ঈদেও বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর খোঁজ নেননি স্বজনেরা

আনোয়ার হোসেন শামীম, গাইবান্ধা 
আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৪: ৫৫
Thumbnail image

ধনী-দরিদ্র সবাই যে যাঁর মতো ঈদে আনন্দ করছেন। এ সময়ও প্রত্যন্ত এক গ্রামে প্রিয়জন ছাড়া নিভৃতে বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জল ফেলে কাটিয়েছেন একদল মানুষ। এই মানুষগুলোর মধ্য অনেকেই বুকভরা আশায় ছিলেন এবার ঈদে হয়তো ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন কেউ না কেউ আসবে একটু খোঁজ নিতে। সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত—এভাবে ঈদের পর আরও একটা দিন পার হয়ে গেলেও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি তাঁদের। 

গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে ছোট সোহাগী গ্রাম। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত গ্রামটি। ২০১৭ সালে স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে উঠেছে মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রম। শুরু থেকেই মানুষের অনুদানে চলে আসছে এটি। বর্তমানে এখানে আছেন ৪৫ জন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। তাঁদের মধ্যে নারী ২৬ জন ও পুরুষ ১৯ জন। অনেককে রাস্তা থেকে আনা হয়েছে এখানে। এই বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত মানুষগুলো কারও বাবা, কারও মা, কারও দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি। নিঃসঙ্গ হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন তাঁদের অনেকেই। 

অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকিত্ব কুরে কুরে খাচ্ছে এসব মানুষকে। একই সঙ্গে এ বৃদ্ধাশ্রমের জীবনই তাঁদের কাছে স্বস্তিদায়ক। তাঁরা চান না পরিবারে ফিরে গিয়ে কারও বোঝা হয়ে থাকতে। বছরের পর বছর ঘুরে ঈদ এলে প্রিয় সন্তানের স্মৃতি মনে হলেই সিক্ত হয় তাঁদের নয়ন। তার পরও বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে সন্তানদের ভুলতে চেষ্টা করে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন নিজেদের মতো করেই। সেবা আর চিকিৎসা দিয়ে অসহায় এসব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনাকারীরাও। 

বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের একজন মো. জবেদ আলী। বয়স এক শর ওপরে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালিডোবা গ্রামে জন্ম নেওয়া জবেদ আলী জানান, ছেলেরা বাড়ি থেকে বের করে দেয় তাঁকে। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে অবশেষে মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমে আসেন। সাত বছর থেকে এখানেই আছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবেদ আলী বলেন, ‘বেশ ভালোই আছি, নিজের সন্তানদের ছাড়াই ঈদ এবার কাটালাম। এই কষ্ট যার হয় সে ছাড়া, কেউ অনুভব করতে পারবে না। এমন সন্তান যেন আর কারও না হয়। এটুকুই চাওয়া।’  

গতকাল শক্রবার ঈদুল ফিতরের দ্বিতীয় দিন বিকেলে ছোট সোহাগী গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমের গিয়ে কথা হয় জবেদ আলীসহ কয়েকজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার সঙ্গে।  

বৃদ্ধ হামিদ মাস্টার একটি দাখিল মাদ্রাসার ইংরেজির সহকারী শিক্ষক ছিলেনবেশ কিছুদিন ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন মজিরুন বেওয়া। বয়স এক শ ছুঁই ছুঁই। ১০ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। তিন বছর আগে তাঁর ঠাঁই হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। 

ফাহিমা বেওয়ার (৬৫) ছেলে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও ছেলে খোঁজ-খবর রাখেন না। তিনি বলেন, এ রকম সন্তান যেন কারও না হয়। এখন সন্তান থেকেও তিনি যেন নিঃসন্তান। 

আবু তাহের (৭৫) ও লাইলী বেগম (৬২) দম্পতি আছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁদের ঘরে চার ছেলে-মেয়ে। গত চার বছর বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও সন্তানেরা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। 

এই বৃদ্ধাশ্রমের আরেক আশ্রিত জাহানারা বলেন, ‘এখানে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। ঈদের দিনে ভালো পোশাক আর খাবার দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।’ 

বৃদ্ধ হামিদ মাস্টার একটি দাখিল মাদ্রাসার ইংরেজির সহকারী শিক্ষক ছিলেন। ২৮ বছরের শিক্ষকতার ইতি টেনে ২০১২ সালে অবসরে যান তিনি। অবসরকালীন পাওয়া ভাতা দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন। ছেলেকে মুফতি বানানোর আশায় বগুড়া শহরের একটি মাদ্রাসায়ও ভর্তি করেছিলেন। পরে ছেলেকে বিয়ে করান। বৃদ্ধ বাবা হামিদ মাস্টার যখন চলাফেরা এমনকি কোনো কাজ-কর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন সৃষ্টি হয় সংসারে কলহ। একপর্যায়ে অনাদরে-অবহেলায় বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। 

বৃদ্ধাশ্রমে নারী আছেন ২৬ জন ও পুরুষ ১৯ জন। ছবি: আজকের পত্রিকাহামিদ মাস্টার বলেন, ‘কত ছাত্রকে জীবনে টাকা ছাড়াই পড়াইছি। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিনি। শত শত শিক্ষার্থী মানুষের মতো মানুষ করছি। কিন্তু নিজের ছেলেকে শত চেষ্টা করেও পড়াশোনা করাতে পারিনি। আমি একজন মানুষ গড়ার কারিগর। আর আমার একমাত্র সন্তান থাকার পরও শেষ পর্যন্ত আমার ঠাঁই হলো বৃদ্ধাশ্রমে। আমার মতো কোনো শিক্ষক বা পিতার যেন শেষ বয়সে এমন পরিণতি না হয়। এমনটাই দোয়া করি সব সময়।’ 

বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আপেল মাহমুদ দৈনিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই বৃদ্ধ মা-বাবা। আমরা তাঁদের সঙ্গে মা-বাবা আর দাদা-দাদির মতো আচরণ করি। অনেকেই অসুস্থ আছেন। সময়মতো তাঁদের গোসল করাতে হয়। মাঝেমধ্যে অনেককে খাইয়ে দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও মানুষের অনুদানে চলে এটি। সমাজের বিত্তবানের কাছে এই বৃদ্ধাশ্রমের জন্য সহযোগিতা কামনা করছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত