‘মাইনসের জান বাঁচপার যায়্যা মোর যাদুটা হারে গেল’

শিপুল ইসলাম, রংপুর 
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬: ১৬
আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬: ৩২
একমাত্র ছেলে সোহানুজ্জামান নয়ন ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন। ছেলেকে হারিয়ে মায়ের আহাজারি যেন থামছেই না। পাশে স্বজন-প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাড়ির অদূরে খোড়া হয়েছে কবর। উঠানে প্রস্তুত সাদা কাপড়, বাঁশ, খাটিয়া। লাশ আসলেই দাফনের অপেক্ষায় আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব। বাড়ি জুড়ে আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা নার্গিস বেগম।

এমন চিত্র সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মী রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের আট পনিয়া গ্রামে সোহানুজ্জামান নয়নের (২৪) বাড়িতে।

গতকাল বুধবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টার দিকে সচিবালয়ের আগুন নেভানোর জন্য অন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর সঙ্গে কাজে যোগ দেন নয়ন। এ সময় হঠাৎ বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এ সময় সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দ্রুত তাঁকে ফায়ার সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। সোহানের লাশ ঢাকায় জানাজার পর গ্রামের বাড়িতে আনা হবে।

নয়নের পরিবার সূত্রে জানা যায়, কৃষক আখতারুজ্জামানের এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। ছোট বেলা থেকে তাঁর ফায়ার সার্ভিসে কাজ করার স্বপ্ন ছিল। ২০২২ সালে সেই স্বপ্ন পূরণে যোগদান ফায়ার ফাইটারের চাকরিতে।

নয়ন ২০১৬ সালে ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৮ সালে ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ওই কলেজেই ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। এরপর ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন ২০২২ সালে। নয়নের মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশনে। সেটি ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত ছিল।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সোহানুজ্জামান নয়নের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। মৃত্যুর খবরে দূর দুরন্ত থেকে স্বজনের এসে ভিড় করছেন বাড়িতে। উঠান জুড়ে স্বজন প্রতিবেশীর আহাজারি আর কান্নার আওয়াজ।

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা নার্গিস বেগম বাড়ির উঠানে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। স্বজনেরা তেল লবণে মূর্ছা খুললে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘মাইনসের জান বাঁচপার যায়্যা মোর যাদু হারা গেল। বাবা, নয়ন তুই হামাক ছাড়ি গেলু কেন। তোক যে কছনু এগলা চাকরি করি দূরত্ব থাকার দরকার নাই। তুই যে কছলু খুব তাড়াতাড়ি হামার এত্তি আসি চাকরি করবু। তুই মোক একেবারে ছাড়ি গেল, মুই কি নিয়া বাঁচিম। কায় থাকবে তোর বাড়িত।’

প্রতিবেশী সাফিউল ইসলাম বলেন, নয়ন খুব নম্র ভদ্র ছেলে ছিল। ওর বাবার যা সম্পদ আছে তা দিয়ে গ্রামে কিছু করে ভালো দিন যেত। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন লক্ষ্য ছিল মহৎ। সে ছোট থেকেই মানুষের সেবায় বাহিনীতের চাকরি করেত চাইত। ফায়ার সার্ভিসেও চাকরি পায় সে। কিন্তু ঘাতক ট্রাক তাকে পিষে মারল। এটা খুব দুঃখের। তাঁর পরিবার এখন অসহায়।

নয়নের দুলাভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সচিবালয়ের মতো একটা জায়গায় আগুন লেগেছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত। এ সময় রাস্তা বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু কীভাবে সেখানে ট্রাক ঢুকে পড়ে চাপা দিয়ে মানুষ মারে? এটা ভাবার বিষয়? আমরা চাই আমার ভাইকে কেন, কারা কোন উদ্দেশ্যে মারল তাঁর সঠিক বিচার হোক।’

নিহত নয়নের বাবা আখতারুজ্জামান জানান, ‘নয়নের অনেক স্বপ্ন ছিল এই চাকরিকে ঘিরে। চাকরির পাশাপাশি প্রোমোশনের জন্য পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছিল। ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এই বছর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। এখন ছেলে আমার ফল প্রত্যাশী ছিল।’

পরিবারের অভিযোগ, আগুন নেভানোর সময় পুরো এলাকাটি সুরক্ষিত রাখা হলে এ ঘটনা ঘটত না। তারা ঘাতক ট্রাক চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলার অভিযোগও তুলেছেন স্থানীয়রা।

নয়নের মরদেহ আনতে ঢাকায় পৌঁছেছেন স্বজনরা। সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পৌঁছানোর কথা রয়েছে। পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা তাকে শেষবারের মতো দেখতে অপেক্ষা করছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত