যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের অর্থায়নে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে লালবাগ দুর্গের হাম্মামখানার সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। গতকাল মঙ্গলবার লালবাগ জাদুঘরের হলরুমে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের আয়োজনে লালবাগ দুর্গের হাম্মামখানার সংস্কার-সংরক্ষণ কার্যক্রমের অগ্রগতি বিষয়ক পর্যালোচনা ও অংশীজন সভা শীর্ষক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রত্নস্থান সংস্কার ও সংরক্ষণে বিদেশি অর্থায়ন এবং বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি এদিন আলোচনায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এ অবস্থায় পর্যালোচনা সভায় দেওয়া বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জানান, দেশের প্রত্নস্থানগুলোর যে সংস্কার ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট গবেষকদের অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতেই করা হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের কল্যাণের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।

লালবাগ দুর্গের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে মার্কিন দূতাবাসের অর্থায়নে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই সংস্কার কাজ বাস্তবায়ন করছে। ২০২১ সালের ২৪ মার্চ এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দুজন দেশীয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ, অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ এবং একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ ড. টি এম জে নিলান কোরেকে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। ত্রিমাত্রিক স্থাপত্যের ডকুমেন্টেশনের জন্য বিশেষায়িত ফার্ম হিসেবে আছে গ্লোবাল সার্ভে কনসালট্যান্ট।

বিদেশি অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেন হাম্মামখানার সংস্কার ও সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত দুই বিশেষজ্ঞ।

হাম্মামখানা সংস্কারের দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ জানান, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশের অর্থায়নে যখন কাজ হয়, তখন কনসাটেন্সি নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকে। ফলে সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজটি নির্ভুল হয়। তবে বিদেশি কনসালটেন্ট বাধ্যতামূলক করার কিছুটা সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশি বা বিদেশি মুখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয়টি হলো যে ধরনের স্থাপনা বা প্রত্নস্থানের কাজ করা হচ্ছে সেই বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞদের দিয়ে কাজটি করানো। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ থাকেন না। এর ফলে কাজের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয় বলেও উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ।

প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজে মার্কিন ও অন্যান্য বিদেশি অর্থায়নকে কীভাবে দেখেন আজকের পত্রিকার এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউনেসকোসহ যখন আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের কাজ হয় তখন ওই স্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করার শর্ত থাকে। এবার মধ্যযুগের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাকে অন্তর্ভুক্ত করায় পুরো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে লালবাগের হাম্মামখানার সংস্কার কাজ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।

এর ফলে এবার হাম্মামখানায় নতুন করে আরও তিনটি জিনিস আবিষ্কারের চমকপ্রদ তথ্যের কথাও জানান এই বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ। যার মধ্যে রয়েছে, হাম্মামখানার সিঁড়ি, নিচতলায় জানালার বদলে দোতলার খোলা চত্বরের মাধ্যমে হাম্মামখানায় আলো আসার ব্যবস্থা এবং পানি গরম করা, ঠান্ডা করার আলাদা স্থান ও পানি বেরিয়ে যাওয়ার পাইপসহ আলাদা নিষ্কাশন ব্যবস্থা।

এছাড়া এটি দরবার হল বলে যে ভুল ধারণা এত দিন প্রচলিত ছিল সেটিও এই সংস্কার কাজের মাধ্যমে সমাধান হতে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক শাহনাওয়াজ। পাশাপাশি পাকিস্তান আমলে সংস্কারের অনেক ভুল এবার সংশোধন করা সম্ভব হয়েছে বলে তথ্য দেন এই গবেষক। তিনি বলেন, এবার এত কিছু সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট একজন মধ্যযুগীয় গবেষক ও বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করার ফলেই। আর দেশীয় অর্থায়নে যে কাজ হয় সেখানে এ ধরনের শর্ত থাকে না। বরং অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষ লোকদের কাজ দেওয়ায় পুরো সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজটিই ভুল বা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং হিতে বিপরীত হয়। ইউনেসকোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের অংশগ্রহণ এ ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক বলেও উল্লেখ করেন তিনি।