র‍্যাপিড পাস প্রকল্প: বনিবনা না হওয়ায় চলে গেছে জাইকা

  • ডিটিসিএ এখন বিকল্প নিয়ে কাজ করছে
  • চুক্তিতেই গলদ ছিল, মত বিশেষজ্ঞের
  • র‍্যাপিড পাস নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না
সৌগত বসু, ঢাকা 
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯: ৩৮
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০: ৪৬
ফাইল ছবি

বিশেষায়িত কোম্পানির অংশীদারত্ব নিয়ে বনিবনা না হওয়াতেই র‍্যাপিড পাস ও এমআরটি পাসের ক্লিয়ারিং হাউস কার্যক্রম থেকে গত মার্চে সরে দাঁড়িয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এ বিষয়ে তাদের একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করত। তবে চালু রয়েছে র‍্যাপিড পাস। নতুন করে ক্লিয়ারিং হাউসের কারিগরি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ডিটিসিএ সূত্রে এ কথা জানা গেছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা নগর ও সংলগ্ন এলাকার টিকিটিং ব্যবস্থা সমন্বিতকরণ ক্লিয়ারিং হাউস (ফেজ-২) নামক প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাই মাসে নেওয়া হয়। ৮৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গণপরিবহনে ভাড়া আদায় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে র‍্যাপিড পাস কার্ডের (স্মার্ট কার্ড) বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে ক্লিয়ারিং হাউসের জন্য একটি বিশেষায়িত কোম্পানি (এসপিসি) গঠন করা। অন্যান্য উদ্দেশ্য ছিল ক্লিয়ারিং হাউস ও র‍্যাপিড পাস সিস্টেমের জন্য পরিচালনাবিষয়ক কার্যক্রম, সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রস্তুত করা এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অপারেটর (পিটিও), মেট্রোরেল লাইন-৬-এর সঙ্গে ক্লিয়ারিং হাউস সিস্টেমের সমন্বয়, গণপরিবহনের জন্য বাস ভ্যালিডেটর পদ্ধতি এবং

টিকিট অফিস মেশিন পদ্ধতি উন্নত করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা।

ক্লিয়ারিং হাউস হচ্ছে পরিবহন খাতের বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে প্রাপ্ত ভাড়া বণ্টনের প্রক্রিয়া। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ক্যাশ করাসহ এবং অন্যান্য লেনদেন পরিচালনার কাজে মাঝখানে থেকে ক্লিয়ারিং হাউস হিসেবে কাজ করে। ব্যাংকের ভাষায় বাংলায় একে বলা হয় ‘নিকাশী ঘর’।

ডিটিসিএ থেকে জানা যায়, এর আগে ক্লিয়ারিং হাউস (ফেস-১) প্রকল্পে পরিবহনসংক্রান্ত সব ধরনের আর্থিক লেনদেনের লক্ষ্যে ক্লিয়ারিং হাউস স্থাপন করা হয়। এই ক্লিয়ারিং হাউসের কাজ হচ্ছে একাধিক পরিবহনসেবাকে একটি সমন্বিত ভাড়া সংগ্রহ ব্যবস্থার অঙ্গীভূত করা। ক্লিয়ারিং হাউসের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিটি পরিবহন সেবা প্রদানকারীর মধ্যে ভাড়ার অর্থ বিতরণ করা হবে। র‍্যাপিড পাস কার্ড ইস্যু এবং রিচার্জ সেবা প্রদান করাও এর কাজের মধ্যে পড়ে।

তবে প্রকল্প সূত্র বলছে, জাইকার এই প্রকল্পের আগেই ২০১৭ সালে ডিটিসিএর তত্ত্বাবধানে র‍্যাপিড পাস চালু হয়েছে। এটি জাপানি কোম্পানি সনির ফেলিকা কার্ড। তবে এ কার্ডকে সমন্বিত করতে যে যন্ত্রপাতি কেনা হয়, তা হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। বর্তমানে র‍্যাপিড পাস নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যন্ত্রপাতি কেনাকাটা চলছে, একই সঙ্গে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। তবে এই ক্লিয়ারিং হাউস পরিচালনায় যে ধরনের ও যে জনবল দরকার, সেটি ডিটিসিএর বর্তমানে নেই। এ ছাড়া জাইকার বিশেষজ্ঞ দলও চলে গেছে।

ডিটিসিএ ও প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, জাইকার সঙ্গে সমস্যা তৈরি হয় বিশেষায়িত কোম্পানি গঠন করা নিয়ে। জাইকা চেয়েছিল প্রকল্পটি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। প্রস্তাব ছিল, কোম্পানি হলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তথা জাইকার নিয়ন্ত্রণে শেয়ার থাকবে ৫১ শতাংশ আর বাংলাদেশ সরকারের হাতে থাকবে ৪৯ শতাংশ। তবে জাইকা থাকাকালীন কোম্পানিটি তৈরি করা যায়নি। এ বিষয়ে জাইকা কোম্পানি করার জন্য চাপ দিয়েছিল সরকারকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিটিসিএর এক কর্মকর্তা বলেন, এই ধরনের কোম্পানি যদি সঠিকভাবে তৈরি না হয়, তাহলে দেশের জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি তৈরি হতে পারে। কারণ, এখানে তথ্য নিরাপত্তার বিষয়টি থাকে। এ জন্য সরকার এ বিষয়ে আইন করতে চেয়েছিল। সেই আইন করার সময় পর্যন্ত জাইকা থাকতে চায়নি। এখন কোম্পানি গঠিত হলেও তার বেশির ভাগ মালিকানায় থাকবে বাংলাদেশ সরকার।

ডিটিসিএ সূত্র বলছে, শুরুতে জাপানই এই ক্লিয়ারিং হাউস তৈরি করলেও কোম্পানি গঠন নিয়ে সমস্যা তৈরি হওয়ায় তাদের বিশেষজ্ঞ সহায়তার অংশটুকু সরিয়ে নিয়েছে। এখন ক্লিয়ারিং হাউস ডিটিসিএ থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ৷ এখন পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে ডেটা সফট নামের একটি কোম্পানিকে দিয়ে। আর ক্লিয়ারিং হাউসের সার্ভার ডিটিসিএ থেকে সরিয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে; পাশাপাশি ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৪-এর একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে।

জাপানি বিশেষজ্ঞ দল চলে গেলেও র‍্যাপিড পাস নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মো. মামুনুর রহমান। তিনি বলেন, তাঁদের কাজ চলমান আছে। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থায়ন বাংলাদেশ সরকারের। প্রকল্পের অর্থায়ন থেকেও জাইকা সরে যায়নি। গত ১৫ অক্টোবর এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ দল হঠাৎ চলে যাওয়ায় হয়তো আরও দুই বছর সময় লাগবে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৫২ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত একটা কার্ডের মাধ্যমেই ব্যাংকিং ও গণপরিবহন সেবার সুযোগ পাওয়া যায়। এখানেও এমন প্রযুক্তি চালু করা খুব কঠিন কিছু নয়। দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিকে দায়িত্ব দিলেই তারা করতে পারত, খরচও কম হতো। সরকারি ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘চুক্তির সময়ই গলদ ছিল। এমআরটি বা র‍্যাপিড পাসের জন্য জাপানি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, এটি ছিল চুক্তির ভুল। এখন জাইকা চলে যাওয়ায় ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবস্থার জন্য নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি চালুর সময় র‍্যাপিড পাস যেন বিকাশ, নগদ বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে সহজে রিচার্জ করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’

ডিটিসিএ বলছে, তাদের কাছে ৪ লাখের বেশি র‍্যাপিড পাস রয়েছে। প্রতিদিন মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো থেকে প্রায় দুই হাজার কার্ড বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বিক্রির জন্য প্রায় দেড় লাখ র‍্যাপিড পাস নিয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে র‍্যাপিড পাস সুবিধা পাওয়ার কথা বিআরটি (বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট), বিআরটিসির যানবাহন, সাধারণ ট্রেন এমনকি লঞ্চেও। বর্তমানে এ পাস শুধু মেট্রোরেলে চালু রয়েছে। এত দিন মেট্রোরেলে চালু থাকা এমআরটি পাস গত মাসে বন্ধ করা হয়েছে। নতুন করে আর এমআরটি পাস ইস্যু করা হবে না বলে জানিয়েছে ডিটিসিএ। এখন থেকে র‍্যাপিড পাস দিয়েই ভাড়া আদায়ের কাজ চলবে। সম্প্রতি সার্ভার মাইগ্রেশনের জন্য এমআরটি বা র‍্যাপিড পাসের রিচার্জ সুবিধা আংশিকভাবে বন্ধ আছে। মাঝে মাঝে র‍্যাপিড পাস কার্ড ইস্যু করা যাচ্ছে না। ৭ নভেম্বর থেকে সার্ভার আবার পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হবে।

এ বিষয়ে ডিটিসিএর বাস রুট র‍্যাশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম বলেন, জাপানের বিশেষজ্ঞ দল না থাকলেও ডিটিসিএ থেকেই ক্লিয়ারিং হাউসের কাজ চালানো হচ্ছে। আগামীতে রাজধানীর বাসগুলোতেও র‍্যাপিড পাস চালু হলে এর কার্যক্ষেত্র বাড়বে। তারা জানুয়ারি মাসের মধ্যে ঢাকা চাকা, গুলশান চাকা, হাতিরঝিল চক্রাকার বাস ও হাতিরঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সিতে ই-টিকিটিং চালু করতে চায়।

গত সোমবার সন্ধ্যায় জাইকার ঢাকা অফিসে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে ই মেইল করা হয়। তবে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টা পর্যন্ত মেইলের জবাব মেলেনি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত