১০ গ্রামের মানুষের ভরসা নড়বড়ে এক বাঁশের সাঁকো

জাহিদ হাসান, যশোর
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪: ১৩
Thumbnail image

যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ভৈরব নদের শাখা বুড়িভৈরব নদ। এর পূর্ব পাশে ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম আর পশ্চিমে আটটি গ্রাম। এর মধ্যে ১০টি গ্রামের বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য পেরোতে হয় ঝুঁকিপূর্ণ একটি বাঁশের সাঁকো। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে গ্রামগুলোর আনুমানিক ২০ হাজার মানুষ। 

দুই পাড়ের স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের যেমন সাঁকোটি পারাপার হতে হচ্ছে, তেমনি কৃষিপণ্য ও অন্যান্য মালামাল বহনে ভোগান্তির শেষ নেই। ২০০ ফুট দীর্ঘ একটি সেতুর অভাবে প্রতিনিয়তই কৃষিপণ্য পরিবহনে স্থানীয়দের ঘুরে যেতে হয় ১২ কিলোমিটার বাড়তি পথ। স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়েক যুগ ধরে শুধু প্রতিশ্রুতিই দিয়ে যাচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু সেতুর দেখা মিলছে না। জনদুর্ভোগ কমাতে নদের ওপর সেতু নির্মাণে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তাঁরা। 

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুড়িভৈরব নদের ওপর স্থানীয় জনগণ নিজ উদ্যোগে প্রায় দুই দশক আগে একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করেন, যা দুই বছর পর পর নতুন করে নির্মাণ করতে হয়। সাঁকোটি সংস্কারও করছেন তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে। ওই শাখা নদের পূর্ব পাশে কচুয়া ইউনিয়নের মুনসেফপুর, মথুরাপুর, ভাগু, দিয়াপাড়া, ভগবতিলতা, ঘোপ, নরসিংহকাটি ও নিমতলী। আর পশ্চিমে রায়মানিক, কচুয়া, সাতকচু, আবাদ কচুয়া, পুড়া কচুয়া ও সাতঘরিয়া গ্রাম। ১৪টি গ্রামের মধ্যে ১০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ ওই সাঁকো ব্যবহার করে। তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা শহর, হাটবাজার কিংবা ফসলি জমা যাতায়াতে সাঁকোটি ব্যবহার করতে হয়।

সাঁকোটি দুই বছর পরপর নতুন করে নির্মাণ করতে হয়। ছবি: আজকের পত্রিকাসরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁশের তৈরি সাঁকোটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। নদের পশ্চিম পাশে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় পূর্ব পাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা ঝুঁকি নিয়ে যাওয়া-আসা করছে। একটু অন্যমনস্ক হলে যেকোনো সময় পড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। 

দুই পাড়ের মানুষের দুর্ভোগের ঘটনা বর্ণনা করে মুনসেফপুর এলাকার বৃদ্ধ বাসিন্দা অশোক কুমার দত্ত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাগো দুঃখকষ্টের কথা কেউ শোনে না। বর্ষার সময় সাঁকোটি পার হওয়া অনেক কষ্টের। গাঙ (নদী) ভরা পানি থাকে। তখন সাঁকোটি নড়বড়ে হয়ে যায়। আমগরে কষ্ট কেউ বোঝে না। বহু বছর ধরে শুনি, এখানে সেতু হবে। এমপি-চেয়ারম্যানরা কতবার এসেছে, কিন্তু কখনো আর সেতু হলো না। হবে কি না, সেটাও জানি না।’ 

শুভরঞ্জন দত্ত নামের এক জেলে বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে এতগুলো গ্রামের মানুষ এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করে আসছে। রাতের বেলায় টর্চ দিয়া পা টিপে টিপে চলাচল করতে হয়। সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। 

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুদীপ্ত দত্ত বলে, ‘নদের পাশেই একটা হাইস্কুল রয়েছে। সাঁকো পার হয়ে যাওয়া লাগে বলে মা-বাবা ওই স্কুলে ভর্তি করেননি। ১৫ কিলোমিটার দূরে রূূপদিয়ায় একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছি।’ 

সুকুমার নামে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলে, ‘অনেক ভয় নিয়ে এই সাঁকো পার হতে হয়। অনেকেই এই ভয়ের কারণে অনেক দূরের স্কুলে ভর্তি হয়েছে।’ 

এ ছাড়া মুনসেফপুর গ্রামের নদের গা ঘেঁষে একটি মন্দির রয়েছে। পূজা-অর্চনা করতে নদীর অপর পাড়ের বাসিন্দাদের সাঁকো পেরিয়ে যাতায়াত করতে হয়।
 
কচুয়া গ্রামের বাবুল হোসেন বলেন, ‘গ্রামগুলো কৃষিনির্ভর। নানা রকমের কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কৃষিপণ্যের সঠিক দাম পাওয়া যায় না। একটি সেতুর কারণে ওই সব গ্রামে তেমন কোনো উন্নয়নও হয়নি। কোনো রকমে যাতায়াতের জন্য এলাকাবাসী বাধ্য হয়ে বাঁশের দীর্ঘ সাঁকো তৈরি করে নিয়েছেন।’ 

তিনি বলেন, ‘নদের ওপারে আমাদের অনেক জমি আছে, চাষাবাদের উৎপাদিত ফসল আনতে হলে পার্শ্ববর্তী নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে ১২ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়। এতে সময় এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়।’ 

দেলোয়ার হোসেন নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘অনেক বছর ধরে আমাদের বাঁশের সাঁকো তৈরি করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। কেউ আমাদের রাস্তা এবং একটি সেতু নির্মাণ করে দিচ্ছে না। আমরা কি এ দেশের নাগরিক না? আমরা তো সরকার বা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ভোট দিই। তাঁরা কেন আমাদের দিকে তাকায় না? আমরা বছরের পর বছর দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করছি। আমাদের দুর্ভোগ লাগবে এখানে একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।’ 

স্থানীয় কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান ধাবক আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাঁশের সাঁকোর ওপর স্থায়ী সেতু নির্মাণের জন্য জেলা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বরাবর বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া মিলছে না। নদের দুই পাড়ের অন্তত ২০ হাজার মানুষ সাঁকো নিয়ে সমস্যায় আছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই ডিজিটাল যুগেও এখানকার মানুষ বাঁশের সাঁকোর ওপর নির্ভরশীল, এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। ওই স্থানে সাঁকোর বিকল্প একটি পাকা সেতু নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। 

স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওই স্থানে সেতু নির্মাণের বিষয়টি আমাদের তালিকায় নেই। উপজেলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত