‘এ রকম দুখিয়া দুখিয়া আমরা মরতে চাই না’

লবীব আহমদ, সিলেট 
Thumbnail image
কল্পনা ভূমিদ। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘যদি না পারে বেতন কড়ি দিতে, তে আমরারে কইয়ে দেউক যে আমরা দিতে পারতাম না। তোমরার বাগান যে বন্ধ আছে, বাগান তোমরার বন্ধই থাকুক। তোমরা যাও গিয়া। নাইলে আমরারে গুন্ডি দিয়া মারিয়া শেষ করিদেও। তেও আমরা শান্তিতে থাকমু। যদি মারিদেয় আমরারে, তেও শান্তি এনে থাকব সরকারে। আর আমরাও শান্তিয়ে মরিজাইমু। এ রকম দুখিয়া দুখিয়া আমরা মরতে চাই না।’

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির সিলেটের লাক্কাতুড়া চা-বাগানের চা-শ্রমিক কুলবতী লোহাল বেতন না পেয়ে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাগানে কাজ করেন এবং পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকেন। তাঁর আয়েই চলে সংসার। কিন্তু তিন মাস ধরে বেতন-রেশন পাচ্ছেন না। যে কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাঁর।

কুলবতী লোহাল বলেন, ‘আমরা তো আমাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়া শান্তি-শৃঙ্খলায় থাকতে চাই, শান্তি-শৃঙ্খলায় খাইতে চাই, বাচ্চাকাচ্চারে লেখাপড়া শিখাইতে পারি, একমুঠা ভাত দিতে পারি এগুলোই চাই। তারা পেটের ক্ষুধায় ছটফট করে, চারটা লাকড়ি নিয়া, আমরা কচুশাক নিয়া এই বাচ্চাগুলোরে খাওয়াই। এই অবস্থা কেনে আমাদের?’

এই চা শ্রমিক আরও বলেন, ‘আগে যেগুলো ঘটেনি, এখন এইগুলা ঘটিয়া যায়। কেনে যায় ঘটিয়া যায়?’

অন্তরা ভূমিদ। ছবি: আজকের পত্রিকা
অন্তরা ভূমিদ। ছবি: আজকের পত্রিকা

কুলবতীর লোহালের মতোই দিন কাটছে ওই বাগানসহ সিলেটের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিনটি বাগানের চা-শ্রমিকদের। বেতন-ভাতা ও রেশন না পেয়ে অনেকটা দিশেহারা হয়ে আছেন তাঁরা। ওই বাগানের আরেক শ্রমিক কৃষ্ণ গোয়ালা বলেন, ‘সাত সপ্তাহ ধরে আমরা বেতনভাতা পাচ্ছি না। যার কারণে আমাদের কাজকর্ম বন্ধ করে এখন আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমরা কীভাবে চলছি, এটা ওপরওয়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। আমাদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের জন্য এখন আন্দোলন করছি। এই ন্যায্য পারিশ্রমিকের জন্য যদি আমাদের জীবনও দিতে হয়, তাহলে আমরা সেটা দিতেও রাজি।’

শুধু এই তিনটি বাগানের চা-শ্রমিকেরা নয়, সিলেটের অন্যান্য বাগানের শ্রমিকরাও এ রকমভাবে দিনাতিপাত করছেন। ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন না রেশনও। বাগানে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুবই করুণ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন চা-শ্রমিকেরা।

সিলেটের ব্যক্তি মালিকানাধীন তারাপুর চা-বাগানে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন চা-শ্রমিকের সঙ্গে। তিন ছেলের মা কল্পনা ভূমিদ জানান, টাকাপয়সার অভাবে তিন ছেলের কাউকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তাঁর আয়েই চলে সংসার। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই তিনি বেতন পান না। এমনিতেই যে বেতন পান, সেই বেতনে পরিবার চলে না। তিনি বলেন, ‘সারা দিনে ২২ কেজি তুললে হয় হাজিরা। তাতে পাই ১৭০ টাকা। সংসার চলে কোনোমতে। এই কষ্ট করে চলতে হয়। কী করমু, আমরার তো অভাব। আমার ছেলে তিনটা। বড়টা সর্দারি করে আর বাকিগুলো বাড়িতে থাকে। বেতন নাই, বাচ্চাদের পড়াইতে পারি না। চলতে পারমু কেম্নে? নিজেই খাইতে পারি না। চালের দাম বেশি। সবজির দাম বেশি। বাগানে ঘরবাড়ি নাই। ঘর দিছে না, একেবারে ভাঙা ঘর। বেতন নিয়মিত দেয় না। ৩-৪ সাপ্তা বাদে একটা বেতন দেয়। সারা বকেয়া রইছে ৷ বকেয়া দেয় না। ২ সাপ্তা রইছে। রেশন যা দেয়, সেটায় হয় না।’

চা-শিল্প এমন হয়েছে যে, আগের মতো আর অতিরিক্ত কাজ করতে পারেন না শ্রমিকেরা। এতে করে সংসারে জনসংখ্যা ও জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বেতন আর বাড়ে না। এ বিষয়ে প্রতিমা ভূমিদ বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন চা-পাতা তুলি ২২ কেজি। ২২ কেজি নিরিক দিলে আমাদের দেয় ১৬৮ টাকা রোজ। যদি ভালো চা-পাতা হয় বাগানে, তাহলে আমরা প্রতিদিন জনে ৫০ থেকে ৬০ কেজি করে তুলতে পারি। আগে এক্সট্রা তুললে ৫ টাকা করে কেজি পাওয়া যেত। এখন এটাও পাইতেছি না। এখন আমাদের দুই সপ্তাহ বকেয়া রইছে। আমরা ঠিকমতো বেতন পাইতাছি না। আমাদের এই অল্প আয়ে চলতে পারি না, সংসার চালাতে পারি না। আমাদের বাচ্চাকাচ্চাকে ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না, পড়ালেখা করাইতে পারি না। আমাদের নানারকম সমস্যা আছে। আমাদের পরিশ্রম প্রচুর হয়, কিন্তু রুজিটা সেরকম হয় না।’

কুলবতী লোহাল। ছবি: আজকের পত্রিকা
কুলবতী লোহাল। ছবি: আজকের পত্রিকা

চা-শ্রমিকেরা বছরে দুর্গাপূজাতেই বোনাস পেয়ে থাকেন। তাতে তাদের ঘরে উৎসবের আমেজ আসে বছরে একবারই। এবারের দুর্গাপূজা করতে পারেননি বলেই কান্নাভেজা কণ্ঠে ওই বাগানের সুবর্ণা ভূমিদ বলেন, ‘এই যে দুর্গাপূজা গেছে, আমরা বাচ্চাকাচ্চারে ভালোটিকে পোশাক পরাইতে পারছি না, ভালো টিকে খাওয়াইতে পারছি না, বাচ্চাগুলো আনন্দ করতে পারছে না, পূজা করতে পারছে না, আমাদের ভেতর এটাই কষ্ট। আমাদের কোনোদিকে সাহায্যেও আসে না। আমরা কোনোদিকে সাহায্যও পাই না।’

সাধারণ মানুষদের মতো চা-শ্রমিকদের শরীরেও রোগ বাসা বাঁধে, তারা অসুস্থ হন। তাদের যে আয়, সেটা দিয়ে পরিবারই চলে না আর কীভাবে চিকিৎসা করাবে। অসুস্থ হলে নাপা ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছু মেলে না জানিয়ে অন্তরা ভূমিদ বলেন, ‘আমরা অসুস্থ হলে বাগানের অফিসে যাই। ওইখানে গেলেও অনেক অসুবিধা। আমরা প্রয়োজনমতো ওষুধ পাইতাছি না। অসুস্থ হলে পার্মেন্টদের ছুটি দেয় তিন দিন চার দিন। আর দেয় না। সেবার জন্যেও কোনো কিছু দেয় না। অসুস্থ হইলে ছোট বাচ্চাদেরকেও নাপা দেয়, বড় বাচ্চাদেরকেও নাপা দেয়, বড় মানুষদেরও। আর প্রেশারি যারা, উনাদের তো প্রেশারের ওষুধ দেয়। আর তেমন কিছু না। এছাড়া তো আমাদের আর কোনো পথ নাই। আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধাই পাই না। অসুস্থ হলে ক্যাপসুল দিয়াই সুস্থ হই, আর কিছু না।’

চা-শ্রমিকদের যে মজুরি, সেটা দিয়ে যেখানে একজন মানুষের চলাই দায়, সেখানে এই মজুরি দিয়ে একটি পরিবার চলে। অন্তরা ভূমিদ বলেন, ‘আমার পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছে। মা আর আমি কাজ করি। বাগানের বেতন দিয়ে চলে না। অনেক সময় কষ্ট হয়। বাগানের বেতন দিয়া তো অতটা করা সম্ভব নায়। অনেক কষ্ট হয় আরকি। যে সময় বেতন দেয় না, এক সপ্তাহ আটকাইয়া বাদের সপ্তাহে দেয়, ওই সময় বেশি কষ্ট হয়। আর এখন তো অনেক সমস্যা, অভাব। অভাব তো লেগেই থাকে। বাগানে কাজ করে তো সব অভাব মেটানো সম্ভব না। ১৭০ টাকা দিয়া হয় না। অনেক সময় কষ্টে পার করা লাগে। এখন তো আরও বেতন বন্ধ। আরও অনেক সমস্যা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত