ঢাকায় রিকশা চালাতেন, অবরোধে বাড়ি ফিরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ

দেবাশীষ দত্ত, কুষ্টিয়া
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ২২: ৩৫

ঢাকায় রিকশা চালাতেন তসলিম আলী মণ্ডল (৫২)। সম্প্রতি অবরোধে বাড়ি ফেরেন। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে টানাটানির সংসার। গত ১ নভেম্বর ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু আবারও অবরোধের ঘোষণা এলে গ্রামেই থেকে যান। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গত ১ নভেম্বর বিকেলে একই গ্রামের এক জেলের সঙ্গে পদ্মায় মাছ ধরতে যান। এরপর ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সন্ধান মেলেনি।

নিখোঁজ তসলিমের ছোট ভাই লিটন আলী মণ্ডল এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলেন। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাঁর সন্ধান পেতে পরিবারের লোকজন সাধ্যমতো তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অভাবের সংসারে সেই তৎপরতা কতক্ষণ চালিয়ে নিতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, গত ১ নভেম্বর বিকেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নৌকা নিয়ে দুই জেলে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার রায়টা ঘাট এলাকায় মাছ ধরছিলেন। নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে সেখানে স্পিডবোটে অভিযানে যান জেলা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা। অভিযানে তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা ছিলেন। এ সময় নদীতে অভিযান পরিচালনাকারী স্পিডবোট দেখতে পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন তসলিম।

তবে তসলিমের পরিবারের দাবি, মাঝ নদীতে মারধর করলে তসলিম নৌকা থেকে নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ তসলিম আলী মণ্ডল ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা পশ্চিমপাড়া পাড়া এলাকার বাসিন্দা।

এদিকে ঘটনার রাতেই অভিযানে থাকা দুই পুলিশ সদস্যকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।

মাছ ধরার সময় তসলিমের সঙ্গে থাকা জেলে রায়টা গ্রামের নাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আর তসলিম সেদিন বিকেলে পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে যাই। এ সময় স্পিডবোট নিয়ে অভিযানে আসেন মৎস্য কর্মকর্তারা। তাঁদের সঙ্গে মৎস্য অফিসের কর্মচারী ও পুলিশ ছিল। তারা আমাদের নৌকার কাছে আসে এবং লাঠি দিয়ে তসলিমকে আঘাত করে। তাদের আঘাতে তসলিম নদীতে পড়ে যান। এরপর তিনি পানিতে ভেসে উঠলে আবারও লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। এরপর তিনি তলিয়ে যান। সে সময় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আমি পালিয়ে আসি। আমাদের জেল জরিমানা করতে পারত তারা।’

ভেড়ামারা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শাম্মী শিরিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা রুটিন মাফিক জেলা মৎস্য কর্মকর্তার সমন্বয়ে স্পিডবোট নিয়ে পদ্মা নদীতে অভিযানে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখে মাছধরা জেলে নৌকা জোরে চালাতে গিয়ে একজন জেলে পানিতে পড়ে যান। তবে আমরা কোনো জেলেকে আঘাত করিনি।’

ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা নদীতে মৎস্য কর্মকর্তারা অভিযানে যাবে তা আমাকে আগে থেকে জানায়নি। যে পুলিশ সদস্যরা অভিযানে গিয়েছিল, তাদের এসপি স্যারের নির্দেশে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।’

ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আকাশ কুমার কুন্ডু আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তিকে জীবিত বা মৃত উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন থেকে দুই দিন ডুবুরি দল উদ্ধার কাজ চালিয়েছে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এমনটা আমরাও শুনেছি। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে এ ঘটনার পর রাখার জায়গা না থাকার অজুহাত দেখিয়ে অভিযানে ব্যবহৃত স্পিডবোটটি ফেরত দিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। পরে মৎস্য অধিদপ্তর সেই স্পিডবোটটি রাজশাহী অঞ্চলে সরবরাহ করেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য অফিসের কয়েকজন জানান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছাড়াই ভেড়ামারার পদ্মা নদীতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে তসলিম নিখোঁজ হওয়ার পর ভবিষ্যতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা জানান, পদ্মা নদীর তালবাড়িয়া ঘাট এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন স্পিডবোট থাকলেও জেলা মৎস্য অফিসের স্পিডবোট রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা হওয়ার কথা না।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি কুষ্টিয়া অঞ্চলে ইলিশ শিকার বন্ধের সময়ে নদীতে অভিযান চালানোর সুবিধার্থে গত ১৪ অক্টোবর প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক এই স্পিডবোটটি কুষ্টিয়ায় সরবরাহ করেন।

কুষ্টিয়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুল বারী দেশের বাইরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শরীফ হাসান সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধার কারণে কুষ্টিয়া মৎস্য অধিদপ্তর থেকে স্পিডবোটটি ফেরত নিতে ঢাকায় চিঠি দেওয়া হয়। পরে তা রাজশাহীতে স্থানান্তর করা হয়। গতকাল সোমবার স্পিডবোটটি রাজশাহীতে পৌঁছেছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত