আমার স্বামী সবুজকে যখন উত্তরার শিন-শিন জাপান হাসপাতাল থেকে গুরুতর অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়া যাই, তখন সবুজ আমারে বলে, ‘ওরা আমারে বাঁচবার দিল না। ওরা হাসপাতালে মানুষ মাইর‍্যা ফালায় আমি দেইখ্যা লাইছি। হাসপাতালের লোকজন আমারে বলে, তুই শুধু টই টই করস, তোরে আইজকা খাইছি।’ 

এভাবেই আজকের পত্রিকাকে বলছিলেন, উত্তরার শিন-শিন জাপান হাসপাতালের আইসিইউতে স্টাফদের মারধরে আহত হয়ে পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া সবুজ পিরিজের স্ত্রী লাবুনি পিডি। তিনি বলেন, ‘ওরা আমার ভালো স্বামীডারে একেবারে শেষ কইরা ফ্যালাইছে। আমি ওরে ভালো চিকিৎসার জন্য ওই হাসপাতালে পাঠাইছিলাম। আমার এখন দুইড্যা বাচ্চা নিয়া কী করমু? এখন শুধু ঈশ্বরকেই ডাকতাছি। ঈশ্বর ছাড়া তো আমার আর কোন কিছুই নাই।’ 

চিকিৎসার অনুমোদন না থাকলেও করোনায় আক্রান্ত সবুজ পিরিজকে গত ১৭ জুলাই রাতে ভর্তি করা হয়েছিল রাজধানীর উত্তরার শিন-শিন জাপান হাসপাতালে। সংকটাপন্ন এই রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে পাঁচ দিন চিকিৎসাও দেওয়া হয়েছিল। দেওয়া হয় ৮১ হাজার টাকা দামের ইনজেকশনও। কিন্তু গত ২২ জুলাই রাতে তিনি আইসিউতে থাকতে না চাইলে হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালের স্টাফরা তাকে মারধর করেন। এ সময় সবুজ আইসিইউতে থাকা ছুরি দিয়ে নার্সসহ তিনজনকে ছুরিকাঘাত করেন। হাসপাতালের কর্মীরাও তাঁর ওপর অমানবিক প্রতিশোধ নেন। তাঁদের হামলায় সবুজ গুরুতর আহত হলে চিকিৎসা না দিয়েই তাঁকে বেঁধে রাখা হয়। পরে পুলিশের সহায়তায় স্বজনরা সবুজকে উদ্ধার করে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৬ জুলাই মারা যান তিনি। 

এ ঘটনার জেরে পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে উত্তরা পশ্চিম থানায়। মুমূর্ষু থাকা অবস্থায়ই সবুজের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগে মামলা করে শিন-শিন জাপান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে সবুজের শ্বশুর জ্যোতি কস্তা সবুজকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গত বুধবার মামলা করেন। 

নিহত সবুজের মামা শ্বশুর দিপক ডমিনিক রোজারিও আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওই দিন রাত দেড়টার দিকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালের বেডের সাথে দুই হাত, দুই পা বেঁধে রেখেছে। তাকে পরের দিন বিকেল পর্যন্ত পানিও দেওয়া হয় নাই। বার বার একটু পানির জন্য হাহাকার করেছে সবুজ। কিন্তু পানিতো দেয় নাই, কাউকে দেখাও করতে দেয় নাই।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম-সবুজের ছুরিকাঘাতে আহত নার্স ও ওয়ার্ডবয়ের চিকিৎসার জন্য যত টাকা খরচ লাগে আমরা দিব। আমরা নার্সদের চিকিৎসার জন্য ৬১ হাজার ৭০০ টাকাও দিয়েছিলাম। তবুও শিন-শিন হাসপাতালের লোকজন দুই লাখ টাকা জামানত নেওয়ার জন্য আমার রোগীকে পরদিন বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত হাসপাতালে আটকিয়ে রেখেছিল। পরে পুলিশ গিয়ে সবুজকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে।’ 

নিহত সবুজের শ্বশুর জ্যোতি কস্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সবুজের মা আমেরিকার সিটিজেন। সবুজ, তার স্ত্রী লাবুনি ও দুই সন্তানকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার জন্য সব কাগজপত্র রেডি করে পাঠিয়েছিল। কিন্তু শিন-শিন জাপান হাসপাতালের লোকজন মারধর করে তাকে মেরে ফেলেছে। আমাদের সব স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।’ তিনি জানান, সবুজ মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার শুলপুর গ্রামের মৃত সেন্টু পিরিজের ছেলে। তার ১১ বছর বয়সী রাইয়েন পিরিজ নামের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী আরোহী পিনিক নামের দুই সন্তান রয়েছে।’

উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘করোনা রোগীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে হাসপাতালের অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’