Ajker Patrika

মায়েদের সেদিন মিথ্যে বলেছি

কামরুল হাসান
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২১, ১০: ৫১
মায়েদের সেদিন মিথ্যে বলেছি

ঢাকা: ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে যে বাড়ির নিচে এসে দাঁড়ালাম, সেখানে উৎকণ্ঠিত স্বজনদের ভিড়। ছিলেন ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন, তাহমিদের বাবা শাহরিয়ার খান, ফাইরুজ মালিহার বাবা বোরহান উদ্দীন আর অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। এ বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে হোলি আর্টিজান বেকারি–যেখানে তাঁদের সন্তানেরা জিম্মি হয়ে আছেন। সবারই ভরসা হাতের মোবাইল ফোন। হাজারো উড়ো খবর আসছে সে ফোনে। একটি ফোন এলেই উদ্বিগ্ন মুখগুলো মলিন হয়ে যাচ্ছে অজানা শঙ্কায়। সবার অপেক্ষা কখন সন্তানেরা ফিরে এসে ডাকবেন, মা ও মা…।

১ জুলাই, ২০১৬। রোজকার মতো কাজে ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। প্রথম ফোন করলেন আজিজা আহমেদ পলা, প্রথম আলো ট্রাস্টের তৎকালীন পরিচালন কর্মকর্তা। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সময় তিনি ছিলেন পাশের কোনো বাড়িতে। বললেন, হোলি আর্টিজানে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। দ্রুত যেন রিপোর্টার পাঠাই। এরপর নানা মাধ্যম থেকে খবর আসতে থাকে। ঘটনাও বড় হতে থাকে। প্রথম সংস্করণের কাজ শেষ করে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুনি পুলিশের ওপর হামলা হয়ে গেছে। র‍্যাব-পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলেছে। কাউকে ত্রিসীমায় ঘেঁষতে দিচ্ছে না। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কোনোমতে বেষ্টনীর ভেতরে ঢুকে দেখি, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন চুপচাপ। সবাই উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছেন। 

আমি এসে দাঁড়ালাম গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির নিচের তলায়। সামনে কয়েকটি বাড়ির পরই হোলি আর্টিজান বেকারি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সে বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেছেন।

হাতের ফোন বাজছে তো বাজছেই। ফোন বাজলেই এগিয়ে আসা মানুষের প্রশ্ন, কিছু জানা গেল? কেউ কি বেরোতে পারছে? জিম্মিকারীরা কি কোনো শর্ত দিল? আমি কোনো জবাব দিতে পারি না। ফোন পকেটে রেখে বলি, কেউ কিছু বলতে পারছে না।

সংবাদকর্মীদের সবাই চেষ্টা করছেন ভেতরে কী হচ্ছে তা জানার। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ভেতরে আটকে থাকা হাসনাত করিম নামের এক ব্যক্তি তাঁর চাচা আনোয়ারুল করিমকে ফোন করেছিলেন। সেই ফোনের সূত্র ধরে আনোয়ার করিম পুলিশকে জানিয়েছেন, হোলি আর্টিজানের ভেতরে জঙ্গিরা লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছে। পুলিশ গুলি চালালে তারাও সবাইকে মেরে ফেলবে। প্রথম খবর বলতে এটা ছিল নির্ভরযোগ্য সূত্র।

একটু পর র‍্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ আমাদের বললেন, ‘জঙ্গিরা ভেতরে আছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা চলছে।’ এর বেশি কেউ কিছু বলতে পারেন না। ওদিকে অফিস থেকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত রিপোর্ট পাঠানোর। আমরা আটকে পড়া লোকজনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন হোসেনের সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে যারেফ হোসেনও আছেন। সিমিন হোসেনকে প্রথম দেখায় হকচকিয়ে যাই। পরনে ঘরোয়া পোশাক, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। কাঁধের আটপৌরে ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছছেন। বললেন, তাঁর ছোট ছেলে ফারাজ ভেতরে আটকে আছে। কেমন আছে, কিছুই জানেন না। বলতে বলতে চোখ মুছলেন সিমিন হোসেন। একটু দূরে ছিলেন যারেফ। মাকে আগলে রাখছেন তিনি। অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। তাঁরও একই প্রশ্ন। বিবর্ণ চেহারা নিয়ে এগিয়ে এলেন আফতাব গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার খান। তাঁর সন্তান তাহমিদ ভেতরে আটকে আছে। মুঠোফোনে একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘ভাই, এটা আমার ছেলে। কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। একটু দেখবেন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় কি না।’ আমরা মাথা নাড়ি, কিছু বলতে পারি না।

বৃষ্টি আরও বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বজনদের উৎকণ্ঠা। তাঁরা ক্ষুব্ধ ও ব্যাকুল। মাঝরাতের পর একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সকালে কমান্ডোরা আসবেন, তারপর অভিযান হবে। এখন অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার নেই। বৃষ্টি মাথায় বসে থাকি আমরা।

রাত পৌনে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে থাকা র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান আবুল কালাম আজাদ (সিলেটে আতিয়া মহলে বোমা হামলায় নিহত) আমাকে ফোনে বলেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের মুখপাত্র ‘আমাক’ নিহত ব্যক্তিদের ছবিসহ খবর প্রকাশ করেছে। সেখানে ২০ জনের মৃতদেহ আছে। ফোন রেখে ‘২০ জন নিহত’ হয়েছে কথাটি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সিমিন হোসেন ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। জানতে চান, কে এই খবর দিল, কতটা সত্যি সে খবর। অবিন্তার মা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন। মালিহার বাবা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলেন। শাহরিয়ার খান আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকেন। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি উদ্বিগ্ন ও অসহায় মা–বাবার এই ব্যাকুলতার কাছে হার মানি। ইচ্ছে করেই একটি মিথ্যে বলি, জীবনে তো কত মিথ্যে বলেছি। বললাম, যিনি ফোন করেছিলেন তিনি ধারণা থেকে বলছেন। হয়তো সেটা ঠিক নয়। কিন্তু সিমিন হোসেন নাছোড়। এগিয়ে আসেন তাঁর ছেলে যারেফ, তিনি মাকে বুঝিয়ে শান্ত করেন।

এভাবে ভোর হয়ে আসে। সিলেট থেকে আসা কমান্ডোরা অভিযান শুরু করে। একটি করে গুলির শব্দ হতে না হতেই আর্তনাদ করে ওঠেন আটকে পড়াদের স্বজনেরা। ঘণ্টাখানেক পর গুলির আওয়াজ থেমে যায়। ভেতরে কমান্ডো অপারেশন শেষ। শাহরিয়ার খানের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। একটি নম্বর থেকে ছেলে তাহমিদ ফোন করেছেন। ছেলের কণ্ঠ শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। গোয়েন্দারা বললেন, হোলি আর্টিজানের ভেতরে কেউ বেঁচে নেই। আমি খবর শুনে কথা হারিয়ে ফেলি। কী করব ভাবতে পারছি না। নিজেকে খুব অসহায় লাগে। অবিন্তার মা পাশেই ছিলেন। সব শুনে তিনি পাথর হয়ে যান।

সিমিন হোসেন বারবার বলেন, ‘আমার ছেলের খোঁজটা এনে দাও ভাই।’ আমি নীরব হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকাই। আমার নীরবতার ভেতরে তিনি হয়তো সত্যিটা খুঁজে নেন। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। অঝোর ধারা চোখ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মায়ের শেষ ভরসাটুকু।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কক্সবাজারে বিমানঘাঁটিতে গুলি: যা বলছে আইএসপিআর, নিহতের মা-বাবা ও স্থানীয়রা

কক্সবাজার বিমান ঘাঁটিতে দুর্বৃত্তদের হামলা, সংঘর্ষে নিহত ১

ভারতের কাছে হারে পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্টকে ধুয়ে দিলেন শোয়েব

নতুন রাজনৈতিক দলের নাম ও প্রতীক নিয়ে কী প্রস্তাব এল, জানালেন আখতার

মালিককে ঘরে আটকে রেখে খামারে পেট্রল ঢেলে আগুন, পুড়ল ৮ গরু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত