কাউনিয়ায় চোর সন্দেহে ২ শিশুকে নির্মম নির্যাতন, ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে উদ্ধার

কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০: ০২

রংপুরের কাউনিয়ায় চোর সন্দেহে শামীম হোসেন (১০) ও রাসেল (৯) নামে দুই শিশুকে নির্মম নির্যাতন করেছেন এক ইউপি সদস্য ও তাঁর দুই সহযোগী। গতকাল বুধবার উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের রাজিব মোল্লাটারী গ্রামে এ ঘটে। নির্যাতনের শিকার শিশু রাসেল গুরুতর আহত হলে তাকে সন্ধ্যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। 

নির্যাতনের শিকার শিশু শামীম উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের রাজিব মোল্লাটারী গ্রামের সামসুল হকের ছেলে। রাসেল ওই ইউনিয়নের বাজেমজকুর গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে। 

স্থানীয়রা জানান, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজিব মোল্লাটারী গ্রামের আকরাম হোসেনের ঘরের সিঁধ কেটে ৭০ হাজার টাকা কে বা কারা চুরি করে। এ ঘটনায় আকরাম এবং তাঁর ভাই ইয়াকুব ওই টাকা চোর সন্দেহে শিশু শামীম ও রাসেলকে বাড়ি থেকে ধরে আনেন। এরপর ইউপি সদস্য ইউনুস আলী শিশু দুজনকে তাঁর বাড়িতে ঘরের মধ্যে হাত-পা বেঁধে নির্মম নির্যাতন করেন। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ইউপি সদস্য ইউনুস আলীর বাড়ি থেকে দুই শিশুকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। 

নির্যাতনের শিকার শিশু শামীম জানায়, ইউনুস মেম্বারের কথামতো প্রতিবেশী দুজন তাকে ধরে মেম্বারের বাড়িতে নিয়ে যায়। এরপর তার হাত-পা বেঁধে গাছের ডাল দিয়ে মারপিট করে ইউনুস মেম্বার। মেম্বারের পা ধরে টাকা চুরির কথা অস্বীকার করলেও কোনো কথাই না শুনে কোমর থেকে পায়ের গিরা পর্যন্ত গাছের ডাল দিয়ে মারপিট করা হয়। 

শামীমের মা সোহাগী বেগম বলেন, সংসারে অভাবের কারণে শিশু শামীম একটি পিকআপে সহকারী হিসেবে কাজ করে। ৪ দিন পর মঙ্গলবার রাতে নওগাঁ থেকে বাড়িতে ফিরে খাওয়া শেষে গাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বুধবার সকালে লোকমুখে জানতে পারেন যে, ইউপি সদস্য ইউনুস আলীর বাড়িতে তার ছেলের হাত-পা বেঁধে পেটাচ্ছে। তার নিরপরাধ ছেলেকে যারা এভাবে নির্যাতন করেছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি। 

শিশুটির মামা রাজু মিয়া বলেন, শামীমকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করতে গেলে ইউনুস মেম্বারের লোকজন তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে সে। 

শিশু রাসেলের বাবা মন্তাজ আলী বলেন, গতকাল বুধবার সকালে তিনি কাজে বেরিয়ে যান। বিকেলে বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন যে, সকালে দুটি মোটরসাইকেলে করে ৪-৫ জন লোক এসে তাঁর ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ইউনুস মেম্বারের বাড়িতে আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করছে। পরে পুলিশের সহায়তায় বাড়ি ফিরে আসে সে। 

মন্তাজ আলী বলেন, ‘বাড়িতে এসে দেখি আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঠিকভাবে সে হাঁটতে পারছে না। কেউ কথা বলতে গেলে কোনো কথা বলছে না। লোকজন দেখলেই সে আঁতকে উঠছে। পরে সন্ধ্যায় স্থানীয়দের সহায়তায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করি।’ 

শিশু রাসেল বলে, ‘অনেক কান্নাকাটি করেছি। তবুও মেম্বার চাচা আমাদের ছেড়ে দেয়নি। পানি খাইতে চেয়েছি। পানিও দেওয়া হয়নি।’ 

হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ওমর ফারুক বলেন, ‘শিশু রাসেলের দুই ঊরুতে চারটা সুঁই ফোটানো হয়েছে। বাম হাঁটুর নিচে ফোলা আছে। এ ছাড়া ডান পায়ের গোড়ালি ফুলে গেছে। তার এক্স-রে করার জন্য বলা হয়েছে। শিশুটির ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে।’ 
 
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য ইউনুস আলী বলেন, ‘আমি মারধর করিনি। আকরাম ও ইয়াকুবের বাড়িতে শিশু দুজনকে মারধর করেছে।’ 

মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে আকরাম হোসেন বলেন, ‘প্রথমে শামীমকে নিয়ে আসা হয়। পরে তার কথামতো রাসেলকে আনা হয়। তাদের মেম্বারের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মেম্বার চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য শিশু দুজনকে মারপিট করে। এ সময় তিনি ও তাঁর ভাই শিশু দুজনকে চড় থাপ্পড় মেরেছে।’ 

কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুমুর রহমান বলেন, ‘৯৯৯ খবর পেয়ে টেপামধুপুর ইউনিয়নের সদস্য ইউনুস আলী বাড়ি থেকে শিশু দুটিকে উদ্ধার করে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। পরে শুনেছি এক শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অপরজন বাড়িতে আছে।’ 

ওসি বলেন, ‘এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ঘটনাস্থল থেকে যেহেতু শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাই থানায় একটি জিডি দায়ের করা হয়েছে।’ 

রংপুর জেলা পুলিশ সুপার ফেরদৌস আলী চৌধুরী বলেন, ‘সিঁধ কেটে টাকা চুরি সন্দেহে দুই শিশুকে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনাটি আমি জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে কাউনিয়া থানার ওসিকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।’ 

ভুক্তভোগীর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে পুলিশ সুপার বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ দায়ের করলে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত