতে চাচ্ছি না। অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমরা দালালদের বিচার চাই।’

অসুস্থ স্বপনের শাশুড়ি রাশিদা বেগম বলেন, ‘দালাল সোহাগের কথায় তাঁর কাছে টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। আমার মেয়ে মিনু তার স্বামীর জন্য নিজের জমি বিক্রি করে, ধার দেনা করে টাকা দিয়েছে। এখন ওদের কী হবে। দালাল যদি টাকাগুলো ফেরত দিত, তা হলেও কিছুটা উপকার হতো।’

এ ব্যাপারে দালাল সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘স্বপনের পরিবার আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা দেয়নি। টাকা দিয়েছে দেলোয়ার সরদারের কাছে। দেলোয়ার সরদারকে জিজ্ঞেস করেন, তিনিই সব জানেন।’

স্বপনকে খাইয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্বপনকে খাইয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। ছবি: আজকের পত্রিকা

দালাল দেলোয়ার সরদারের মোবাইল ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মাদারীপুরের সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আফজাল হোসাইন বলেন, তারা যদি সহযোগিতার জন্য দরখাস্ত দেন, তাহলে তাদের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করা হবে। তা ছাড়া থেরাপি দিতে চাইলে সরকারিভাবে বিনা টাকায় সমাজসেবা থেকে দিতে পারবেন। আর প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য দরখাস্ত করলে, তাও করে দেওয়া যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তিনি যদি সহযোগিতা চান, তাহলে তাঁর চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা দপ্তর থেকে ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নয়াদিল্লিতে নতুন হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহ, ৩ মাস সময় নিল ভারত

খেজুরে অতি মুনাফা, হতাশ ক্রেতা

চাপে পড়ে ৫টি বাস রিকুইজিশন দিয়েছেন পিরোজপুরের ডিসি, সরকারের হস্তক্ষেপ নেই: প্রেস সচিব

কলাবাগানে সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের মরদেহ উদ্ধার

রাতে স্বামীর জন্মদিন উদ্‌যাপন, সকালে নদীতে মিলল নববধূর লাশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত