৯২ বছর ধরে বাংলাদেশের অমূল্য প্রত্নবস্তু কলকাতায়: সুফি মোস্তাফিজুর 

জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২২, ১৭: ৪১

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থার অমূল্য সাক্ষ্য বহন করে এমন একটি প্রত্নবস্তু ৯২ বছর ধরে কলকাতার সংগ্রহশালায় রয়েছে। তা ছাড়া কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার ও অন্যান্য প্রত্নস্থানে ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে উদ্ধারকৃত অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পাকিস্তানের গুদামে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে এমন দাবি করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ ও জাবি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে জাবির জহির রায়হান মিলনায়তনে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। 

এ সময় বক্তারা পাচারকৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু দেশে ফেরাতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানান। জাদুঘর দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘পাওয়ার অব মিউজিয়াম।’ 

সেমিনারের স্বাগত ভাষণে অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর বলেন, ‘প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে (মহাস্থানগড়ে) ১৯৩০ সালে আবিষ্কৃত হয় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি শিলালিপি। ব্রাহ্মী হরফে লেখা প্রাকৃত ভাষার শিলালিপিটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম লেখনীর সাক্ষ্য বহন করে। মহাস্থান শিলালিপিটি তৎকালীন শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থার অমূল্য সাক্ষ্য। ১৯৩০ সালে বর্তমান বাংলাদেশ তখন অখণ্ড ভারতের অংশ ছিল বিধায় অমূল্য প্রত্নবস্তুটি ভারতীয় সংগ্রহশালা কলকাতায় নেওয়া হয়।’

সুফি মোস্তাফিজুর আরও বলেন, ‘অতীব দুঃখের বিষয় দেশ ভাগ হয়ে হওয়ার ৭৫ বছর পরও মহাস্থান শিলালিপিটি ভারতীয় সংগ্রহশালা, কলকাতায় রয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার ও অন্যান্য প্রত্নস্থানে ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে বড় আকারের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়েছিল। উৎখননে আবিষ্কৃত অসংখ্য প্রত্নবস্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য প্রত্নবস্তুগুলো স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আর ফেরত আসেনি। বর্তমানে সেগুলো পাকিস্তানের গুদামে অবহেলায়-অযত্নে পড়ে আছে।’

সেমিনারে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জানান, ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন কাল থেকেই খুবই সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে গড়ে উঠেছে মানববসতি। নদীবাহিত দেশে অনেক অনুকূল এবং নানান সময়ে প্রতিকূল অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে। দুই হাজার বছর পূর্বে সারা পৃথিবীর মধ্যে জিডিপিতে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাশ্চাত্যের সম্রাট আলেকজান্ডার পৃথিবী জয়ের নেশায় যুদ্ধে বেরিয়ে পড়েন। পারস্য জয় করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু ভারতবর্ষে পূর্বে গঙ্গাঋদ্ধি জাতির বীরত্বের খবর পেয়ে ভয়ে নিজ দেশে ফেরত যান। সেই গঙ্গাঋদ্ধি জাতির বসবাস ছিল বাংলাদেশে।’

আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ, বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের আজকের এই মহতী অনুষ্ঠান থেকে আমাদের ন্যায্য দাবি ভারত এবং পাকিস্তান থেকে আমাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ শেকড়ের পরিচয় প্রত্নবস্তু গুলো ফেরত চাই। সমগ্র বিশ্বে উপনিবেশ শাসনকালে সংগৃহীত বহু প্রত্নবস্তু স্ব স্ব দেশে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি জার্মানি নামিবিয়ার অনেক প্রত্নবস্তু ফেরত দিয়েছে। ব্রিটিশ জাদুঘর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত্নবস্তু ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে কেনিয়া। প্রত্নবস্তু ফেরত দানের নজির অনেক দীর্ঘায়িত করা যাবে। আশা করি আমাদের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বর্তমান ধারা অনুসরণ করে ভারত ও পাকিস্তান থেকে অমূল্য প্রত্নবস্তু ফেরত আনার আশু উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ আইন ও নীতি অনুসারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’

পাশাপাশি বক্তারা দাবি জানায়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাঁদের মূল পাঠ্য প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের সঙ্গে জাদুঘর বিষয়ক দুটি কোর্স অধ্যয়ন করে। তাই দেশের জাদুঘরগুলোতে কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন বক্তারা। ছবি: আজকের পত্রিকাপ্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘জাদুঘর আমাদের অতীত মানুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমন্ধে জানায়। অতীতের এসব ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আমরা বর্তমানের সঙ্গে সমন্বয় করে সামনে পথচলার অনুপ্রেরণা পাই। এ জন্য বাংলাদেশের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জাদুঘরের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত করা উচিত।’

এ ছাড়া সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সিকদার জুলাকারনাইন এবং আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জয়ন্ত সিংহ রায়।

অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক শেখ মনজুরুল হক, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতার, কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হকসহ প্রমুখ।

উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালে আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ১৫৮ টি দেশের প্রায় ৪০ হাজার জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার মাধ্যমে এটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের জাতীয় জাদুঘর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংগঠনটি প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ও জাদুঘর বিষয়ক বিভিন্ন সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে সংগঠনটি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত