নয়াচরে ৫৬ বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছে মাওলানা অছিউদ্দীনের পাঠাগার

হারুনূর রশিদ, রায়পুরা (নরসিংদী) 
প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩: ৪৩
আপডেট : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫: ২৩

নরসিংদীর রায়পুরার আড়িয়াল খাঁ নদের তীরের এক অজপাড়াগাঁয়ে গড়ে উঠেছে ‘জাগরণী পাঠাগার’। দুর্লভ বইয়ের এই সংগ্রহশালার মাধ্যমে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন মাওলানা অছিউদ্দীন। পাঠাগারটিতে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার বই। বর্তমানে মাওলানা অছিউদ্দীনের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান উম্মুল কুরা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার একটি অব্যবহৃত কক্ষে চলছে ১৯৫৬ সালের এই পাঠাগার। 

আদিয়াবাদে আড়িয়াল খাঁ নদের তীরের সিরাজনগর নয়াচর গ্রামের শিক্ষক মৃত হাজী মোহাম্মদ ইলিয়াছ মাস্টারের ছেলে অছিউদ্দীন আহমদ। জন্ম ১৯৪৬ সালে। কওমি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) করেন । ১৯৭৩-৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে বিএ পাস করেন। 

এবার বরং এই পাঠাগার গড়ে তোলার গল্পটি জানা যাক। ছেলেবেলায় বাবার বই পড়া দেখে বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। পড়াশোনার খরচ বাঁচিয়ে টিফিনের এক-দুই পয়সা বাঁচিয়ে জমাতে থাকেন টিনের বাক্সে। জমানো টাকায় কিনতেন পছন্দের বই। বইগুলো বাড়িতে রাখতেন বাক্সে ভরে। সহপাঠীরা বেড়াতে এলেই উঠোনে মেলে ধরতেন সেই বাক্স। বন্ধুরা বই দেখে রীতিমতো অবাক হতো! তাঁর জমানো বইয়ের অনুপ্রেরণায় বন্ধুদের নিয়ে ১৯৬৪ সালে গড়লেন পাঠাগার। নাম দিলেন ‘কিশোর সমিতি’। এ নামে চার বছর চলার পর যৌবনের পদচারণায় নতুন জাগরণে উজ্জীবিত হয়ে পাঠাগারটির নাম রাখেন ‘জাগরণী সমিতি’। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে পাঠাগারটি রেজিস্ট্রেশন পায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা পাঠাগারটি ২০১১ সালে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে নরসিংদী জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে ‘জাগরণী পাঠাগার’ নামে সনদ পায়। 

সিরাজনগর উম্মুল কুরা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার একটি অব্যবহৃত কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, জাগরণী পাঠাগারের টেবিলে বসে বই পড়া, সম্পাদনা, লেখালেখিতে ব্যস্ত ডা. অছিউদ্দীন। পাশের চেয়ারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী পাঠক জ্ঞানচর্চায় মগ্ন। 

পাঠাগারটিতে উপন্যাস, গল্প, কবিতাসহ ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভ্রমণ, রম্যরচনা, বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ের বই আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর রচনাবলিসহ পাঠাগারে আছে হাজার বিশেক বই। এ ছাড়া ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘প্রবাসী’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’ ইত্যাদি পত্রিকার সংখ্যা আছে। ৫৬ বছর ধরে বিভিন্ন পত্রিকার দুর্লভ কাটিং ১০টি বইয়ের আকরে আলাদা আলাদা বিষয় ধরে সংরক্ষণ করেছেন। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় খোলা রাখেন পাঠাগার। দূরদূরান্ত থেকে আসা পাঠক মুগ্ধ হন একজন মানুষের অসাধারণ এক কাজ দেখে। 

পাঠাগারটিতে যারা এসেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন ১৯৯০ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও জীবনানন্দ গবেষক উইলিয়াম রাদিচে, ২০০৮ সালে তৎকালীন নরসিংদী জেলার অ্যাডিশনাল ডিসি বিজয় কান্তিসহ বহু গুণীজন। সবাই পাঠাগারটি দেখে মুগ্ধ হয়ে পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেছেন। 

ডা. অছিউদ্দীন আহমদ পাঠাগার পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা করেছেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছেন এখনো। এ জন্য মানুষের কাছে ডা. অছিউদ্দীন নামেও পরিচিত তিনি। পাশাপাশি লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্পাদনা করেছেন মাসিক পত্রিকা ও সাময়িকী। তাঁর সম্পাদিত বই জাগরণ, অগ্রদূত, লাব্বাইক, নাজাত, নওরোজ পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আটটি। অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি ২২টি। 

রায়পুরা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও দীর্ঘকাল সহসভাপতি তিনি। ছিলেন ‘সাপ্তাহিক বার্তা’র স্টাফ রিপোর্টার। ১৯৭০ সাল থেকে দুই যুগ সিরাজনগর হাইস্কুল ও সিরাজনগর উম্মুল কুরা সিনিয়র মাদ্রাসায় বাংলা সাহিত্যে পাঠদান করান।
 
পাঠাগারে আসা আদিয়াবাদ সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, ‘আমার বাড়ি স্যারের বাড়ির পাশেই। একটা মানুষ বইয়ের জন্য এত পাগল হতে পারে, স্যারকে না দেখলে বুঝতামই না। আমি সময় পেলে পাঠাগারে পড়তে আসি।’ 

মুফতি মুহাম্মদ রাকিব বলেন, ‘তাঁকে দেখেই বই পড়ার আগ্রহ জন্মে। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে এলে বারবার পাঠাগারে ছুটে আসি।’ 

স্থানীয় শিক্ষক সাইফুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, উমর আলী মোল্লা, মুর্শিদা আক্তার বলেন, পাঠাগারটি আদর্শ মানুষ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। অজপাড়াগাঁয়ে পাঠাগারটি থাকায় গ্রামের এবং গ্রামের বাইরে যারা সবাই উপকৃত হচ্ছেন। 

সিরাজনগর উম্মুর কুরা ফাজিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ উমর ফারুক বলেন, ‘পাঠাগারটি ৫৬ বছর ধরে জ্ঞানের আলো বিতরণ করছে। এতে সমাজ উপকৃত হচ্ছে, মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ব্যক্তিজীবনে কাজে লাগাতে পারছেন। যুবসমাজ মাদকসহ বিভিন্ন অন্যায় থেকে বিরত থাকছে। ’

খুবই সাধাসাধি জীবনযাপন মাওলানা অছিউদ্দীনের। বহু বছরের পুরোনো টিনের ভাঙা ঘরেই পরিবার নিয়ে বাস তাঁর। ছয় সন্তানের জনক তিনি। বর্তমানে শরীরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগ বাসা বাঁধলেও পাঠাগারে সময় দেন।

ডা. অছিউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বই পড়াতে আনন্দ পাই, সে জন্যই আমার এই প্রচেষ্টা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জাগরণী পাঠাগারকে দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রামীণ পাঠাগারে পরিণত করার স্বপ্ন দেখি। ১৯৬৪ সালে পড়াশোনা করতে পুরান ঢাকায় ছিলাম। ফুটপাতে দোকানিরা বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসত। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা কিংবা এক টাকায় বই কিনতাম। দীর্ঘদিন ধরে আমি খেয়ে না-খেয়ে বইয়ের পাহাড়ই গড়েছি।’ 

নিজের পাঠাগারে কাজ করছেন মাওলানা অছিউদ্দীন। ছবি: আজকের পত্রিকাতিনি আরও বলেন, ‘যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির যুগে আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। নতুন প্রজন্ম মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহারে মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়েছে। এগুলো যত কম ব্যবহার হবে, ততই মঙ্গল। তাই নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করা অতি জরুরি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও গ্রামের মানুষের মধ্যে আলো ছড়াতে তিল তিল করে পাঠাগারটি গড়েছি। পাঠাগারের স্থায়ী কোনো স্থাপনা নেই। টাকার অভাবে বইয়ের যত্ন নিতে পারছি না। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে বড় উপকার হতো। আমার ছেলে মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহকে অসিয়ত করেছি, সে এই পাঠাগার দেখাশোনা করবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত