রাজধানীতে ঈদ উপলক্ষে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কামারেরা

জহিরুল আলম পিলু, শ্যামপুর-কদমতলী
Thumbnail image

ঈদুল আজহা উপলক্ষে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কামারেরা। কামারের দোকানগুলোতে ভিড় বেড়েছে ক্রেতাদেরও। দোকানগুলোতে বেড়েছে কোরবানির পশু জবাইয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ। এর মধ্যে বটি, ছুরি, চাপাতি ও কুড়াল অন্যতম। রাজধানীর শ্যামপুর ও যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত বেশ কয়েকটি কামারের দোকানে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

কামারদের অনেকে জানান, এক সময় গ্রাম ও শহরে কামারদের ছিল জমজমাট ব্যবসা। দোকানও ছিল অনেক। কিন্তু এই আধুনিক যুগে অনেকটাই বিলুপ্তির মুখে কামার সম্প্রদায়ের মানুষ। কারখানায় অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি এসব পণ্য, চীন থেকে এ ধরনের পণ্য দেশে আসায় এবং অনলাইনে বিক্রি করায় ও কয়লা, লোহা ইস্পাতের দাম বেড়ে যাওয়ায় কামারদের চাহিদা অনেক কমে গেছে। ফলে অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। অনেকে আবার বাপ-দাদার এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে বেশির ভাগ কামারই তাঁদের সন্তানদের এই পেশায় আনতে রাজি নয় বলে জানান।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মীর হাজিরবাগের ব্যবসায়ী বিবেক কর্মকার (৪২)। তিন পুত্র সন্তানের জনক বিবেকের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। তাঁর দোকানের সামনে টেবিলের মধ্যে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন সাইজের ছুরি, চাপাতি, বটি, কুড়ালসহ অসংখ্য লোহা ও ইস্পাতের তৈরি পণ্য। একদিকে এসব পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত দোকানের মালিক বিবেকসহ তাঁর কর্মচারীরা। ক্রেতারাও আসছেন পণ্য কিনতে। কেউ আসছেন তাঁদের পুরোনো পণ্যগুলো আরেকটু ঝালিয়ে নিতে। সব মিলে অনেকটা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিবেকসহ তাঁর চার কর্মচারী।

এর মধ্যেই কথা হয় বিবেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এটা আমার বাপ-দাদার পেশা। আমি ছোটবেলা থেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বাবার কাছ থেকে কাজ শিখেছি। প্রায় ৩৫ বছর যাবৎ এই পেশায় আছি। এক সময় এই ব্যবসা প্রচুর লাভবান ছিল। জিনিসপত্রের দাম কম থাকলেও ব্যবসা ছিল ভালো। এক সময় এসব পণ্য ব্যবহারকারীরা পণ্য তৈরির জন্য বা কিনতে ছুটে আসতেন কামারদের কাছে। কিন্তু শিল্পায়নের এই যুগে কারখানায় অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি হচ্ছে এসব লোহা ও ইস্পাতের পণ্য। শুধু তাই নয় চীনের তৈরি এই ধরনের বিভিন্ন পণ্যও আসছে দেশে। ফলে আমাদের চাহিদা কমে গেছে।’

তিনি আরও জানান, ‘বর্তমানে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। কিন্তু সারা বছর আমাদের বেচা–কেনা তেমন হয় না। ভবিষ্যতে বাপ-দাদার এই পেশা হয়তো ধরে রাখা যাবে না। আমার সন্তানদের লেখাপড়া করাই। তাঁদের এই পেশায় আনব না। কোরবানি ঈদ উপলক্ষে অর্ডার বা চাহিদা বেশি থাকায় এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য আমার কলেজ পড়ুয়া বড় ছেলেকে নিয়ে আসি।’

কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ থেকে কোরবানির পশু জবাই ও মাংস কাটার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আসেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর কোরবানি ঈদেই আমরা চাপাতি, ছুরিসহ বিভিন্ন পণ্য কিনতে আসি। এবারও নিলাম। তবে দাম গতবারের তুলনায় একটু বেশি।’

বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একটি চাপাতির মূল্য আকারভেদে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। একটি ছুরির মূল্য আকারভেদে ১৫০ থেকে ৫৫০ টাকা এবং একটি ছোট থেকে বড় বটি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৯০০ টাকায়।

যাত্রাবাড়ীর মীর হাজিরবাগে অবস্থিত আরেক কামারের দোকানের মালিক বিমল কর্মকার। তাঁর বাড়িও পটুয়াখালী। দুই ছেলে ও এক মেয়ের পিতা তিনি। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি জানান, ‘সারা বছর আমাদের কোনোরকম বেচা–কেনা হয়। কিন্তু প্রতি বছর কোরবানির ঈদ আসলে আমাদের পণ্যের বিক্রি অনেকটা বাড়ে। আমি কর্মচারীদের নিয়ে নিজেই লোহা ও ইস্পাত দিয়ে আগুনে পুড়ে আদি আমলের পদ্ধতিতে চাপাতি, বিভিন্ন ধরনের ও সাইজের ছুরি, কুড়াল ও বটিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করি।’

তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘আধুনিক যুগে বিভিন্ন কারখানায় অত্যাধুনিক মেশিনে সহজে এসব পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া চীন থেকেও এসব পণ্য আসছে এবং অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে। ফলে কামারদের দেশীয় হাতে তৈরির পদ্ধতিতে তৈরি এসব পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এটা আমার বাপ–দাদার পেশা। আমার সন্তানরা লেখাপড়া করে। তাদের এই পেশায় আনব না। হয়তো এসব দোকানের কর্মচারীরা ভবিষ্যতে এই পেশাকে ধরে রাখবে। তবে এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ পেশার সম্প্রদায়ের মানুষ হারিয়ে যেতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত