হিট অফিসার বুশরা কি পারবেন ঢাকাকে শীতল করতে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৩, ২৩: ২৩
আপডেট : ১২ জুলাই ২০২৩, ১৬: ৪০

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রেকর্ড তাপমাত্রার সঙ্গে লড়াই করা বাংলাদেশের রাজধানীতে কোটি মানুষের ত্রাণকর্তা হতে এসেছেন নতুন এক হিট অফিসার। আশা করা হচ্ছে—এই নগরীর বাসিন্দাদের শীতল রাখার জন্য শৈশবের হারানো লেক, জলাশয় আর গাছপালা ফিরিয়ে আনবেন তিনি। 

গত এপ্রিলেই ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল; যা কিনা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এমন গরমে নগরীতে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। জলবাহিত রোগের কারণে হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়েছিল রোগী। 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে অন্তত ৩০ গুণ বেশি তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এ ছাড়া ইইউর কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে গত জুনকে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। 

চলতি বছর ঢাকায় তাপপ্রবাহের প্রকৃত অবস্থা প্রাপ্ত তথ্যের চেয়েও অনেক বেশি গুরুতর ছিল বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষক ইমরান হোসেন। 

এ অবস্থায় ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের ওপর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার প্রভাব সমন্বয় করতেই সাবেক সমাজকল্যাণ নির্বাহী বুশরা আফরিনকে হিট অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করেছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বুশরাই প্রথম এ ধরনের পদে অভিষিক্ত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক Arsht-Rockefeller Climate Resilience Center-এর সমর্থনে এই নিয়োগ প্রদান করা হয়। সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে শহরগুলোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করছে। 

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বুশরা আফরিন বলেন, ‘শৈশবে আমার দেখা ঢাকা এখন সম্পূর্ণ আলাদা।’ 

তিনি বলেন, ‘শহরটি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। একসময় এখানে প্রচুর পুকুর আর জলাশয় ছিল, গাছ ছিল সর্বত্র।’ 

তাপমাত্রার বড় ভুক্তভোগী দরিদ্ররা

 ২৯ বছর বয়সী হিট অফিসার বুশরার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামে মেয়ে। এ জন্য তাঁর নিয়োগ নিয়ে সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা দাবি করছেন, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বুশরার অভিজ্ঞতা বা দক্ষতার অভাব রয়েছে। 

বুশরা এর আগে তাঁর বাবার মালিকানাধীন একটি গার্মেন্টস ব্যবসা এবং খালার পরিচালিত একটি দাতব্য ফাউন্ডেশনে সামাজিক কল্যাণ নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি চান পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যেন কেউ তাঁকে চাকরির অযোগ্য না ভাবে। 

বুশরা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করছি। এটি আমাকে জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে।’ 

দুই মাস আগে নিয়োগের পর থেকে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, উন্নয়ন সংস্থা ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করছেন বুশরা। 

তিনি দাবি করেন, ঢাকার কালাচানপুরের মতো আশপাশের দরিদ্র এলাকগুলোতেই বেশি ফোকাস করবেন। কারণ এসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষের শীতাতপযন্ত্র ব্যবহারের সামর্থ্য নেই। বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, শহুরে দরিদ্ররা ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করেন। গরমে তাই সন্তানসহ মা, বয়স্ক ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

ঢাকায় তাপ সম্পর্কিত ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন সায়মা বীথি নামে ২৬ বছর বয়সী রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক কর্মী। তিনি জানান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর টিনশেড ঘরে দরিদ্ররা বাস করেন। সেখানে অসহনীয় গরম অনুভূত হয় এবং বিদ্যুদ্বিভ্রাটে অনেক সময় ফ্যান না চলার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। এ ছাড়া বিশুদ্ধ পানি ও সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা না পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়ে যায়। 

হিট অফিসার বুশরা জানিয়েছেন, নগর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ১০০টি পানির বুথ স্থাপন করেছে, যেন মানুষ সহজে পানি পান করতে পারে। বর্তমানে তিনি একটি মানচিত্র তৈরির কাজ করছেন, যেন তাপমাত্রা বাড়লে পিপাসার্ত মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন তাঁকে কোথায় যেতে হবে। 

বুশরার অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে—পানিসহ শীতল অঞ্চল, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং ছায়াযুক্ত বসার জায়গা স্থাপনের মতো কিছু বিষয়। 

এদিকে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মানুষকে রক্ষার পাশাপাশি শহরগুলোকে শীতল রাখার জন্য আরও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছেন পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে—ঢাকায় পার্ক, পুকুর, খাল ও নদীগুলোর মতো সবুজ স্থান দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাপ আটকে পড়ছে। বলা হয়েছে, ঢাকায় বর্তমানে সবুজ জায়গা মাত্র ৭ শতাংশ আর জলাশয় রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম। 

এসএম ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী আহসান বলেন, ‘নগর কর্তৃপক্ষের উচিত পার্ক ও জলাশয়ের মতো অত্যাবশ্যক অবকাঠামো নিয়ে ভাবা। এগুলো শহরকে শীতল এবং বাসযোগ্য রাখে। যদিও ঢাকা দক্ষিণ অংশের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি রাস্তা প্রশস্ত করতে পরিবেশ কর্মীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই শত শত গাছ কেটে ফেলেছে।’ 

তবে ঢাকা উত্তরের কর্তৃপক্ষ গাছ লাগানোর এবং পার্ক তৈরি করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে এবং যারা ছাদে বাগান করবে তাদের প্রণোদনারও পরিকল্পনা করেছে। 

বুশরা বলেন, সবুজ বেষ্টনী এবং শহুরে বন নগরীতে ‘শীতল জোন’ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। 

পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ

প্রতিবেশী ভারতে বিভিন্ন শহর, জেলা এবং রাজ্যগুলোর দ্বারা গৃহীত অর্ধশতাধিক তাপ প্রতিরোধক কর্ম পরিকল্পনা দেখা গেছে। 

দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’-এর ফেলো আদিত্য ভ্যালিয়াথান পিল্লাই বলেন, ‘তাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি বিভাগকে সুশীল সমাজ এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হবে। আর ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়ন করতে পারেন একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।’ 

বাংলাদেশে তাপমাত্রার ঝুঁকি কমানোর জন্য কাজ করছে বেশ কয়েকটি দল। এর মধ্যে আইসিএলইআই নামে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি জুবায়ের রশিদ জানিয়েছেন, তাঁরা টেকসই উন্নয়নের প্রচার করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে কাজ করছেন। 

এদিকে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জার্মান ও ডেনিশ রেডক্রসের সঙ্গে এক হয়ে তাপ মোকাবিলার আরও ভালো উপায় খুঁজে বের করতে শহুরে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কাজ করছে। 

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পরিচালক এম এ হালিম জানান, তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ এমন পরিবারগুলোকে স্বাস্থ্যসেবা এবং নগদ অনুদান প্রদান করবেন, যাঁরা গরমের কারণে আয় থেকে বঞ্চিত হন এবং হাসপাতালের ব্যায় বহন করতে পারেন না। 

বিভিন্ন ডেটা সহায়তার মাধ্যমে এ ধরনের সংস্থাই সরকারি বিভিন্ন প্রচেষ্টার পরিপূরক হতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন পিল্লাই। 

আর বুশরাও বলেছিলেন—নগর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে সক্ষম করা তার অগ্রাধিকারে আছে। 

নতুন হিট অফিসার বলেন, ‘সর্বশেষ লক্ষ্য হলো—হস্তক্ষেপগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করা এবং যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের সাহায্য করা।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত