লিবিয়ায় আটক রেখে নির্যাতন, আ.লীগ নেতাসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০: ৫৫
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১: ৪২

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বিপ্লব হোসেন নামে এক যুবককে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন এবং ১৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ নেওয়ার অভিযোগ এনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে সিরাজগঞ্জ মানব পাচার দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলাটি দায়ের করেন শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের বেড়াডাঙ্গা গ্রামের মাসুদ রানা। মাসুদ রানা বিপ্লবের ভাই। 

মামলার শুনানি শেষে বিচারক শেখ মো. নাসিরুল হক মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। এই আদালতের স্টেনোগ্রাফার মাজেদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মামলার আসামিরা হলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কাশিনাথপুর গ্রামের ছানাউল্লাহ মাস্টারের ছেলে আব্দুল কাদের মিঠু, একই গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে নাজমুল আশরাফ ও তাঁর মা নাজমা খাতুন এবং একই গ্রামের রহমত আলীর ছেলে বাবু।

মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা মানব পাচার দলের সদস্য। আসামি নাজমুল আশরাফ লিবিয়ায় বহু দিন ধরে অবস্থান করছেন। নাজমুল আশরাফের সঙ্গে বাদীর পিতা আব্দুল মান্নানের মোবাইল ফোনে কথা হয়। মামলার দুই আসামি বাবু ও আব্দুল কাদের মিঠু বাদীর পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিপ্লব হোসেনকে ইতালি পাঠানোর জন্য ১৫ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে বিদেশে যাওয়ার জন্য ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়।

চুক্তি অনুযায়ী আসামিরা বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট-ভিসা প্রস্তুত করেন। প্রথমে তাঁরা বলে বিপ্লব হোসেনকে দুবাইয়ে নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে ইতালিতে পাঠিয়ে দেবেন। দুই দফায় ১৪ লাখ টাকা পরিশোধের পর ২০২২ সালের ৭ জুন আসামি বাবু ও আব্দুল কাদের মিঠু মাইক্রোবাসে করে বিপ্লব হোসেনকে ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে যান। বিপ্লব হোসেন দুবাইয়ে পৌঁছার পর তাঁকে আসামি নাজমুল আশরাফ ১৪ দিন একটি হোটেলে রাখেন। ১৪ দিন পর আসামি নাজমুল আশরাফ দুবাই থেকে বিপ্লবকে লিবিয়া রাষ্ট্রে নিয়ে যান।

লিবিয়ায় নিয়ে বিপ্লবকে আটক রেখে মারধর করেন নাজমুল। মুক্তিপণ হিসেবে টাকা প্রদানের জন্য বিপ্লবকে দিয়ে বাড়িতে ফোনে কথা বলান। বিপ্লবের জীবন বাঁচাতে নাজমুল আশরাফের নির্দেশে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬০ টাকা প্রদান করলেও বিপ্লবকে ছেড়ে দেন না। পরে আসামি নাজমুল আশরাফ মামলার বাদীর পিতাকে বলেন ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা মাদারীপুর জেলার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে।

বাদী বলেন, ‘পরে আমি এবং আমার পিতা মাদারীপুরে যাই। সেখানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আসামি নাজমুল আশরাফ বলেন বিলের পার্শ্বে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় টাকার ব্যাগ রাখতে। তার নির্দেশ অনুযায়ী টাকার ব্যাগটি রাখ এবং পেছনে তাকাইতে নিষেধ করে। টাকা পাওয়ার পর আমাদের জানানো হয় টাকা তাদের হস্তগত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ১৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ নেওয়ার পরও বিপ্লবকে ছেড়ে দেয় না। পরে বাধ্য হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি লিখিতভাবে অবগত করি। বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় একটি বিশেষ এজেন্সির মাধ্যমে বিপ্লব হোসেনকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শাহজাদপুর থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেন।’

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আসামিরা আমার ভাইকে আটক রেখে এবং বিদেশে নেওয়ার কথা বলে সর্বমোট ২৭ লাখ ৯৩ হাজার ৫৬০ টাকা ক্ষতি সাধন করেছে।’

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাজমুল হোসেনের মা নাজমা বেগম। তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমার ছেলে বিদেশ থাকে ১৭-১৮ বছর ধরে। তাদের সঙ্গে আমার ছেলের কোনো সম্পর্ক নেই। যাদের চিনি না তাদের কাছ থেকে টাকা নেব কী করে। শুনেছি তারা নাকি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে পুলিশ তাদের আটক করে দেশে পাঠাইছে। এখন দোষ দিচ্ছে আমাদের।’

লিবিয়াফেরত বিপ্লব হোসেন নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘লিবিয়ায় বিমানবন্দরে আমাদের রিসিভ করে নাজমুল। বিমানবন্দর থেকে নাজমুল তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় এনে আমাদের কোনো কাজ না দিয়ে আটকে রাখে। ১৩-১৪ মাস আটক রেখে নির্যাতন করে। লোহার রড ও পাইপ দিয়ে আমাদের নির্যাতন করা হতো। এখনো শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

‘আঘাতের চিহ্নগুলো কালো দাগ হয়ে আছে। নির্যাতনের সময় বাড়িতে ফোন দিত নাজমুল। বাড়ির লোকজনকে চিৎকারের শব্দ শোনাত। পরে বলত টাকা না পাঠালে আরও নির্যাতন করা হবে। এরপর বাড়ি থেকে টাকা পাঠালে কিছুদিনের জন্য নির্যাতন বন্ধ রাখে। পরবর্তী সময় আবারও টাকার জন্য নির্যাতন করত।’

শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল কাদের মিঠু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য না। আমরা শুনেছি বিপ্লব লিবিয়ায় গেছে। সে লিবিয়া থেকে চোরাই পথে ইতালি যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক হয়। পরে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির মাধ্যমে তাকে দেশে আনা হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত