সাফজয়ী স্কোয়াডে ৮ সোনার মেয়েই কলসিন্দুরের, আনন্দে ভাসছে গ্রাম

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮: ১১
Thumbnail image

নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ নারী দলের প্রথম সাফ ফুটবল টুর্নামেন্ট জয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসটা ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামে অনেকটাই বেশি। কারণ, দলের আটজন খেলোয়াড়ই এই গ্রামের। সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন ও মার্জিয়া আক্তার সবাই এই গ্রামেরই। তাঁদের পরিবারেও চলছে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস।

গতকাল সোমবার মেয়েদের খেলা ঘিরে পুরো উপজেলায় বিকেল থেকে টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের দিকে নজর ছিল সব বয়সী মানুষের। বাড়িঘরের পাশাপাশি হাটবাজার এবং দোকানপাটে ছিল মানুষের খেলা উপভোগের উপচে পড়া ভিড়। দেশের জয়ে তাদের গ্রামের মেয়েদের অংশগ্রহণকে সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মনে করছেন বাসিন্দারা।

জানা যায়, জেলা শহর ময়মনসিংহ থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রাম। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই গ্রামটি। মুসলিম, হিন্দুদের পাশাপাশি এই গ্রামে বসবাস করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কয়েকটি পরিবার। অথচ উন্নয়ন ও শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা কলসিন্দুর গ্রামটির নাম এখন সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে। 

এলাকায় কেউ মোবাইলে, কেউ টিভিতে বিভিন্নভাবে খেলা দেখেছেনদলটির খেলোয়াড় সানজিদা আক্তারের বাবা লিয়াকত আলী বলেন, ‘খেলায় নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ জেতার পর পাড়া-মহল্লার লোকজন বলাবলি করতে শুরু করেছে, লিয়াকতের মেয়ে সানজিদারা জিতেছে। বাবা হিসেবে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? মেয়ের জন্য আজ আমাদের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। একটা সময় মেয়ে খেলাধুলা করায় মানুষ বিরূপ মন্তব্য করলেও এখন সানজিদার প্রশংসা সবার মুখে মুখে। এলাকার অনেক নারী ফুটবলার সানজিদাকে অনুকরণ করে। সব জায়গাতেই আমাদের মূল্যায়ন বেড়েছে। যা কোনো দিন চিন্তাও করিনি। আমি চাই আমার মেয়ে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগটাই করুক।’

সানজিদার মা জোসনা খানম বলেন, ‘এলাকার মানুষ সকাল থেকেই বাড়িতে আসছে। তারা আমাকে বলছে সানজিদাদের খেলা ভালো হয়েছে। তাই তারা জিতেছে। আমাদের কোনো সমস্যা আছে কি না, তা-ও লোকজন জানতে চেয়েছে। ঘরে কোনো কিছু লাগবে কি না। মেয়ের জন্য আমাদের এত নামডাক হইচে। মেয়ের প্রতি বাবা-মা হিসেবে যেটুকু দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা কখনো নিতে পারিনি। অভাব-অনটনের সংসারে দুমুঠো ভাত অনেক সময় খাওয়াতে পারিনি। মানুষের কাছে এখন মেয়ের প্রশংসা শুনলে চোখে পানি চলে আসে।’

দলের অন্যতম খেলোয়াড় তহুরা খাতুনের বাবা ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘আমার মেয়ে জয় পেয়েছে, তাতে খুব ভালো লাগছে। সবার মুখে মুখে তাদের নাম। আমিও সবার সঙ্গে বসে দোকানে খেলা দেখেছি। যখন খেলা শেষ হয়েছে সবাই আমাকে জাপটে ধরেছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। মনে হচ্ছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। মেয়েরা জিতেছে আমাদের এলাকার লোকজন একে অন্যকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। গ্রামে সাংবাদিক এসেছে, খোঁজখবর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। আমার মেয়েসহ সবার মেয়েরা ভালো থাকুক, ভালো খেলুক এটাই প্রত্যাশা।’

কলসিন্দুর নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার ও কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যাপক মালা রানী সরকার বলেন, ‘নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই দলের আটজনই কলসিন্দুর গ্রামের। সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন ও মার্জিয়া আক্তার। তাঁদের অর্জনে আজ জাতি গর্বিত। ২০১১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে আলোচনায় আসে মেয়েরা।’

গ্রামে এখন প্রতিনিয়ত খেলেন শিশু-কিশোর ছেলে-মেয়েরামালা রানী আরও বলেন, ‘শুরুতে অজপাড়াগাঁ কলসিন্দুরের এই মেয়েদের ফুটবল খেলাকে অনেকে ভালো চোখে দেখেনি। পরিবার থেকে খুব একটা সহযোগিতা পায়নি মেয়েরা। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন মেয়েরা মাধ্যমিকে ভর্তি হয়, তখন ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বাধা আসে। মেয়েদের প্রবল আগ্রহ আর আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজকের এ সফলতা।’ 

স্থানীয় বাসিন্দা হযরত আলী বলেন, ‘চায়ের স্টলে বসে মেয়েদের পুরো খেলা উপভোগ করেছি। মেয়েরা দারুণ খেলে জয়লাভ করেছে। প্রথমে শামসুন্নাহার  জুনিয়র গোল দিলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় আমাদের, আমাদের মেয়েরাই জিতবে। ঠিক তা-ই হয়েছে। মেয়েদের জেতার কারণে অবহেলিত এলাকার নামটা আবার মানুষের মুখে চলে আসছে। যে মেয়েদের জন্য আজ আমরা গর্বিত হলাম, আসলে তাদের গ্রামের কী অবস্থা তা কেউ জানে না। মেয়েদের বদান্যতায় আমরা বিদ্যুৎ পেলেও এখনো অবহেলিত রাস্তাঘাট।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা ভালো খেলে জিতেছে। আমরা খুব আনন্দিত। সব সময় চেষ্টা করি মেয়েদের খোঁজখবর রাখার জন্য। জয়ের পরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মেয়েদের বিষয়ে কথা হয়েছে। ওদের জন্য কিছু করার বিষয়ে আমরাও চিন্তাভাবনা করছি।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত