আ.লীগ নেতাকে হত্যার সময় বলা হয় ‘তোকে মারলে কিছুই হবে না, নেতার নির্দেশ’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৩, ১৫: ৫৬
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৩, ১৬: ২৫

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই নেতাকে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আজ সোমবার দুপুরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাঁকে।

এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নিহত আওয়ামী লীগ নেতার নাম দুরুল হোদা (৪০)। তিনি উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের মিরাটুলি বাবুপুর গ্রামের চাঁন মণ্ডলের ছেলে এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় উপজেলার ঢুলঢুলিপাড়া এলাকায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে দুরুলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

আজ দুপুরে সরেজমিন ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বাড়ির ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রক্তের দাগ। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেওয়া ঘরের কাপড়চোপড়ে লেগে আছে রক্ত। বাড়ির পেছনের দরজার কাছে পড়ে রয়েছে দুটি বাঁশ ও রক্তমাখা দুটি হাঁসুয়া। আহাজারি করছেন স্বজনেরা। বাকরুদ্ধ দুরুলের স্ত্রী-সন্তানেরা। 

নিহতের পরিবার জানায়, নিহত দুরুলের তিন সন্তান রয়েছেন। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে (১৫) নবম শ্রেণির ছাত্রী, মেজো ছেলে (১১) মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ ছাড়া রয়েছে দেড় বছর বয়সী আরও একটি মেয়ে।

দুরুল হোদার শ্বশুর আনারুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রোববার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় মিরাটুলি বাবুপুর গ্রামের বাবু ঝাপড়ার নেতৃত্বে ১০টা মোটরসাইকেলে প্রায় ২০ জন ও পায়ে হেঁটে বাড়ির পেছন দিয়ে আরও ১০ জনের একটি দল অস্ত্র হাতে আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। এরপর আমার বাড়িতে পেছনের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে লুটপাট করে এবং আমার মেয়েসহ ছোট বাচ্চাদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। এ সময় আমাকেও গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে থাকে তারা। অবস্থা বেগতিক দেখে আমার জামাই পাশে আমার ভাই মনিরুলের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরে আমার বাড়িতে দুরুলকে না পেয়ে মনিরুলের বাড়ির দরজা ভেঙে তার বাড়িতে প্রবেশ করে। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে তাণ্ডব চালায় সন্ত্রাসীরা। তারা এতটাই বেপরোয়া ছিল, তাদের দেখে কেউ বাঁচাতে এগিয়ে যেতে সাহস পাইনি।’

ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী দুরুল হোদার চাচি শাশুড়ি তাজকেরা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র দেখে, ভয়ে আমরা বাড়ির সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিই। এরপর তারা দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে এলোপাতাড়ি আসবাব ও দরজা ভাঙতে থাকে। এ সময় দুরুলকে বাঁচাতে একটি ঘরে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রাখি। সেই ঘরে ঢুকে খাটের নিচ থেকে দুরুলকে টেনে বের করে কোপাতে থাকে।’ 

চাচি শাশুড়ি আরও বলেন, ‘এ সময় সন্ত্রাসীরা বলে “তোকে মেরে ফেললে কিছুই হবে না, নেতার নির্দেশ আছে”। আমাদের কিছুই হবে না। পরে বাড়ির পেছনে নিয়ে চায়নিজ কুড়াল, হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে লোকজনের সহায়তায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রাস্তায় দুরুলের মৃত্যু হয়। সন্ত্রাসীরা যাওয়ার সময় মনিরুল ইসলামের ঘর থেকে কাপড় ব্যবসা ও ছাগল বিক্রির ৭০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে।’

দুরুল হোদার মেয়ে দিশা মনি আজকের পত্রিকাকে বলে, ‘আমার আব্বু, আম্মুসহ আমরা তিন ভাইবোন নানার বাড়িতেই ছিলাম। সন্ত্রাসীদের দেখে আব্বু ছাদ দিয়ে পাশের বাড়ির নানার বাড়িতে চলে যায়। তারা এসে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে বলে গালাগালি করতে থাকে।’

এর মধ্যে বাবু ঝাপড়া, খাইরুলসহ বেশ কয়েকজনকে চিনতে পেরেছে সে। সন্ত্রাসীরা সবাই সুন্দরপুর ও ঝাপড়াপাড়ার বাসিন্দা ছিল বলে জানায় সে।

দুরুল হোদার স্ত্রী তোহমিনা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটি হত্যা মামলার আসামি ছিলেন আমার স্বামী। কয়েক দিন আগে জামিনে ছাড়া পেয়ে সন্ত্রাসীদের ভয়ে, নিজ বাড়ি বাবুপুরে যেতে পারিনি আমরা। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছি বাবার বাড়িতে। তারপরেও খুন হতে হলো আমার স্বামীকে। এখন তিন শিশু সন্তান নিয়ে জীবন বাঁচাব কীভাবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য বিএনপি নেতা আলম হোসেন হত্যা মামলার আসামি আবু হেনা বলেন, ‘আলম হত্যা মামলায় চলতি মাসের ৪ তারিখে আমি আর দুরুল কারাগারে যাই। গত ২২ তারিখ জামিনে ছাড়া পাই। এর পর থেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম আমরা।’

আবু হেনা আরও বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টা শনিবার রাতে শিবগঞ্জ থানায় গিয়ে ওসিকে জানানো হইছিল। এরপর ওসি নিজেই আলম হোসেন হত্যা মামলার বাদী বাবুল আলীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে। কোনো ঝামেলা করতে নিষেধ করেছেন। তারপরেও বাবুর নেতৃত্বে হামলা হলো।’

এ বিষয়ে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী জোবায়ের আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। হত্যাকারীদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

প্রসঙ্গত, গত ১৩ এপ্রিল মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বিএনপির সভাপতি আলম হোসেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা ককটেল ফাটিয়ে গতিরোধ করে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনায় নিহতের ভাই বাবুল আলী শিবগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় এজাহারভুক্ত ১২ নম্বর আসামি ছিলেন দুরুল হোদা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত