বয়স্ক ভাতা যাচ্ছে মৃত ব্যক্তির মোবাইলে

রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২২, ২৩: ৫৩

বছরখানেক আগেই নজরুল ইসলাম মারা গেছেন। এলাকার কাউন্সিলর নজরুলের ছেলে রতন আলীকে ডেকে বলেছিলেন, তার বাবার বয়স্ক ভাতার বইটা যেন জমা দিয়ে যাওয়া হয়। তাহলে নজরুলের জায়গায় তিনি অন্য কাউকে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু রতন তার বাবার ভাতার বই জমা দেননি। তাই মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারেনি সমাজসেবা কার্যালয়। মৃত্যুর পরও একাধিকবার নজরুলের বয়স্ক ভাতার টাকা চলে গেছে মোবাইলে।

নজরুল ইসলাম রাজশাহী নগরীর ভাটাপাড়া মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন। ওই এলাকাটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ৬ নম্বর ওয়ার্ডে।

এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুরুজ্জামান টুকু বলেন, ‘রতনকে একাধিকবার বলেছি যে সে যেন তার বাবার বইটা জমা দেয়। তাহলে বইয়ের তথ্যগুলো সমাজসেবা অফিসে দিয়ে নজরুলের মৃত্যুর খবরটা জানিয়ে দেব। কিন্তু রতন বই জমা না দেওয়ার কারণে ভাতা বন্ধ হয়নি। এ রকম আরও কয়েকজন আছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপকারভোগী মারা যাওয়ার পরও তাঁর স্বজনেরা বিষয়টি চেপে থাকছেন ভাতা পাওয়ার আশায়। আবার কখনো কখনো এলাকার কাউন্সিলররাও মৃত্যুর কথা জানতে পারলেও ভাতা বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছেন না। তারা মৃত ব্যক্তির স্বজনদের ওই টাকা পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। বিষয়টি ভাবিয়েছে সমাজসেবা কার্যালয়কেও। তাই এবার উপকারভোগীদের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে ‘লাইফ ভেরিফিকেশন’ করার পরই দেওয়া হচ্ছে টাকা। এটি করতে গিয়ে গত দুই মাসে শহরে প্রায় ২০০ মৃত উপকারভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর ভাতার টাকা পাঠানো হয়নি। 

রাজশাহী নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রবিউল ইসলাম তজু বলেন, ‘এই সমস্যা সারা দেশেই। উপকারভোগী মারা যায়, কিন্তু কেউ কেউ জানান না। তবে আমার ওয়ার্ডে এ রকম হয় না। আমি প্রত্যেকের জানাজায় অংশ নিই। মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারলেই ভাতা বন্ধের উদ্যোগ নিই। কিন্তু অনেক কাউন্সিলরই ভাবেন, মৃত ব্যক্তির ছেলে-মেয়ে টাকাটা পাবে। সে কারণে তারা বন্ধের উদ্যোগ নেন না। অল্প কিছু মানুষের জন্য এবার সবার ভাতা বন্ধ করে ‘লাইফ ভেরিফিকেশন’ করা হচ্ছে। এতে তাদের দুর্ভোগ হচ্ছে।’ 

সোমবার (৩১ অক্টোবর) সকালে রাজশাহী শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মোবাইলে ভাতার টাকা না পেয়ে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বই হাতে অফিসে ছুটে আসছেন। তারা গিয়ে অফিসের একজন কর্মকর্তাকে নিজের বই দেখাচ্ছেন। জানতে চাচ্ছেন টাকা না পাওয়ার কারণ। ওই কর্মকর্তা বইয়ের ছবির সঙ্গে ব্যক্তির চেহারা এবং সঙ্গে নিয়ে যাওয়া মোবাইলের নম্বরের সঙ্গে অনলাইনে থাকা মোবাইল নম্বর মিলিয়ে দেখছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 

বই হাতে সমাজসেবা কার্যালয়ে এসেছিলেন নগরীর আদুবুড়ি মহল্লার বাসিন্দা ইয়ার মোহাম্মদ। ৭৯ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ অন্ধ। প্রতিবেশী রিকশাচালক রবিউল ইসলামকে নিয়ে তিনি আসেন। রবিউলের হাত ধরে ভেতরে ঢুকেই ইয়ার মোহাম্মদ বললেন, ‘আমার টাকাডা দে তো বাপ। টাকা না পাইয়া আমার ওষুধ কিনা বন্ধ হয়্যা গেইলছে। আমি ওষুধ খাব।’ ‘লাইফ ভেরিফিকেশন’ শেষে ইয়ারকে জানানো হয়, তিনি টাকা পেয়ে যাবেন। 

লাইফ ভেরিফিকেশনের জন্য লক্ষী বেওয়ার বয়স্ক ভাতার টাকাও বন্ধ ছিল। ছেলে ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে লক্ষীও এসেছিলেন শহর সমাজসেবা কার্যালয়েসমাজসেবা কার্যালয় থেকে জানা গেছে, রাজশাহী শহরে বয়স্কভাতার উপকারভোগী ১৩ হাজার ২৩ জন। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হয় ৫ হাজার ২৯৯ জনকে। আগে ব্যাংকের মাধ্যমে যখন টাকা দেওয়া হতো, তখন সেখানে সমাজসেবার একজন কর্মকর্তা বসে থাকতেন। কেউ মারা গেছেন কি না তা বুঝতে পারছেন। কিন্তু এখন টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয় মোবাইলে। তাই কেউ মারা গেলেও সে খবর সব সময় আসে না। মৃতদের শনাক্ত করতেই এবার এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ২০০ জন মৃত ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে যাদের বয়স্ক ভাতার টাকা মৃত্যুর পরও যাচ্ছিল। অল্প কিছু প্রতিবন্ধী ভাতার ক্ষেত্রেও এমনটি পাওয়া গেছে। দুই মাস ধরে চলা এই কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। এলাকায় মাইকিং করা এবং মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলেও এখনো প্রায় দেড় হাজার জন ‘লাইফ ভেরিফিকেশন’ করাতে আসেননি। এদের মধ্যেও কেউ কেউ মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল মমিন বলেন, ‘দেশের কোথাও এভাবে ভেরিফিকেশন হচ্ছে না। আমরা কিছু তথ্যের ভিত্তিতে জেলা সমন্বয় কমিটিতে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে মৃত উপকারভোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে। ভাতা বন্ধ হচ্ছে। আমাদের দেখাদেখি আশপাশের কয়েকটি উপজেলাতেও এ রকম করা হচ্ছে বলে শুনেছি। এখন মৃত উপকারভোগীদের জায়গায় অন্য প্রবীণকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত