রিকশা না চালিয়ে রোজ এক ঘণ্টা পত্রিকা পড়েন ফজলুল হক

রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪: ৩৫
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৫: ৩৩

পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে ফুটপাতে বসে আছেন লোকটি। খুব কাছে থেকে কয়েকটি ছবি তোলা হলো। কিন্তু কিছুই টের পেলেন না তিনি। রাস্তায় যানবাহনের শব্দ কিংবা মানুষের কোলাহলে তাঁর কিছুই আসে যায় না। তাঁর পুরো মনোযোগ পত্রিকার পাতায়। একটি দৈনিক পত্রিকার সব পাতা দেখার পর ফুটপাতের পত্রিকা বিক্রেতার কাছ থেকে আরেকটা নিলেন। উল্টেপাল্টে সব পাতা দেখলেন। কয়েকটা খবর পড়লেন মনোযোগ দিয়ে।

গতকাল বুধবার সকালে পত্রিকার এমন নিমগ্ন পাঠকের দেখা মিলল রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর যাত্রীছাউনির পাশে। পরনে লুঙ্গি, ফুলহাতা পুরোনো শার্ট। মুখের মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে লোকটি পত্রিকা পড়ছেন তো পড়ছেনই। পত্রিকা বিক্রেতা সাইফুল আলম বলেন, ‘এই আমার ফজলু ভাই। ১২-১৪ বছর ধরে আমার কাছে রোজ আসেন। পত্রিকার পোকা। সকালে এক ঘণ্টা কয়েকটা পত্রিকা পড়েন। তারপর রিকশা চালাতে যান। যাওয়ার সময় একটা পত্রিকা কিনে নিয়ে যান।’

কথা বলে বোঝা গেল, রোজ এভাবে বিনা পয়সায় পত্রিকা পড়তে পড়তে বিক্রেতা সাইফুলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। একটি পত্রিকা পড়া শেষে আরেকটি নেওয়ার সময় কথা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর নাম ফজলুল হক। বাড়ি নওগাঁ সদরের বর্শাইল গ্রামে। দ্বিতীয়বার গ্রামের নাম জানতে চাইলে ফজলুল হক বানান করে বললেন। জানালেন, প্রায় ২০ বছর ধরে থাকেন রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জে। সারা দিন এই শহরে রিকশা চালান।

নিজের রিকশায় যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা ফজলুল হক। ছবি: আজকের পত্রিকাফজলুল হক বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে স্ত্রী আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে রাজশাহী চলে আসেন। ১৮ বছর সংসার করেছেন। তবে কোনো সন্তান হয়নি। ২০১৪ সালে স্ট্রোক করে স্ত্রী মারা গেছেন। তারপর আর বিয়ে করেননি। শহরে তিনি এখন একাই থাকেন। ফজলুল হকের পড়াশোনা বেশি দূর নয়। কেবল পড়তে আর লিখতে পারেন। রোজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়া তাঁর নেশা। শহরের যেখানে যেখানে ফুটপাতে পত্রিকা বিক্রি হয়, সেখানেই পড়তে বসে যান তিনি। তবে বেশি বসেন লক্ষ্মীপুর মোড়ের সাইফুলের দোকানে।

ফজলুল হক কথা বলেন একটু কম। কত দিন ধরে পত্রিকা পড়েন, জানতে চাইলে বলেন, ‘ম্যালা, ২০ বছর পার হয়্যা যাবে।’ কোথায় কোথায় পত্রিকা পড়েন জানতে চাইলে বলেন, ‘সবখানেই পড়ি। সাহেববাজার পড়ি, নিউমার্কেট পড়ি, সোনাদীঘি মোড়ে পড়ি। এখানেই (সাইফুলের দোকানে) পড়ি ১২-১৪ বছর। ওই মোড়ে (লক্ষ্মীপুর) আগে মোস্তফার দোকানে বসতাম। এখন দোকান নাই।’ পাশ থেকে পত্রিকা বিক্রেতা সাইফুল বলেন, ‘মোস্তফার দোকান ছিল প্রায় ২৫ বছর আগে। তার মানে এত দিন ধরেই পড়ে।’

সাইফুল বলেন, ‘পত্রিকা পড়ার জন্য প্রতিদিন আমার কাছেই আসেন। রিকশা রেখে এক ঘণ্টা কয়েকটি পত্রিকা পড়ার পর একটি কিনে নিয়ে যান। আমাকে না পেলে অন্য কোথাও কারও দোকানে বসেন।’ তিনি বলেন, ‘দিন দিন পত্রিকা কিনতে আসা লোক কমে যাচ্ছে। ফজলু ভাইয়ের মতো কিছু লোক এখনো পত্রিকা কেনেন। তাঁর মতো পাঠক খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল।’

পত্রিকা পড়ায় মগ্ন ফজলুল হক। ছবি: আজকের পত্রিকাকেন পত্রিকা পড়েন, জানতে চাইলে রিকশাচালক ফজলুল হক বলেন, ‘জ্ঞান হয়। এটা আমার নেশা। পেপার না পড়লে ভালো লাগে না। এই ২০ বছরে এক দিনও হয়নি যে আমি পেপার পড়িনি। কোনো দিন ছুটির কারণে পেপার বাহির না হলে আগের দিনেরডাই বারবার পড়ি। আমি পেপার ছাড়া থাকতে পারব না। বৃষ্টির দিনেও পলিথিনে জড়িয়ে পেপার লিয়্যা গেলছি। পেপার থেকে বহুৎ কিছু শিখেছি। এই জ্ঞান বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালো হতো।’

কথা বলার সময়ই এক ব্যক্তি এসে রাস্তায় থাকা রিকশার মালিককে খুঁজতে থাকেন। ফজলুল হক সাড়া দেন, ‘রিকশা আমার।’ তারপর একটি পত্রিকা কিনে নিলেন। সিটের নিচে বাক্সের ভেতর পত্রিকাটি রেখে চালকের আসনে উঠে বসলেন। তারপর যাত্রী নিয়ে চলে গেলেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত