সোহেল চৌধুরী হত্যায় সাক্ষীরা প্রকৃত সত্য আড়াল করেছেন: আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ১৭: ৫০
আপডেট : ০৯ মে ২০২৪, ১৮: ০৬

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার রায় আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছেন আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ২৫ বছর আগের দায়ের করা মামলায় অনেক সাক্ষী হাজির হননি। মামলার বাদী ছাড়া অন্য যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা প্রকৃত সত্য আড়াল করে গেছেন। 

আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা কেউ সাক্ষ্য দিতে হাজির হননি। একজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও দুজন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটদেরও পাওয়া যায়নি। এই অবস্থায় সঠিক বিচার সম্ভব নয়। তারপরও ঘটনার পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বিবেচনা করে রায় দেওয়া হলো। 

জনপ্রিয় একজন চিত্রনায়কের এভাবে খুন হওয়া এবং সেই বিচার এত বিলম্বিত হওয়া দুঃখজনক। মামলার নথি গায়েব, মামলার কেস ডকেট গায়েব এসব ঘটনা দুঃখজনক—আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়। 

আদালত বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আসামি আদনান সিদ্দিকী আটক হয়েছিলেন এ কথা অস্বীকার করা যাবে না এবং এটা প্রমাণিত। তাঁর জবানবন্দি থেকে ও অন্যান্য সাক্ষীদের থেকে প্রমাণ হয় ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ঘটনার সময় ক্লাবে উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার আগে সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল সেটাও প্রমাণিত। কাজেই হত্যা পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনজন জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। অন্য ছয়জনের বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের খালাস দেওয়া হলো। 

গত ২৯ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল রায়ের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে গত ১৯ মার্চ যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়। এরও আগে গত ২৮ জানুয়ারি মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর তৎকালীন বিচারক এম আলী আহমেদ। এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারিখ ধার্য করেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। 

সাক্ষ্য গ্রহণ
এই মামলায় বিভিন্ন সময়ে ১০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলার অভিযোগ পত্রে ৩৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। 

এই মামলায় ১২ জন সাক্ষী মারা গেছেন যে কারণে তাঁরা সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে হাজির হননি। বাকি সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। মামলার নথি থেকে জানা গেছে, মামলায় চারজন তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষী ছিলেন। চারজনই মারা গেছেন বলে প্রতিবেদন এসেছে। তৎকালীন দুজন ম্যাজিস্ট্রেটকে বারবার সমন সত্ত্বেও তারা হাজির হননি। 

নথি গায়েব
দীর্ঘদিন ধরে এই মামলার নথি গায়েব হয়েছিল। ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি দৈনিক আজকের পত্রিকায় ‘নায়ক খুনের মামলা গুম’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। নথি খুঁজে বের করার দাবিতে রিট আবেদন হয়। পরে নথি পাওয়া যায়। মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এই মামলার কেস ডকেট (সিডি) খুঁজে না পাওয়ায় আরও কয়েক মাস কেটে যায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করতে। শেষ পর্যন্ত কেস ডকেট ছাড়াই সাক্ষ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন ট্রাইব্যুনাল। 

যেভাবে নথি গায়েব হয়
আসামিদের মধ্যে আদনান সিদ্দিকুর ২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টে মামলা বাতিলের দাবিতে রিট (নম্বর: ৭০৫৩ / ২০০৩) করেন। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট প্রথমে তিন মাসের জন্য নিম্ন আদালতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম স্থগিত করেন। পরে ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রুল জারি করেন আদালত। সেই সঙ্গে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। দীর্ঘদিন হাইকোর্ট রিট আবেদনের ওপর শুনানি ঝুলে থাকার পর ২০১৫ সালে শুনানি হয়। শুনানি শেষে ওই রুল খারিজ করে রায় দেন বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীস্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে মামলার স্থগিতাদেশও প্রত্যাহার করা হয়। ছয় পাতার পূর্ণাঙ্গ রায় স্বাক্ষর শেষে আদালত থেকে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয় ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। শাখা থেকে ওই নথি বিচারিক আদালতে পাঠানোর জন্য প্রক্রিয়া করতে ৫ অক্টোবর দেওয়া হয় টাইপ রাইটার মাহফুজুর রহমানের কাছে। কাজ শেষ করে ১৮ অক্টোবর তা আবারও শাখায় ফেরত দেন মাহফুজ। যেখানে লেখা রয়েছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠানো হলো। কিন্তু নথি আর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ফেরত যায়নি হাইকোর্ট থেকে। পরে আজকের পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর একপর্যায়ে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। 

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে। ঘটনার পর সোহেলের ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে বাদানুবাদই এ হত্যার নেপথ্য কারণ বলে মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। 

সেই রাতে যা ঘটেছিল ট্রাম্পস ক্লাবে
নায়ক সোহেল আহমেদ চৌধুরী ওরফে সোহেল চৌধুরীর বয়স যখন ৩৫ তখন তিনি খুন হন সন্ত্রাসীদের হাতে। ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে তাঁকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় তাদের গুলিতে সোহেল চৌধুরীর বন্ধু আবুল কালাম আজাদ (৩৫) এবং ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মচারী নিরব (২৫) ও দাইয়ান (৩৫) আহত হন। গুলির ঘটনার পরপরই জনতা আদনান সিদ্দিকী নামের এক সন্ত্রাসীকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। অন্যরা পালিয়ে যায়। গুলির শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম্পস ক্লাবে থাকা ২০০ জনের মতো নারী-পুরুষ পালিয়ে যায়। তারা ড্যান্স পার্টিতে অংশ নিয়েছিল। ওই সময় বনানী-গুলশান এলাকার কেব্‌ল ব্যবসা ও ট্রাম্পস ক্লাবকে কেন্দ্র করে মালিকপক্ষের সঙ্গে সোহেলের বিরোধ চরমে উঠেছিল। ঘটনার দিন রাত ৯টায় সোহেল চৌধুরী বনানীর বাসা থেকে বের হন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন শহীদ, আবুল কালাম আজাদ, হেলাল ও হাফিজ নামে চার বন্ধু। বাসা থেকে বের হয়ে তাঁরা একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খান। 

এরপর রাত ২টার দিকে সোহেল চৌধুরী বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিছুক্ষণ পর বন্ধুরা মিলে ট্রাম্পস ক্লাবে যেতে থাকেন। সোহেলের বাসা থেকে ট্রাম্পস ক্লাবের দূরত্ব ২৫-৩০ গজের মতো। তাঁরা হেঁটে ক্লাবের সামনে যান। ক্লাবের নিচতলার কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাঁদের গতিরোধ করে। এক যুবক আবুল কালামের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ায়। এরই একপর্যায়ে এক যুবক রিভলবার বের করে কালামের পেটে দুটি গুলি করে। মুহূর্তেই সন্ত্রাসীরা সোহেল চৌধুরীর বুকে গুলি করতে শুরু করে। সোহেল গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবের ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। সোহেল চৌধুরীর বাবা তারেক আহমেদ চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। সোহেল চৌধুরী মা-বাবার সঙ্গে বনানীর বাসায় থাকতেন। তাঁর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী অন্যত্র থাকতেন। বনানীর ইকবাল টাওয়ারের পাশে ছিল ট্রাম্পস ক্লাব। ক্লাবে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার অভিযোগ ছিল। সপ্তাহে এক দিন পার্টির অনুমোদন থাকলেও প্রতিদিন রাতেই জলসা বসত সেখানে। সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁর দুই স্ত্রী থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়। তাঁদের একজন স্মৃতি, অন্যজন তুলি। দুজনকেই ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। দুজনই সোহেল চৌধুরীকে স্বামী হিসেবে দাবি করেছিলেন। ওই সময় সোহেলের মা সাংবাদিকদের কাছে দুই বউয়ের বিষয় অস্বীকার করেন। সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করে পাঁচ-ছয় সন্ত্রাসী প্রাইভেট কারে পালিয়ে যায়। আদনান সিদ্দিকী পালাতে না পেরে পাশের একটি ভবনে লুকাতে চেষ্টা করে। এ সময় ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মীরা তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। 

ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর আদনান সিদ্দিকী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। তাতে সে উল্লেখ করে, হত্যাকাণ্ডের আগে এক শিল্পপতির ফোন পেয়ে ঢাকা ক্লাব থেকে ঘটনাস্থলে যায়। সে জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পস ক্লাবে আসা-যাওয়া ছিল তাঁর। যাতায়াতের কারণেই ক্লাবের একাধিক সদস্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। ঘটনার রাতে কয়েকজন ক্লাব সদস্যের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। আর ওই কারণেই স্টাফরা তাঁকে ধরিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর বন্ধু নিরবসহ আটজন জড়িত ছিল বলে সে ওই সময় স্বীকার করে। ওই ঘটনায় সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে বিশিষ্ট শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাই, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক ব্যবসায়ী বান্টি ইসলাম, আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তরিক সাইদ মামুন, আদনান সিদ্দিকী, ফারুক আব্বাসী, সানজিদুল হাসান ওরফে ইমন, মো. সেলিম খান ও হারুনুর রশীদ ওরফে লিটন ওরফে লেদার লিটনকে আসামি করে মামলা করা হয়। 
 
আসামি আদনানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
এই মামলার আসামি আদনান সিদ্দিকী ঘটনাস্থল থেকে জনতার হাতে আটক হন। তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার পর তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাসহ কারা কারা জড়িত ছিলেন সে বিষয়ে বলেছিলেন। আসামি বান্টি ইসলাম ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় বলে তিনি স্বীকারোক্তিতে বলেন। আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন, মামুন ও বোতল চৌধুরী জড়িত থাকার কথাও জানান। এই মামলায় দুজন সাক্ষীও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের জড়িত থাকার কথা বলেন। 

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাদিয়া আফরিন শিল্পী আজকের পত্রিকাকে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের হাজির করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে অনেক আসামি খালাস পেয়েছেন। তারপরও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের সাজা হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ খুশি।

আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত