জেসমিনের মরদেহের গোসল কোথায় হয়েছে জানেন না স্বজনেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৬: ৩৮

র‍্যাবের হেফাজতে নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিন (৩৮) মারা যাওয়ার পরে তাঁর মরদেহের গোসল কোথায় করানো হয়েছে তা স্বজনেরা জানেন না। মরদেহের ময়নাতদন্তের পর কাফনে মোড়ানো মরদেহ র‍্যাব কফিনে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। বাড়িতে মরদেহের গোসল করানো হয়নি। জেসমিনের মরদেহের দাফনও হয়েছে র‍্যাবের পাহারায়।

জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে অনুসন্ধান করেন রাজশাহীর কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। নওগাঁ থেকে ফিরে এসে আজ শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা এই তথ্য দিয়েছেন। রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। নওগাঁয় যাওয়া অনুসন্ধান দলে ছিলেন রাজশাহীর বিশিষ্ট গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, আইনজীবী হাসনাত বেগ প্রমুখ।

অধ্যাপক ইফতিখারুল বলেন, জেসমিনের দাফন পর্যন্ত সবই হয়েছে র‍্যাবের উপস্থিতিতে। বাড়িতে তাঁর মরদেহ গোসল পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। র‍্যাব বলেছে, গোসল তারা করিয়ে নিয়ে গেছে। কফিন থেকে কাফন পরানো মরদেহ বের করে শুধু দাফন করে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা মরদেহের মুখ ছাড়া কিছুই দেখতে পারেননি। জেসমিনের মামা নজমুল হক মন্টু আমাদের বলেছেন, ‘মরদেহের গোসল কোথায় করা হয়েছে তা আমরা জানি না। আমরা মরদেহের মুখ ছাড়া কিছুই দেখার সুযোগ পাইনি।’

এই বক্তব্যের সত্যতা জানতে চাইলে নজমুল হক মন্টু আজকের পত্রিকায় বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা জেসমিনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা দাফন পর্যন্তও ছিল। তারা বলেছে, গোসল করিয়ে লাশ আনা হয়েছে। এত চিন্তা করতে হবে না। আমরা কফিনের ভেতর থেকে লাশের কপাল থেকে নিচের দিকে শুধু মুখটাই দেখতে পেয়েছিলাম।’ 

জানা গেছে, মৃত্যুর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হাম্মামখানায় জেসমিনের মরদেহের গোসল করানো হয়। র‍্যাবের পক্ষ থেকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে গোসল করানো হয়। কোয়ান্টামের রাজশাহীর একজন সংগঠক বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, তাদের নারী স্বেচ্ছাসেবীরা জেসমিনের মরদেহের গোসল করান।

এদিকে জেসমিনের মৃত্যুর পর তাঁর মামা অভিযোগ তুলেছেন, নির্যাতনের কারণে তাঁর ভাগনির মৃত্যু হয়েছে। তবে এ নিয়ে তিনি কোনো মামলা করেননি।

রাজশাহীর অনুসন্ধান দলের গবেষক মাহবুব বলেন, “জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। জেসমিনের মামা এ নিয়ে মামলা করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘মামলা তো পরের কথা, আমরা কী অবস্থায় আছি তা আপনারা বুঝতে পারছেন না।’ কোনো চাপে আছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘এটা কী বোঝাতে হবে?’ অথচ এই ব্যক্তি ওই এলাকায় পাঁচবার পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। এলাকায় তিনি প্রভাবশালী হিসেবেই পরিচিত। এখন জেসমিনের পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তারা আতঙ্কিত।”

অনুসন্ধান দলটি নওগাঁর মুক্তির মোড়ে গিয়ে জেসমিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের বরাত দিয়ে গবেষক মাহবুব বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন যে জেসমিনকে জোর করে তুলে নেওয়া হয়েছিল সাদাপোশাকে। র‍্যাবের এই দলে কোনো নারী সদস্যকেও প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেননি। ধাক্কা দিয়ে তাঁকে মাইক্রোবাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ ছাড়া এ রকমভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া ‘আটক’ নয়, এটিকে আমরা ‘অপহরণ’ হিসেবে মনে করছি। এটাও একটা অপরাধ।’

গবেষক মাহবুব আরও বলেন, ‘এলাকার লোকজন বুঝতে পারেননি যে র‍্যাব তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ওই ব্যক্তিরা কারা তা এলাকার লোকজন নিশ্চিত হতে পারেননি। ঘটনার সময় যুগ্ম সচিব এনামুল হকও ছিলেন। জেরার মুখে তিনি স্থানীয় একজন সাংবাদিককে বলেছেন যে তিনি নওগাঁ গিয়েছিলেন বিরিয়ানি খেতে। জেসমিনের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তা সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। একজন নাগরিক যদি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তার বিচার পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। সেখানে কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই একজন নাগরিককে সরকারি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মৌখিক কথায় এবং তাঁর উপস্থিতিতে উঠিয়ে নিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল যার পরিণতিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, এটি নিঃসন্দেহে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। জেসমিনের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানবাধিকার রক্ষায় দুঃখজনকভাবে উদাসীন। রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও তা রক্ষায় বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।’
 
মাহবুব সিদ্দিকী মনে করেন, এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি এই দাবি জানান। পাশাপাশি জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি মামলা করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘জেসমিনও একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। কোনো অপরাধ করলে সহজেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তা না করে যে প্রক্রিয়া বেছে নেওয়া হয়েছে তা রহস্যজনক। ইতিমধ্যে যুগ্ম সচিব এনামুল হকের বিষয়েও গণমাধ্যমে নানা তথ্য উঠে এসেছে। সবকিছুরই সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

র‍্যাব-৫ এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের একটি দল ২২ মার্চ সকালে জেসমিনকে আটক করে। স্থানীয় সরকারের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক মো. এনামুল হকের মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে নিয়েই র‍্যাব ওই অভিযান চালায়। এনামুল হকের অভিযোগ, জেসমিন ও আল-আমিন নামের এক ব্যক্তি তাঁর ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন বিভিন্নজনকে। এভাবে তাঁরা প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন।

এদিকে আটকের পরদিন ২৪ মার্চ সকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুগ্ম সচিব এনামুল হকের করা একটি মামলার কথা জানা যায়, যেটি রেকর্ডের সময় ২৩ মার্চের বিকেলে। জেসমিন ও তাঁর কথিত সহযোগী আল-আমিনকে এতে আসামি করা হয়। আল-আমিনকে ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তিনি একজন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট।

জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র‍্যাব-৫ এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের ১১ জন সদস্যকে রাজশাহীতে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আনা হয়েছে। র‍্যাবের গঠিত একটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। এ ঘটনায় যুগ্ম সচিব এনামুল হকের ব্যাপারেও তদন্ত হয়েছে। জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আগামী ৫ এপ্রিলের মধ্যে হাইকোর্টে জমা দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রস্তুত হয়নি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আবু সাঈদকে ৪–৫ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়—শেখ হাসিনার দাবির সত্যতা কতটুকু

মেট্রোরেল থেকে আমলাদের বিদায়, অগ্রাধিকার প্রকৌশলীদের

সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার সময় বাড়ল

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

ব্যাংক খাতে নতুন নীতিমালা: আটকে গেল ২৫৮ কর্মকর্তার জিএম পদে পদোন্নতি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত