রংপুরের বেনারসিপল্লি: কারখানা বন্ধ, ক্রেতাদের ঠকিয়ে বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় শাড়ি

আব্দুর রহিম পায়েল, গঙ্গাচড়া (রংপুর)
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ২০: ০৮
আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ২০: ১৬

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে হাবু এলাকায় বেনারসিপল্লি। এটি উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। তাঁতিপাড়া নামেও পরিচিত। এখানে একসময় প্রায় ৬০০ বেনারসি তাঁত ছিল। বর্তমানে মাত্র তিনটি তাঁত চালু আছে। এই বেনারসিপল্লি এখন মূলত শাড়ির মার্কেট। রংপুর শহরসহ সরাসরি লালমনিরহাট জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখানে প্রতিদিন অনেক ক্রেতা আসেন বেনারসি কিনতে। 

এই মার্কেটের দোকানিরা দাবি করেন, তাঁদের দোকানে সব স্থানীয় তাঁতের শাড়ি। বিক্রি হয় চড়া মূল্যে। কিন্তু তাঁত মালিকেরা বলছেন, এই দাবি সঠিক নয়। দোকানিরা ক্রেতাদের ঠকিয়ে ভারতীয় শাড়ি বিক্রি করছেন। 

তাঁতিপাড়ার কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছেগতকাল সোমবার সরেজমিনে বেনারসি পল্লীতে গিয়েছিলেন এ প্রতিবেদক। গ্রামটিতে গেলে দেখা যায়, মহাসড়কের দুই পাশে বিভিন্ন নামের ১৫টিরও বেশি শাড়ির দোকান। সবগুলো নামের সঙ্গেই আছে ‘বেনারসি’ শব্দ। 

‘নিবিড় বেনারসি’ নামে একটি দোকানে গিয়ে কথা হয় কর্মচারি মমিনুর ইসলামের সঙ্গে। তাঁদের বেনারসি শাড়িগুলো কোথায় তৈরি হয় জানতে চাইলে এই কর্মচারী বলেন, ‘আমাদের নিজেস্ব কারখানা আছে। পাশেই আমাদের কারখানা।’ 

তাঁতিপাড়ার কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছেসেখান থেকে বেরিয়ে ‘তিস্তা বেনারসি’ নামের আরেক দোকানে গিয়ে কথা হয় দোকানের ম্যানেজার স্বপন মিয়ার সঙ্গে। তিনিও বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কারখানা আছে। আমরা সেখানে শাড়ি বানাই। শাড়ির বেশি চাহিদা থাকলে আমাদের পাশে আরও অনেক কারখানা আছে সেখানেও অর্ডার দেই।’ কারখানা কোথায় জানতে চাইলে পাশের একটি কারখানার ঠিকানা দেন তিনি। 

এ সময় দোকানটিতে রংপুর শহরের মেডিকেল মোড় থেকে শাড়ি কিনতে আসা নাদিয়া ইসলাম (২৩) নামে এক তরুণীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, এর আগেও বেনারসি কাতান নামের ১৫টি শাড়ি কিনে নিয়ে গেছেন। তবে আসল বেনারসি কাতান কি না তিনি নিশ্চিত নন। পছন্দ হওয়ায় আবারও এসেছেন। 

মৌমিতা বেনারসি ও তিস্তা বেনারসি থেকে একই কারখানার ঠিকানা দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে কথা হয় কারিগর আল আমিনের সঙ্গে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সামনের বেনারসির দোকানগুলোর কারখানাগুলো কোথায়? 

তাঁতিপাড়ার কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছেজবাবে এই কারিগর বলেন, ‘এসব দোকানে তো এখানকার শাড়ি বিক্রি হয় না। এগুলো সব ভারত থেকে আসে। এরা শুধু এখানকার নাম বলে বিক্রি করে। আসলে এদের নিজেদের কোনো কারখানা নাই।’ 

আল আলমিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এসে হাজির হন কারখানার মালিক আব্দুর রহমান। তিনি জানান, এখানকার তাঁত শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথম তাঁত স্থাপন করেন। তাঁর দেখাদেখি প্রতিবেশীরাও ঝুঁকে পড়েন এ শিল্পে। আস্তে আস্তে এ শিল্পের প্রসার ঘটে। নাম ছড়িয়ে পড়ে। আব্দুর রহমান দাবি করেন, এখানকার তৈরি শাড়ি প্রায় ১০ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যও কেনা হতো। 

আব্দুর রহমানের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০৫ সালে এই এলাকার প্রায় ১০০ তাঁতি মিলে বেনারসি পল্লী গড়ে তোলেন। বলা চলে, হাবু গ্রামের সবাই তখন তাঁতি ছিলেন। এক সময় প্রায় ৬০০ তাঁত ছিল এখানে। এখন শুধু তাঁর কারখানায় তিনটি হস্তচালিত তাঁত চালু আছে। 

গঙ্গাচড়ার বেনারসি পল্লীতে বিক্রি হচ্ছে সব ভারতীয় শাড়ি। ঠকছেন ক্রেতারামৌমিতা বেনারসি ও তিস্তা বেনারসির দাবির ব্যাপারে জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘এটা মিথ্যা কথা। রাস্তার পাশের যেসব দোকান আপনারা দেখতেছেন, এদের কারও নিজের কেন শাড়ি তৈরির কারখানা নেই। এরা আমাদের কারখানার নাম ভাঙিয়ে চলে। কেউ শাড়ি দোকারে শাড়ি কিনতে আসলে আমাদের কারখানা দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘এই যে আমাদের নিজস্ব কারখানা।’ ’ কয়েক দিন আগে এক ব্যবসায়ীকে সাবধান করে দিয়েছি যাতে ক্রেতাকে ধোকা না দেয়। আমরা যা শাড়ি তৈরি করি আমাদের সব শাড়ি ঢাকায় বিক্রি হয়। আমাদের তৈরি একটা শাড়িও এখানকার কোনো দোকানে পাবেন না।’ 

নিশাত বেনারসির ম্যানেজার আসিকুজ্জামান আসিকের সঙ্গে কথা হলে তিনি দাবি করেন, স্থানীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই নিজের কারখানায় বোনানো বেনারসি শাড়ি এখানে বিক্রি করেন। তাঁর কারখানায় শতাধিক কারিগর কাজ করে। 

নিশাত বেনারসি ও নিবিড় বেনারসিও একই কারখানার ঠিকানা দেওয়া হয়। তাদের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। একটি জরাজীর্ণ অন্ধকার ঘর কোনো এক সময়ের তাঁত কারখানার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাঁতে মাকড়সার জাল। 

গঙ্গাচড়ার বেনারসি পল্লীতে বিক্রি হচ্ছে সব ভারতীয় শাড়ি। ঠকছেন ক্রেতারাতিন বছর ধরে কারখানাটি বন্ধ বলে স্বীকার করলেন মালিকের পরিবারের সদস্য এক নারী (৫০)। ওই নারী বলেন, নিশাত ও নিবিড় বেনারসি এক সময় তাঁদের কারখানা থেকে শাড়ি কিনতো। কিন্তু পরে তারা আর নেয়নি। এক সময় কারখানাটি বন্ধ করতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেনারসি পল্লীর ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার মুখে। হাতেগোনা কয়েকজন কারিগর রয়েছেন। তাঁরা বলেন, ভারতীয় শাড়ির দাপটে হারিয়ে গেছে রংপুরের বেনারসি।

এমন প্রতারণার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রংপুরের জাতীয় ভোক্তা-অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি আমাদের জনবল সংকটের কারণে এ বিষয়গুলো দেখভাল করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত