এশিয়ার সবচেয়ে বড়

জামাল মো. আবু নাছের, মাধবপুর (হবিগঞ্জ)
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮: ৩০

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বানিয়াচং গ্রামটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম। পর্যটনবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার এই গ্রামটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম গ্রাম হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। বানিয়াচংয়ের সন্তান ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস গত শতকের তিরিশের দশকে সাইকেল চালিয়ে বিশ্বভ্রমণ করে খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, বানিয়াচং পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম।

দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বানিয়াচং বিস্ময়কর আয়তনের এক গ্রাম। এমনিতে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠিত হয়ে থাকে। অথচ বানিয়াচং গঠিত হয়েছে চারটি ইউনিয়ন নিয়ে। এই একটি গ্রামেই পাড়া-মহল্লা রয়েছে ১২৭টি। হাওরাঞ্চলের এই গ্রামে বসবাস প্রায় সোয়া লাখ মানুষের।

ইতিহাসবিদেরা বলছেন, বানিয়াচং গ্রামের গোড়াপত্তন হয়েছে দ্বাদশ শতাব্দীতে। প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাঁর বইতে লিখেছেন, সিলেটের ভাটি এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন জনপদ লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল এই বানিয়াচং। প্রাচীন স্থাপত্যকলার নানান নিদর্শন সেই ঐতিহ্য ধারণ করে টিকে আছে আজও। রয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ বছরের পুরোনো মুঘল আমলের মসজিদ, মন্দির, রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষসহ নানান পুরাকীর্তি। এর মধ্যে অন্যতম বড়বাজার লাগোয়া জমিদারবাড়িটি। ঈসা খাঁর বাড়ির আদলে নির্মিত এই জমিদারবাড়ির স্মৃতি এখনো ধরে রেখেছে একটি জলাধার, দুটি মসজিদ ও একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ। পর্যটকদের জন্য নতুন করে সেখানে দর্শনীয় স্থাপনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন রাজবাড়ীর উত্তরসূরিরা। বিথঙ্গল এলাকায় রয়েছে ৬০০ বছরের পুরোনো বৈষ্ণব আখড়া। ১২০ কক্ষবিশিষ্ট দালান নিয়ে গড়ে ওঠা এই আখড়াটিকে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় আখড়া হিসেবেই গণ্য করা হয়।

হাওরাঞ্চলের মন উথালপাতাল করা আবহাওয়া বানিয়াচংয়ের প্রকৃতিকে নৈসর্গিক করে তুলেছে। এতে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাশয় হিসেবে স্বীকৃত সাগর দিঘি।

৬৬ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত বানিয়াচংয়ের এই জলাশয়টি কমলা রানির দিঘি হিসেবেও সুপরিচিত। দিঘিটি নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তি হচ্ছে, দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করতে গ্রামের মধ্যভাগে বিশাল দিঘি খনন করেন। কিন্তু দিঘিতে পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজার স্ত্রী কমলাবতী এখানে আত্মাহুতি দেন। সেই কাহিনি নিয়ে বহু নাটক-সাহিত্য রচিত হয়েছে। পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন কবিতা লিখেছেন এই দিঘি নিয়ে। ময়মনসিংহ গীতিকার বেশ কিছু কাহিনির পটভূমি হিসেবেও উঠে এসেছে বানিয়াচং।

কেবল প্রকৃতি আর পুরাকীর্তি নয়, কীর্তিমান ব্যক্তিদের সূত্রেও খ্যাতি রয়েছে বানিয়াচংয়ের। ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের কথা তো আগেই বলেছি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোগী হেমন সেন থেকে শুরু করে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ফজলে হাসান আবেদ, প্রয়াত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীসহ অনেক কীর্তিমানের জন্মভিটাও বিরাট আয়তনের এই গ্রামে।

বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও অবকাঠামোর অভাবে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বানিয়াচং। ১৯৯৭ সালে এই এলাকার একটি জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কমলা রানির দিঘি ঘিরে এই এলাকাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন তিনি। তারপর পেরিয়েছে বহুকাল, কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানালেন, ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামকে ঘিরে পুরো বানিয়াচং উপজেলাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলমান। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত