ও তো দল করত না, তাইলে কেন অরে মারল: সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থী রেজাউলের বাবা

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৩, ১৯: ০৩
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৩, ১৯: ৩৫

‘ও তো কোনো দল করত না, তাইলে কেন অরে মারল। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করি, আমার পুলারে যারা মারছে আপনে তাদের সঠিক বিচার করবেন। কত কষ্ট কইরা লেহাপড়া (লেখাপড়া) করাইতাছি। শুক্রবার সকালেও মোবাইলে কথা হইল। পুলাডা ডেঙ্গু পরীক্ষা করবো বইলা তিন হাজার টাকাও চাইছে। জুম্মার দিন বাজারের দোকান বন্ধ আছিলো বইলা পাঠাবার পাই নাই। পরদিন সকালে তো শুনি বাপ আমার নাই। আমার বাপের কী দোষ?’ ছেলের কথা বলতে গিয়ে গুলিস্তানে সংঘর্ষে নিহত পথচারী হাফেজ রেজাউলের (২১) বাবা আব্দুস সাত্তার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে নিজ বাড়িতে আজ রোববার দুপুরে এসব কথা বলেন।

আর রেজাউলের মৃত্যুর সংবাদ শুনে মা রেনুজা বেগমের আহাজারি যে থামছেই না। কাঁদছেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরাও। মা রেনুজা বেগম আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘আমার কলিজার বাপধন ডেঙ্গু পরীক্ষা করবার লাইজ্ঞা ঢাকা গেছিলো। শুক্কুরবার (শুক্রবার) সকাল বেলা ফোন কইরা আমার কাছে তিন হাজার টাকাও চাইছে। অই টাকাও তো আর পাঠাইবার পাইলাম না। ও আল্লাহ আমার স্বর্ণের চাক্কারে তুমি কই নিয়া গেলা? অহন আমি কেমনে থাকমু আমার কইলজার টুকরারে ছাড়া। মরার তিন দিনেও আমার বাপধনরে দেখবার পাইলাম না গো। তুমি আমারেও তুইল্লা নাও আল্লাহ।’ 

গত শুক্রবার রাজধানীতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ শেষে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের সংঘর্ষে নিহত হন পথচারী হাফেজ রেজাউল। তিনি শেরপুরের নকলা উপজেলার চরঅষ্টাধর ইউনিয়নের নারায়ণখোলা পশ্চিমপাড়া গ্রামের বর্গাচাষি আব্দুস সাত্তারের বড় ছেলে। রেজাউল ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটি মাদ্রাসায় দাওরা হাদিস বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

পরিবারের সদস্যরা গতকাল শনিবার সকালে রেজাউলের মৃত্যুর খবর পান। নকলা থানা-পুলিশ রেজাউলের জেঠা আজাহারুল ইসলামের মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে তাঁর মৃত্যুর খবর দেন এবং ঢাকায় গিয়ে লাশ গ্রহণ করে নিজ বাড়িতে আনার অনুরোধ করেন। হঠাৎ ছেলের মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন রেজাউলের মা-বাবা। এদিকে তিন দিনেও রেজাউলের লাশ না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরিবারের লোকজন ও এলাকাবাসী। 

পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একেবারেই নম্র-ভদ্র সদালাপী রেজাউল কোনো দিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। তাঁর তিন বোন আছে। ময়মনসিংহ জামিয়া ফয়জুর রহমান মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ঢাকায় একটি মাদ্রাসায় দাওরা হাদিস বিভাগে ভর্তি হন। 

গত কোরবানি ঈদের কয়েক দিন আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে আসেন। পরে গত বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে জামালপুরের নরুন্দী থেকে ট্রেনে ঢাকায় যান ৷ পরে শুক্রবার সন্ধ্যায় ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে ফেরার পথে রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় পথচারী রেজাউলের। 

আজ দুপুরে নিহত রেজাউলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মৃগী নদীর পাড় ঘেঁষে নিহত রেজাউলের বাড়ি। বাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে নারায়ণখোলা পশ্চিম আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। আশপাশে আর কোনো বাড়িঘর নেই। বাড়ির দক্ষিণে বাঁশঝাড়ের নিচে পারিবারিক কবরস্থানে রেজাউলের জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। তাঁর পাশে কবরের জন্য চাটাই তৈরি করছেন এক ব্যক্তি। 

শেরপুরে নকলায় হাফেজ রেজাউলের মায়ের আহাজারি। ছবি: আজকের পত্রিকাবাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, ছেলের মৃত্যুর খবরে মাতম করছেন মা রেনুজা বেগম। তাঁকে ঘিরে আছেন এলাকাবাসী ও স্বজনেরা। বাবা আব্দুস সাত্তার বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা শরীরে পানি ছিটিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছেন। রেজাউলের বড় দুই বোন ও মামা লাশ আনতে ঢাকায় গেছেন। লাশ আনতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হলেও আজ দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবরে তাঁরা লাশ বুঝে পাননি। 

প্রতিবেশী ও আত্মীয় বন্দেজ আলী বলেন, ‘সব সময় হাসিখুশি রেজাউল কোনো সাতে-পাঁচে ছিল না। তার ছোট ভাইও একজন হাফেজ। রাজনীতি করত না। রোজার মাসে স্থানীয় মসজিদে খতম তারাবিহ পড়াত। এই ছেলে তো বিনা কারণে মারা গেল। প্রশাসনের কোনো লোক বা কোনো জনপ্রতিনিধি কেউ তো কোনো খোঁজ নিল না।’ 

চরঅষ্টাধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, রেজাউল অত্যন্ত ভদ্র ও ধার্মিক ছিলেন। তাঁর বাবা অনেক কষ্ট করে তাঁকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। রেজাউল রাজনীতি করতেন না। রেজাউলের এমন মৃত্যুর ঘটনা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত