কামরুল হাসান
বায়তুল মোকাররম মার্কেটে কেনাকাটা তখনো জমেনি। নিচতলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠাগারে লোকজন কম। পাঠাগারের সিঁড়ি ও প্রবেশমুখে অচেনা হকার, টুপিবিক্রেতা, চশমার ফেরিওয়ালা।সবারই শিকারি চোখ। কার জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। আশপাশের দোকানিদের উৎসুক দৃষ্টি। ফিসফাস শব্দ, ‘এরা কারা?’
২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির সকাল। অপেক্ষার জবাব মেলে একটু পরে। ক্লিন শেভ, রঙিন চশমা, সবুজ শার্ট পরা এক ব্যক্তি আসেন পাঠাগারের গেটে। হেঁটে চলে যান গেট অবধি। পেছন থেকে একজন চেনার চেষ্টা করেন, আরেকজন নাম ধরে ডাকেন। আগন্তুক কোনো কথা না বলে হাত বাড়ান। হাত মেলান একজন, কিন্তু তিনি থামেন না। সোজা চলে যান ওপরে পাঠাগারের ভেতরে। কী মনে করে আবার বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ান।
পাঠাগারের প্রথম টেবিলে বসে ছদ্মবেশী দুজন ক্যাপ্টেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কর্নেল। আর অপেক্ষা নয়। সঙ্গীদের দিকে ইশারা করেন কর্নেল। শিকার হাতছাড়া হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে একটি রিভলবার এসে ঠেকে যায় আগন্তুকের পিঠে। এতক্ষণে তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না, ধরা পড়ে গেছেন। গোয়েন্দাগিরির খেলায় এভাবেই হেরে যান জেএমবির মজলিশে সুরার সদস্য হাফেজ মাহমুদ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্লু–শায়খ আবদুর রহমান সিলেটে আছেন। ব্যস, শুরু হয়ে যায় জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে পাকড়াওয়ের অভিযান।
বেলা পড়তে না পড়তেই ১০-১২টি গাড়ির বহর পথের লোকদের দুপাশে সরিয়ে দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটতে থাকে সিলেট হাইওয়ে ধরে। গাড়ি থেকে কর্নেল আমাকে ফোন করেন, সেই চেনা আওয়াজ–‘ওস্তাদ ব্যাগ রেডি করেন। বড় কিছু হবে।’ যেকোনো বড় খবরে এভাবেই তিনি আমাকে আগাম ক্লু দিয়ে রাখেন।
রসিকতা করে ‘ওস্তাদ’ বলা সেই লোকটির নাম কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ, বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ। সেদিনও তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে। তবে বড় কোনো খবরের জন্য নয়, জীবন ও মৃত্যুর শূন্যরেখায় দাঁড়িয়ে, যখন বিডিআরের উন্মত্ত সৈনিকেরা নির্বিচারে গুলি করে কর্মকর্তাদের হত্যা করছিলেন।
সশস্ত্র বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যই খুব সোজাসাপ্টা। কথায় কোনো প্যাঁচগোজ নেই, যা বিশ্বাস করেন বলেন। আর বন্ধুর জন্য দিলখোলা, নিবেদিতপ্রাণ। সেই ভাবনা থেকেই গুলজার উদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, তাও ২৫-২৬ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সফরে গিয়ে। তখন আমি জনকণ্ঠে।
লম্বা ছিপছিপে এক মেজর। হাঁটলে মনে হয় যেন দূরের কাশবন। বাতাসে নুয়ে পড়ছে, তারপর আবার টানটান হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। খুবই হাসিখুশি, কোনো কিছুতেই রাখঢাক নেই। অল্পতেই ভাব জমে গেল। তারপর নিয়মিত যোগাযোগ, ফোনেই বেশি।
২০০৪ সালের প্রথম দিকে একদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিচতলায় লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। পেছন থেকে সেই ডাক, `ওস্তাদ…।’ তাকিয়ে দেখি পোশাক পরা গুলজার উদ্দিন আহমেদ। বললেন, র্যাব নামে নতুন একটি বাহিনী হচ্ছে, তিনি সেখানে আসছেন। তত দিনে তিনি মেজর থেকে লে. কর্নেল হয়েছেন। র্যাবে এসে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে গেল। র্যাব-৩-এর অধিনায়ক হলেন। গণমাধ্যমের কাছে দারুণ জনপ্রিয়।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিকেলের দিকে চলে যেতাম উত্তরায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতাম। তাঁর জীবনের গল্প, বেড়ে ওঠার গল্প। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম নেওয়া মানুষটি কীভাবে ১৯৮৩ সালে পদাতিক রেজিমেন্টে কমিশন পেলেন, তারপর বিএমএ, সেনা সদর হয়ে মিশনে গেলেন—সেই সব গল্প। আর বলতেন স্ত্রী ফাতেমা সুলতানা, দুই মেয়ে তাসনিয়া ও লামিয়ার কথা। গল্পের সময় একটি সিগারেটের আগুন দিয়ে আরেকটি সিগারেট ধরাতেন। রিং করে ছুড়ে ফেলা সেই ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যেত ফেলে আসা দিনের স্মৃতি।
২০০৫ সালে র্যাব একটি গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করে। গুলজার উদ্দিন সেই বিভাগের প্রথম প্রধান। হাটখোলায় র্যাব-৩-এর কার্যালয় ছেড়ে এলেন বিমানবন্দর এলাকায় র্যাব সদর দপ্তরে। আমারও যাতায়াত বেড়ে গেল। ২০০৬ সালে একদিন শুনি তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন। র্যাবে আর থাকছেন না। চলে গেলেন বাংলাদেশ রাইফেলসে (বিডিআর)। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মন খারাপের কারণ উবে গেল, তিনি আবার ফিরে এলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক হয়ে।
সারা দেশে তখন জেএমবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি শুরু করেছে জেএমবি। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬টি হামলায় ৭৩ জন নিহত আর প্রায় ৮০০ লোক আহত হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শেষ পর্যন্ত দেশে-বিদেশের চাপের মুখে চারদলীয় জোট সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জঙ্গি নির্মূলের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামেন গুলজার উদ্দিন। জঙ্গি দমন অভিযানে তিনি যে সাহস দেখাতেন, তা ছিল শিউরে ওঠার মতো।
এর মধ্যে একদিন একটি মজার ঘটনা ঘটে। জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান তখন রিমান্ডে। দুপুরের দিকে র্যাব সদর দপ্তরে গিয়ে দেখি সবার মুখ-চোখ শুকনো। পুরো অফিস থমথমে। একেবারে অন্য রকম একটি পরিবেশ। কী হয়েছে, কেউ বলছে না। খুব ঘনিষ্ঠ একজনকে অনুরোধ করতেই যা বললেন, শুনে পিলে চমকে গেল। তিনি বললেন, শায়খ আবদুর রহমান রিমান্ডে থাকা অবস্থায় র্যাব হেফাজত থেকে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। কীভাবে তিনি পালালেন? বললেন, ফজরের নামাজের জন্য সেলের তালা খুলে দেওয়া হয়। তখন অজু করার নাম করে পালিয়ে যান। মাথায় যেন বাজ পড়ল। এত বড় খবর কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। গেলাম তৎকালীন মহাপরিচালক আবদুল আজিজ সরকারের কাছে। তিনি যেন ভূত দেখলেন। গেলাম গুলজার উদ্দিনের কাছে। তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। দুই হাত ধরে খুব অনুরোধ করলেন খবরটা যেন প্রকাশ না হয়। অনুরোধে মানুষ ঢেঁকিও গেলে। ছোটবেলায় শোনা সেই প্রবাদ আমার জীবনেও সত্যি হলো। পেশাদার সংবাদকর্মীরা হয়তো এখন এসে উচিত-অনুচিত নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। কিন্তু বন্ধুত্বের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। অবশ্য সেদিন বিকেলেই টঙ্গীর একটি স্থান থেকে আবদুর রহমান ধরা পড়েন।
সবকিছুতেই ভালো-মন্দ দিক থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। তিনি আমাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, একজন সংবাদকর্মীর জন্য যা খুবই জরুরি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে গুলজার উদ্দিন কর্নেল পদে পদোন্নতি পেলেন। চলে গেলেন ২০০৯ সালের জানুয়ারির দিকে। সিলেট থেকে একদিন ফোন করে বেড়াতে আসতে বললেন। বললাম, বড় ঘটনা ঘটুক, নিশ্চয় যাব। শুনে হো হো করে হাসলেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, বুধবারের সকাল। নাশতা করা শেষ হয়নি, ফোন দিলেন প্রথম আলোর টেলিফোন অপারেটর সুফলা। পিলখানা থেকে কে একজন অফিসের নম্বরে ফোন করে বলেছেন সেখানে খুব গন্ডগোল হচ্ছে।
পিলখানায় সেদিন বিডিআরের বার্ষিক দরবার হওয়ার কথা। বিডিআরের কয়েকজন পরিচিত কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের ফোন দিলাম। কেউ ধরলেন না। গুলজার উদ্দিনের ফোন লাগাতার ব্যস্ত। একটু পর আবার সুফলার ফোন। বললেন, সেখানে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। আশপাশের বাসিন্দারা বারবার ফোন করছেন। অফিসে ফোন দিয়ে সবাইকে ঘটনা জানাতে বললাম। নিজেও বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। হঠাৎ ফোন—গুলজার উদ্দিনের ফোন। ভয়ার্ত কণ্ঠ। বাঘের মতো সাহসী মানুষের এমন কণ্ঠস্বর শুনে চমকে গেলাম। কথা বলছেন নিচু গলায়—ফিসফিসিয়ে। বললেন, ‘বিদ্রোহী সৈনিকেরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। বাঁচব কি না, জানি না। প্লিজ যাকে পারেন তাকে বলেন।’ শুনে রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। কী করব, কাকে ফোন দেব বুঝে উঠতে পারছি না। ফোন দিলাম ডিএমপির তখনকার কমিশনার নাঈদ আহমেদকে। তাঁর ফোন ব্যস্ত। র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকারকে ফোন করতেই তিনি বললেন ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হচ্ছেন। ফোন দিলাম আইজিপি নূর মোহাম্মদকে।তাঁর গলা কাঁপছে। বললেন, তাঁর সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে ও জামাতা আটকা পড়েছে। মেয়ে বারবার ফোন করে কাঁদছে। আইজিপির কথায় অসহায়ের সুর। এরপর থেকে গুলজার উদ্দিনকে আর ফোনে পাইনি। অপেক্ষায় থেকেছি, ফোন আর বাজেনি।
পরের ইতিহাস সবারই জানা। বিদ্রোহের দুই দিন পর পিলখানার গণকবর থেকে অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে গুলজার উদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গুলজার উদ্দিনের বোন শম্পা আফরোজ আমাদের জানান, বিডিআর সদর দপ্তরের সামনে থেকে ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে। বনানীর সামরিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন এলেই বনানীর সামরিক কবরস্থানে যাই, মনটা ভারী হয়ে আসে। কয়েক বছর আগে একবার দেখি ছোট মেয়েকে নিয়ে গুলজার উদ্দিনের স্ত্রী কবরস্থানে। সালাম দিতেই বললেন, ‘আপনাকেও তো তিনি ফোন করেছিলেন, কই বাঁচাতে পারলেন না!’ তাঁর দুই চোখে পানি। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, কোনো জবাব দিতে পারি না।
আসলেই, আমাদের মতো সাধারণ সংবাদকর্মীর বেশির ভাগ সময় চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। নিজেকে বড় অসহায় লাগে।
বায়তুল মোকাররম মার্কেটে কেনাকাটা তখনো জমেনি। নিচতলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠাগারে লোকজন কম। পাঠাগারের সিঁড়ি ও প্রবেশমুখে অচেনা হকার, টুপিবিক্রেতা, চশমার ফেরিওয়ালা।সবারই শিকারি চোখ। কার জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। আশপাশের দোকানিদের উৎসুক দৃষ্টি। ফিসফাস শব্দ, ‘এরা কারা?’
২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির সকাল। অপেক্ষার জবাব মেলে একটু পরে। ক্লিন শেভ, রঙিন চশমা, সবুজ শার্ট পরা এক ব্যক্তি আসেন পাঠাগারের গেটে। হেঁটে চলে যান গেট অবধি। পেছন থেকে একজন চেনার চেষ্টা করেন, আরেকজন নাম ধরে ডাকেন। আগন্তুক কোনো কথা না বলে হাত বাড়ান। হাত মেলান একজন, কিন্তু তিনি থামেন না। সোজা চলে যান ওপরে পাঠাগারের ভেতরে। কী মনে করে আবার বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ান।
পাঠাগারের প্রথম টেবিলে বসে ছদ্মবেশী দুজন ক্যাপ্টেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কর্নেল। আর অপেক্ষা নয়। সঙ্গীদের দিকে ইশারা করেন কর্নেল। শিকার হাতছাড়া হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে একটি রিভলবার এসে ঠেকে যায় আগন্তুকের পিঠে। এতক্ষণে তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না, ধরা পড়ে গেছেন। গোয়েন্দাগিরির খেলায় এভাবেই হেরে যান জেএমবির মজলিশে সুরার সদস্য হাফেজ মাহমুদ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্লু–শায়খ আবদুর রহমান সিলেটে আছেন। ব্যস, শুরু হয়ে যায় জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে পাকড়াওয়ের অভিযান।
বেলা পড়তে না পড়তেই ১০-১২টি গাড়ির বহর পথের লোকদের দুপাশে সরিয়ে দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটতে থাকে সিলেট হাইওয়ে ধরে। গাড়ি থেকে কর্নেল আমাকে ফোন করেন, সেই চেনা আওয়াজ–‘ওস্তাদ ব্যাগ রেডি করেন। বড় কিছু হবে।’ যেকোনো বড় খবরে এভাবেই তিনি আমাকে আগাম ক্লু দিয়ে রাখেন।
রসিকতা করে ‘ওস্তাদ’ বলা সেই লোকটির নাম কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ, বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ। সেদিনও তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে। তবে বড় কোনো খবরের জন্য নয়, জীবন ও মৃত্যুর শূন্যরেখায় দাঁড়িয়ে, যখন বিডিআরের উন্মত্ত সৈনিকেরা নির্বিচারে গুলি করে কর্মকর্তাদের হত্যা করছিলেন।
সশস্ত্র বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যই খুব সোজাসাপ্টা। কথায় কোনো প্যাঁচগোজ নেই, যা বিশ্বাস করেন বলেন। আর বন্ধুর জন্য দিলখোলা, নিবেদিতপ্রাণ। সেই ভাবনা থেকেই গুলজার উদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, তাও ২৫-২৬ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সফরে গিয়ে। তখন আমি জনকণ্ঠে।
লম্বা ছিপছিপে এক মেজর। হাঁটলে মনে হয় যেন দূরের কাশবন। বাতাসে নুয়ে পড়ছে, তারপর আবার টানটান হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। খুবই হাসিখুশি, কোনো কিছুতেই রাখঢাক নেই। অল্পতেই ভাব জমে গেল। তারপর নিয়মিত যোগাযোগ, ফোনেই বেশি।
২০০৪ সালের প্রথম দিকে একদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিচতলায় লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। পেছন থেকে সেই ডাক, `ওস্তাদ…।’ তাকিয়ে দেখি পোশাক পরা গুলজার উদ্দিন আহমেদ। বললেন, র্যাব নামে নতুন একটি বাহিনী হচ্ছে, তিনি সেখানে আসছেন। তত দিনে তিনি মেজর থেকে লে. কর্নেল হয়েছেন। র্যাবে এসে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে গেল। র্যাব-৩-এর অধিনায়ক হলেন। গণমাধ্যমের কাছে দারুণ জনপ্রিয়।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিকেলের দিকে চলে যেতাম উত্তরায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতাম। তাঁর জীবনের গল্প, বেড়ে ওঠার গল্প। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম নেওয়া মানুষটি কীভাবে ১৯৮৩ সালে পদাতিক রেজিমেন্টে কমিশন পেলেন, তারপর বিএমএ, সেনা সদর হয়ে মিশনে গেলেন—সেই সব গল্প। আর বলতেন স্ত্রী ফাতেমা সুলতানা, দুই মেয়ে তাসনিয়া ও লামিয়ার কথা। গল্পের সময় একটি সিগারেটের আগুন দিয়ে আরেকটি সিগারেট ধরাতেন। রিং করে ছুড়ে ফেলা সেই ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যেত ফেলে আসা দিনের স্মৃতি।
২০০৫ সালে র্যাব একটি গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করে। গুলজার উদ্দিন সেই বিভাগের প্রথম প্রধান। হাটখোলায় র্যাব-৩-এর কার্যালয় ছেড়ে এলেন বিমানবন্দর এলাকায় র্যাব সদর দপ্তরে। আমারও যাতায়াত বেড়ে গেল। ২০০৬ সালে একদিন শুনি তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন। র্যাবে আর থাকছেন না। চলে গেলেন বাংলাদেশ রাইফেলসে (বিডিআর)। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মন খারাপের কারণ উবে গেল, তিনি আবার ফিরে এলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক হয়ে।
সারা দেশে তখন জেএমবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি শুরু করেছে জেএমবি। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬টি হামলায় ৭৩ জন নিহত আর প্রায় ৮০০ লোক আহত হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শেষ পর্যন্ত দেশে-বিদেশের চাপের মুখে চারদলীয় জোট সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জঙ্গি নির্মূলের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামেন গুলজার উদ্দিন। জঙ্গি দমন অভিযানে তিনি যে সাহস দেখাতেন, তা ছিল শিউরে ওঠার মতো।
এর মধ্যে একদিন একটি মজার ঘটনা ঘটে। জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান তখন রিমান্ডে। দুপুরের দিকে র্যাব সদর দপ্তরে গিয়ে দেখি সবার মুখ-চোখ শুকনো। পুরো অফিস থমথমে। একেবারে অন্য রকম একটি পরিবেশ। কী হয়েছে, কেউ বলছে না। খুব ঘনিষ্ঠ একজনকে অনুরোধ করতেই যা বললেন, শুনে পিলে চমকে গেল। তিনি বললেন, শায়খ আবদুর রহমান রিমান্ডে থাকা অবস্থায় র্যাব হেফাজত থেকে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। কীভাবে তিনি পালালেন? বললেন, ফজরের নামাজের জন্য সেলের তালা খুলে দেওয়া হয়। তখন অজু করার নাম করে পালিয়ে যান। মাথায় যেন বাজ পড়ল। এত বড় খবর কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। গেলাম তৎকালীন মহাপরিচালক আবদুল আজিজ সরকারের কাছে। তিনি যেন ভূত দেখলেন। গেলাম গুলজার উদ্দিনের কাছে। তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। দুই হাত ধরে খুব অনুরোধ করলেন খবরটা যেন প্রকাশ না হয়। অনুরোধে মানুষ ঢেঁকিও গেলে। ছোটবেলায় শোনা সেই প্রবাদ আমার জীবনেও সত্যি হলো। পেশাদার সংবাদকর্মীরা হয়তো এখন এসে উচিত-অনুচিত নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। কিন্তু বন্ধুত্বের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। অবশ্য সেদিন বিকেলেই টঙ্গীর একটি স্থান থেকে আবদুর রহমান ধরা পড়েন।
সবকিছুতেই ভালো-মন্দ দিক থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। তিনি আমাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, একজন সংবাদকর্মীর জন্য যা খুবই জরুরি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে গুলজার উদ্দিন কর্নেল পদে পদোন্নতি পেলেন। চলে গেলেন ২০০৯ সালের জানুয়ারির দিকে। সিলেট থেকে একদিন ফোন করে বেড়াতে আসতে বললেন। বললাম, বড় ঘটনা ঘটুক, নিশ্চয় যাব। শুনে হো হো করে হাসলেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, বুধবারের সকাল। নাশতা করা শেষ হয়নি, ফোন দিলেন প্রথম আলোর টেলিফোন অপারেটর সুফলা। পিলখানা থেকে কে একজন অফিসের নম্বরে ফোন করে বলেছেন সেখানে খুব গন্ডগোল হচ্ছে।
পিলখানায় সেদিন বিডিআরের বার্ষিক দরবার হওয়ার কথা। বিডিআরের কয়েকজন পরিচিত কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের ফোন দিলাম। কেউ ধরলেন না। গুলজার উদ্দিনের ফোন লাগাতার ব্যস্ত। একটু পর আবার সুফলার ফোন। বললেন, সেখানে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। আশপাশের বাসিন্দারা বারবার ফোন করছেন। অফিসে ফোন দিয়ে সবাইকে ঘটনা জানাতে বললাম। নিজেও বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। হঠাৎ ফোন—গুলজার উদ্দিনের ফোন। ভয়ার্ত কণ্ঠ। বাঘের মতো সাহসী মানুষের এমন কণ্ঠস্বর শুনে চমকে গেলাম। কথা বলছেন নিচু গলায়—ফিসফিসিয়ে। বললেন, ‘বিদ্রোহী সৈনিকেরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। বাঁচব কি না, জানি না। প্লিজ যাকে পারেন তাকে বলেন।’ শুনে রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। কী করব, কাকে ফোন দেব বুঝে উঠতে পারছি না। ফোন দিলাম ডিএমপির তখনকার কমিশনার নাঈদ আহমেদকে। তাঁর ফোন ব্যস্ত। র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকারকে ফোন করতেই তিনি বললেন ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হচ্ছেন। ফোন দিলাম আইজিপি নূর মোহাম্মদকে।তাঁর গলা কাঁপছে। বললেন, তাঁর সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে ও জামাতা আটকা পড়েছে। মেয়ে বারবার ফোন করে কাঁদছে। আইজিপির কথায় অসহায়ের সুর। এরপর থেকে গুলজার উদ্দিনকে আর ফোনে পাইনি। অপেক্ষায় থেকেছি, ফোন আর বাজেনি।
পরের ইতিহাস সবারই জানা। বিদ্রোহের দুই দিন পর পিলখানার গণকবর থেকে অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে গুলজার উদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গুলজার উদ্দিনের বোন শম্পা আফরোজ আমাদের জানান, বিডিআর সদর দপ্তরের সামনে থেকে ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে। বনানীর সামরিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন এলেই বনানীর সামরিক কবরস্থানে যাই, মনটা ভারী হয়ে আসে। কয়েক বছর আগে একবার দেখি ছোট মেয়েকে নিয়ে গুলজার উদ্দিনের স্ত্রী কবরস্থানে। সালাম দিতেই বললেন, ‘আপনাকেও তো তিনি ফোন করেছিলেন, কই বাঁচাতে পারলেন না!’ তাঁর দুই চোখে পানি। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, কোনো জবাব দিতে পারি না।
আসলেই, আমাদের মতো সাধারণ সংবাদকর্মীর বেশির ভাগ সময় চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। নিজেকে বড় অসহায় লাগে।
কুমিল্লার কৃষ্ণনগরে চার বছরের শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে মেহরাজ হোসেন তুষার (২৫) নামে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
১ ঘণ্টা আগেনাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় ১৮টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জোট সরকারের সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী আইনজীবী এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে খালাস দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মামলায়...
১ ঘণ্টা আগেডিবি পুলিশের পরিচয়ে সাভারের আমিনবাজারে সয়াবিন তেলবোঝাই একটি ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। দুর্বৃত্তরা ট্রাকচালককে মারধর করে চালকের সহকারীকে তুলে নিয়ে গেছে। আজ বুধবার ভোরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সালেহপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
১ ঘণ্টা আগে