Ajker Patrika

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও কেন হামলা, প্রশ্ন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২১, ২১: ১০
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও কেন হামলা, প্রশ্ন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশনাও দেন তিনি। এমন নির্দেশনার পরও কেন হামলা চলতে থাকে, কেন সবশেষ রংপুরের পীরগঞ্জে হামলা করা হয়—এমনই প্রশ্ন তুলেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আয়োজনে নাগরিক প্রতিবাদ সভায় অংশ নেওয়া বক্তারা। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

সভায় সরকারের বিচারহীনতা ও প্রশাসনের ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরেন আলোচকেরা। এ সময় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এ ধরনের ঘটনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন এবং দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপনের চেতনা-বিরুদ্ধ।’ ৭৫-পরবর্তী সময়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন এবং রাজনীতিতে ধর্মীয় অপশক্তির সঙ্গে মীমাংসা ও প্রশ্রয় এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম ব্যবহারের কারণে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। 

দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে সামনে আনার জন্য বর্তমান সরকার বিশেষ কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া নাসিরনগর বা রামুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। এসডিজির ১৬ নম্বর ধারার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার এই সনদে ২০১৫ সালে সই করে। নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে এই সনদ অনুযায়ী সরকারের উচিত মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা। 

সভায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি ওঠে। এ সময় অনলাইনে যুক্ত হয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিচারবিভাগীয় তদন্ত বলে আইনে কিছু নেই। এর আইনগত কোনো মূল্য নেই। যে ঘটনাগুলো হয়েছে, আমি ৯৯ ভাগ গ্যারান্টি দিচ্ছি কোনো রেজাল্ট হবে না। এত আসামি এত সাক্ষ্য দিয়ে বিচার করার সামর্থ্য আমাদের ব্যবস্থার নেই। ৩০০,৫০০, ৮০০ আসামির কথা উল্লেখ করে পুলিশ আগেই জানান দিয়ে দিচ্ছে, এখানে আমাদের কিছু করার নেই। যেটা উদ্দেশ্য, তা হলো গ্রেপ্তার বাণিজ্য। আগে আমি ভাবতাম এখানে অন্য কিছু আছে। কিন্তু এখন আমার ধারণা ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে—রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। যে কাজ করার জন্য যোগ্যতা দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা এখন নাই।’ 

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সন্ত্রাস কমে গেছে। আমি ভেবেছিলাম এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। আমি খুবই বিব্রত এবং মর্মাহত। এগুলো কেন ঘটল, কারা ঘটাচ্ছে এবং কারা ঘটতে দিচ্ছে—উভয়েই সমানভাবে দায়ী। আমাদের বিচারহীনতার কথা বলা হচ্ছে। এই বিচারহীনতা দূর করতে হবে। না হলে এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’ 

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বারবারই ঘটছে। হামলার শিকার হচ্ছে। দ্রুত প্রতিকার হোক—এমন প্রত্যাশা করি।’ 

বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল, আজকে আমাদের এই বাংলাদেশ দেখতে হবে—তা কখনো কল্পনাও করিনি। এর আগে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেনি, তা নয়। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে ঘটত।’ সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে একটি কমিশন গঠনের দাবি তুলে তিনি বলেন, ‘এমন একটা কমিশন গঠন করা উচিত, যাদের সবাই সম্মান করেন। এক-দু শ আসামির মামলা চাই না। সুস্পষ্ট তালিকা চাই।’ 

সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দেশ বিচারহীনতার মধ্যে চলছে। যে কারণে একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’ 

ভিন্নমত ও ভিন্ন পরিচয়ের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমার মতে এই দেশটা এমনভাবে যাচ্ছে, যেখানে ভিন্নমতের, ভিন্ন পরিচয়ের আর কোনো জায়গা রাখা হয়নি। আমি অবাক হচ্ছি। আমরা পূজা করতে যাচ্ছি, পুলিশ চাচ্ছি, পুলিশ পাচ্ছি না। কেমন পূজা করব যে, পূজার করার সময় পুলিশ লাগবে। তাহলে ঈদ করার সময় কি পুলিশ লাগবে? এটা তো একটা উৎসব এখানে পুলিশ নিয়ে, আর্মি নিয়ে সেটা করব?’ কুমিল্লার ঘটনায় যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাও রাজনীতির অংশ বলে দাবি করেন এই আইনজীবী। 

বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সভায় মন্তব্য করেন বক্তারাসাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, পুলিশের দৈন্য এবং অনেকে রাজনীতির কথা বলেছেন; আমি সে বিষয়টিও এড়াব না। নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছি। সেখানে এমপি সাহেব কোন দুঃখে আক্রান্তদের কাছে যাবেন? এমপির তো ভোটার দরকার নেই। তাঁর ভোট তো অন্যরা দিয়ে দেয়। এটা সিক্রেট কোনো ঘটনা না। 

বাংলাদেশ পেশাজীবী আন্দোলনের নেতা সরয়ার আলী বলেন, ‘আমি কয়েক দিন ধরে যেটা ভেবেছি, বাংলাদেশ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, সেটা বলার সাহস ক্রমশ হারিয়েছি। বাংলাদেশের যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘এই ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা রয়েছে। দুজন মুসলিম, যারা বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ 

অনলাইনে যুক্ত হয়ে ময়মনসিংহ-৮ আসনের সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, ‘আমাদের রাজনীতির যে চর্চা চলে, সেটা আইডিয়াল না। আমরা এই রাজনীতিটা চাই না। জনগণও চায় না। কিন্তু এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কী? উপায়টা হচ্ছে সিভিল সোসাইটিকে এগিয়ে আসতে হবে। আপনারা মাঝেমধ্যে যে মিটিং করেন, সেটা ছেড়ে দিলে চলবে না। ভয়েসটা রেইজ করতে হবে। আমরা যে জায়গাটাতে ব্যর্থ হয়েছি, সেটা আপনারা এসে পূরণ করুন।’ 

ড. সামসুল হুদা বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে বা অন্যায় হয়েছে, সেটা আমাদের সবার ব্যর্থতা। কেউ অন্যায় করেছে, কেউ অন্য সহ্য করেছে। দিনের পর দিন আমরা প্রতিবাদ করিনি। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত