খুলনায় দুই সহোদরের বাহিনী গড়ে জমি দখল

কাজী শামিম আহমেদ, খুলনা
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৯: ৫২
Thumbnail image

খুলনা মহানগরীর রূপসা সেতু থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে শিরোমনি পর্যন্ত সিটি আউটার বাইপাসের দুপাশে তাকালেই চোখে পড়ে ‘বিশ্বাস প্রোপার্টিজ’ ও ‘নিউ বিশ্বাস প্রোপার্টিজ’ নামের প্যানা ও বিলবোর্ড। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক আজগর আলী বিশ্বাস তারা ও তাঁর ভাই তারেক বিশ্বাস। তাঁরা নগরীর রায়ের মহল এলাকার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।

কিন্তু সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শত শত একর জমি দখল করে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন। সম্প্রতি দ্বিতীয় স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে তারেক বিশ্বাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই ভাইয়ের অপকর্মের কাহিনি প্রকাশ হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দুই ভাই দখলদারির স্বার্থে এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। তাঁদের হাতে মৎস্যচাষি ও জমির মালিকেরা জিম্মি। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তারা বিশ্বাস স্কুলে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে খুলনা-৫ আসনে জামায়াত নেতার পক্ষে প্রচার করেন। তখন একটি বিমা কোম্পানির মাঠকর্মী ছিলেন। একই সময়ে হামিদনগর এলাকায় একটি সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি বানিয়ে সভাপতি হন।

অভিযোগ আছে, ওই সমিতির সদস্যদের সঞ্চয়ের ৪ লাখ টাকা এবং বিমা কোম্পানির গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে খুলনা থেকে উধাও হয়ে যান। চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়কালে তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তারা বিশ্বাস খুলনায় ফিরে জমির দালালি শুরু করেন। পরে আবাসন ব্যবসায়ী বনে টাকার বিনিময়ে বাগিয়ে নেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্যপদ। তারা বিশ্বাস ছাত্রশিবির থেকে অনুপ্রবেশকারী কি না, জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত অধিকারী 

আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগটি শুনেছিলাম। কিন্তু বিএল কলেজে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, অভিযোগ সঠিক না।’

জমি দখলের অভিনব কৌশল: পূর্ববিল পাবলা এলাকার নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস অভিযোগ করেন, তারা বিশ্বাস তাঁর শূন্য দশমিক ২৫ একর জমি ৫০ লাখ টাকা দাম ধরে নিজের নামে আমমোক্তারনামা করে নিয়েছিলেন প্লট বেচে টাকা পরিশোধ করার শর্তে। কিন্তু তিনি প্লট আকারে জমি বিক্রি করলেও তাঁর টাকা দেননি। নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘আমি টাকা ফেরত পেতে মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুজিত অধিকারীর কাছে লিখিত আবেদন করে ঘুরছি। কিন্তু প্রতারক তারা বিশ্বাস এখন বলছে, তোকে আমি চিনি না।’

এ প্রসঙ্গে সুজিত অধিকারী বলেন, ‘নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি আমাদের কাছে তারা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জমি সম্পর্কিত লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। পরে বিষয়টি সমাধান হয়েছে বলে অভিযোগকারী জানিয়েছে।’ 

মৎস্য ঘের ব্যবসায়ী মোল্লা জিহাদুল ইসলাম বলেন, ‘তারা বিশ্বাস চক আসানখালী মৌজায় আর এস ১২৮২ ও ১২৮০ নম্বর দাগের ঘেরটি দখল করে বাঁশের বেড়ায় আটকে দিয়ে আমার মৎস্য ঘেরের ভেতরে বালু ফেলে ৫ লাখ টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় অভিযোগ দেওয়া হলে আদালতের নির্দেশে বালু ফেলা বন্ধ রয়েছে।’

রায়েরমহল বাজার এলাকায় কালাম কমিশনারের ৫ বিঘা জমি দখল করে নেওয়ার অভিযোগ আছে।  ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা বিশ্বাসের জমি দখলের বাহিনীপ্রধান মাইদুল। রাস্তার পাশে একখণ্ড জমি কিনে বালু ফেলে পেছনের জমির মালিকদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়ে কম দামে জমি বেচতে বাধ্য করা হয়। প্রতিবাদ করলে কিংবা কোনো কৃষক জমি দিতে না চাইলে মাইদুলের নেতৃত্বে নির্যাতন চালায় এবং জমি দখল করে নেয়। 

রূপসা, জিরো পয়েন্ট, বয়রা, রায়েরমহল, আড়ংঘাটা, দেয়ানা, ডুমুরিয়ার বিল পাবলা, চর হাসান খালি, কৈয়াসহ আশপাশের এলাকায় একসময় প্রচুর পরিমাণে ধান ও মাছ চাষ হতো। কিন্তু সেই ধানখেত ও মৎস্য খামার আর নেই। সেখানে ধু ধু বালুর মাঠ। সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শত শত বিঘা জমি দখল করে বিশ্বাস প্রপার্টিজের নামে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের সরকারি খাল দখলের কারণে শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, মৎস্য ঘের ও কৃষিজমি ভরাট করে যারা আবাসন বাণিজ্য করছে, সে যতই প্রভাবশালী হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগ সম্পর্কে আজগর বিশ্বাস তারা বলেন, ‘আমি কারও জমি জোর করে দখল করিনি। যারা জমি বিক্রি করতে আসছে, তা-ই কিনতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোনো সরকারি জমি ভরাট ও দখল করিনি। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি কিনে ব্যবসার জন্য ভরাট করছি। এ ছাড়া আমার সম্পর্কে অন্য যেসব অভিযোগ শুনছেন, তা ঠিক নয়।’

হত্যার অভিযোগ তারেকের বিরুদ্ধে: তারেকের দ্বিতীয় স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিলি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান। গত ২৫ মার্চ খুলনার আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন নিহত মাহমুদার মা সেলিনা বেগম। এতে তারেক ও তাঁর প্রথম স্ত্রীসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। মাহমুদাকে নির্যাতনের দৃশ্যসংবলিত বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ সাংবাদিকদের সরবরাহ করেছেন সেলিনা। 

সেলিনা বেগম বলেন, ‘বিভিন্ন সময় যৌতুকের জন্য আমার মেয়েকে মারধর করত তারেক। এসব নির্যাতনের অনেক ছবি ও ভিডিও দেখিয়েছে। কিন্তু মেয়ের সংসারের কথা চিন্তা করে আমরা চুপ ছিলাম।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও হরিণটানা থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভিডিও রেকর্ডগুলো সংগ্রহ করেছি। মাহমুদার মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা প্রয়োজন। এ জন্য লাশ তোলার আবেদন করা হয়েছে। তারেককে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত