কর্মীসংখ্যার ভোটও পাননি যশোরে জাপার ৬ প্রার্থী, হারিয়েছেন জামানত

জাহিদ হাসান, যশোর
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ২১: ৪০
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ২১: ৪৪

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যশোরের ছয়টি সংসদীয় আসনেই দলীয় প্রার্থী দেয় জাতীয় পার্টি (জাপা)। নির্বাচনে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রার্থীরা করেছিলেন প্রচার-প্রচারণা। ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা মন জয়ের চেষ্টা করেন ভোটারদের। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। নির্বাচনে জাপা প্রার্থীরা কেবল হারেননি, জামানতও হারিয়েছেন। গতকাল রোববার পাওয়া নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী তাঁরা কর্মীসংখ্যার ভোটও পাননি। 

এদিকে, নিজেদের শোচনীয় পরাজয়কে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণেই হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাপা প্রার্থীরা। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না জাতীয় পার্টি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া জাতীয় পার্টি বারবার নির্বাচনে অংশ নেওয়াতে জনগণ ও নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে। এসব কারণে দলটির অবস্থা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ে, যা নির্বাচনে স্পষ্ট হলো। 

যশোর-১ আসন 
যশোর-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন মো. আক্তারুজ্জামান। নির্বাচনে ১০২টি কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকের এই প্রার্থী পেয়েছেন দুই হাজার ১৫১টি ভোট। নৌকার প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিন ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। আফিল উদ্দিনের নিকটতম স্বতন্ত্র প্রার্থী বেনাপোলের সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম লিটন পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৭৭ ভোট। সংগৃহীত মোট ভোটের শতকরা সাড়ে ১২ শতাংশের কম ভোট পাওয়ায় জামানত হারিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী আক্তারুজ্জামান। 

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসনটির ৪০ শতাংশ কেন্দ্রেই পোলিং এজেন্টের তালিকা করেছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। এই প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনায় কর্মী ছিলেন পাঁচ হাজারের বেশি। তবে নির্বাচন শেষে দেখা গেছে তিনি পেয়েছেন মাত্র দুই হাজার ১৫১ ভোট। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল জামানতই হারিয়েছেন তিনি। 

জাতীয় পার্টির প্রার্থী আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘এই আসনে দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টি কোনো প্রার্থী দেয় না। সর্বশেষ ২০০১ সালের পর আমি এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম। অনেক কর্মী ছিল; তবে কর্মী অনুযায়ী ভোট পাইনি।’ 

যশোর-২ আসন 
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন ফিরোজ শাহ। নির্বাচনে ১৭৬টি কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকের এই প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৯৫০ ভোট। বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তৌহিদুজ্জামান তুহিন। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৩৫৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক প্রতীকের মনিরুল ইসলাম মনির পেয়েছেন ৭৫ হাজার ৮৮২ ভোট। 

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসনটির ৮০ শতাংশ কেন্দ্রেই পোলিং এজেন্টের তালিকা করেছিলেন জাপা প্রার্থী। তাঁর নির্বাচন পরিচালনায় কর্মী ছিলেন আট হাজারের বেশি। তবে নির্বাচন শেষে দেখা গেছে তিনি পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৯৫০ ভোট। খোয়ালেন জামানতই। 

ফিরোজ শাহ বলেন, ‘ভোট গ্রহণের দিন ১২টা পর্যন্ত ভালো ছিল। ১টার পরে নৌকা ও স্বতন্ত্র ভোট ভাগাভাগি করে নিয়েছে। দুই উপজেলায় ৭-৮ হাজার কর্মী ছিল। তবে তাঁরা কেউ ভোট দিতে আসেননি। এ ছাড়া ভোট কারচুপি হয়েছে। আমার ভোট আরও বাড়ার কথা।’ 

যশোর-৩ আসন 
যশোর-৩ (সদর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন মাহবুব আলম। নির্বাচনে ১৮৯টি কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ৩ হাজার ৭১০ ভোট। আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কাজী নাবিল আহমেদ পেয়েছেন ১ লাখ ২১ হাজার ৮৩৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের প্রার্থী মোহিত কুমার নাথ পেয়েছেন ৬৪ হাজার ৭১০ ভোট। আসনটির ৬০ শতাংশ কেন্দ্রেই পোলিং এজেন্টের তালিকা করেছিলেন। এই প্রার্থী নির্বাচন পরিচালনায় কর্মী ছিলেন ৭ হাজারের বেশি। তবে নির্বাচন শেষে দেখা গেছে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ৭১০ ভোট। একই সঙ্গে হারিয়েছেন জামানত। 

মাহবুব আলম বলেন, ‘অনেক কর্মী–সমর্থক থাকলেও তাঁরা ভোট দিতে আসেননি। কেননা ভোটের আগে ও ভোটের দিন আসনে ১৫টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। এ ছাড়া এখন নির্বাচন অর্থ, অস্ত্র আর পেশিশক্তি নির্ভরতা হয়ে পড়েছে। এসব না থাকলে এখন বিজয়ী হওয়া যায় না।’ 

যশোর-৪ আসন 
যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হন জহুরুল হক। ১৪৯টি কেন্দ্রে তিনি ১০ হাজার ৩৫৬ ভোট পেয়েছেন। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এনামুল হক বাবুল ১ লাখ ৮১ হাজার ২৯৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আসনটির ৬০ শতাংশ কেন্দ্রেই পোলিং এজেন্টের তালিকা করেছিলেন। এই প্রার্থী নির্বাচন পরিচালনায় কর্মী ছিলেন ১৫ হাজারের বেশি। এরপরেও কর্মী সংখ্যক ভোট পাননি তিনি। হারিয়েছেন জামানত। 

যশোর-৫ আসন 
যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন এম এ হালিম। ১২৮টি কেন্দ্রে তিনি ভোট পেয়েছেন ৬২৪। যদিও ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। ভোট পরিচালনার জন্য তিনি ১০ হাজার কর্মী নিয়োজিত করেছিলেন। ভোট শেষে তিনি সেই কর্মী সংখ্যক ভোট পাননি তিনি। হারিয়েছেন জামানত। 

এম হালিম বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে দলের অব্যবস্থাপনা কারণে দলের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। প্রার্থী হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় নেতারা কোনো খোঁজ–খবর নেননি।’ দলের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। 

যশোর-৬ আসন 
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন জি এম হাসান। ৮১টি কেন্দ্রে ঈগল প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ৬৪০ ভোট। আসনটির ৪০ শতাংশ কেন্দ্রেই পোলিং এজেন্টের তালিকা করেছিলেন। এই প্রার্থী নির্বাচন পরিচালনায় কর্মী ছিলেন ২ হাজারের বেশি। তবে নির্বাচন শেষে দেখা গেছে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৬৪০ ভোট। একই সঙ্গে হারিয়েছেন জামানত। 

জি এম হাসান বলেন, ‘এই সরকারের প্রহসনের নির্বাচনে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা আওয়ামী লীগের দালাল। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া জাতীয় পার্টি বারবার নির্বাচনে অংশ নেওয়াতে জনগণ ও নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কর্মী ছিল, তবে তারা ভোট দিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে। শেষ পর্যন্ত টাকা পয়সা না থাকাতে তাঁরা আমার পক্ষে কাজ করেনি।’ 

জাতীয় পার্টির কয়েকজন কর্মী–ভোটার বলেন, এবারের নির্বাচন প্রতীকের নির্বাচন হয়নি, হয়েছে ব্যক্তির। এলাকায় যার অবস্থান ভালো এবং মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও গণসংযোগ আছে, তাঁরাই ভালো করেছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের এলাকার মানুষের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই, এলাকায় তেমন দলীয় কর্মকাণ্ডও নেই। শুধু উপজেলাতে নয়; জেলাতেও দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির কোনো কর্মকাণ্ড নেই। শুধু মুখে প্রচারণা। মানুষের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা ছিল না। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির জেলার এক শীর্ষ এক নেতা বলেন, ‘এলাকায় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থীদের। মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে এলাকার জনগণের সঙ্গে কুশল বিনিময় নেই, এমন নেতা নির্বাচনে দলের প্রার্থী হয়েছেন। ফলে জনগণ তাদের ন্যূনতম ভোট দিয়ে সম্মান করেনি। এমনকি তাঁদের কর্মী সমর্থকেরাও ভোট দেননি।’ 

জাতীয় পাটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও যশোর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সরিফুল ইসলাম চৌধুরী সরু বলেন, ‘মানুষের মধ্যে প্রচার ছিল আপনারাতো ভাগ-বাঁটোয়ারা মাধ্যমে ২৬টি আসন পেয়েছেন। সেখানে গিয়ে ভোট চান? যেকারণে আমাদের যশোরের প্রার্থীদের ভোট দেয়নি। এমনকি দলীয় নেতা-কর্মীরাও ভোট দিতে যাইনি। তা ছাড়া যশোর জেলা আওয়ামী লীগ–বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। এখানে এই দুই দলের প্রভাব বেশি।’ 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোরে ভোটযুদ্ধে নামেন ৩২ জন প্রার্থী। নৌকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র ৮ প্রার্থী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে দুটিকে স্বতন্ত্র ও চারটিতে নৌকা বিজয়ী হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আবু সাঈদকে ৪–৫ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়—শেখ হাসিনার দাবির সত্যতা কতটুকু

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

বিমানবন্দরে সাংবাদিক নূরুল কবীরকে হয়রানির তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

ভারত ও তরুণ প্রজন্মের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রসঙ্গে যা বললেন মির্জা ফখরুল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত