মার্কিন খাদ্যপণ্যের আমদানি কমিয়ে বাণিজ্য যুদ্ধে শক্তিশালী চীন

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯: ২৭
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত রোচডেল হডজেন ফার্মের একটি ক্ষেত থেকে সয়াবিন কাটা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের শীর্ষ কৃষিপণ্য আমদানিকারক দেশ চীন ২০১৮ সাল থেকে খাদ্য আমদানির উৎস পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এতে মার্কিন কৃষিপণ্য আমদানির ওপর চীনের পাল্টা শুল্ক আরোপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ সৃষ্টি হলেও চীনের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।

অদূর ভবিষ্যতে চীন একটি বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছেন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য নীতিতে কঠোর অবস্থান নিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ট্রাম্পের শাসনামলে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যর ওপর নির্ভরতা কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য কাজ করেছে। ২০১৮ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন, গরুর মাংস, শূকরের মাংস, গম, ভুট্টা এবং সোরঘামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এটি ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পাল্টা জবাব।

মার্কিন ডলারে চীনের কৃষি আমদানির গ্রাফচিত্র। ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন ডলারে চীনের কৃষি আমদানির গ্রাফচিত্র। ছবি: সংগৃহীত

যদিও ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প ও চীনের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লিউয়ের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিনামায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ও পরিষেবার ক্রয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের আমদানি কমেছে।

বর্তমানে চীন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কম শস্য কিনছে। পরিবর্তে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন এবং অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে বেশি শস্য আমদানি করছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের সয়াবিনের আমদানির পরিমাণ ছিল ৪০ শতাংশ। ২০২৩ সালে এটি কমে ১৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে ব্রাজিল থেকে চীনের সয়াবিন আমদানি ৪৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই বছর চীনের ভুট্টা আমদানিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে ব্রাজিল প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। অথচ মাত্র এক বছর আগেই ব্রাজিলের সঙ্গে কৃষিপণ্যের বাণিজ্য শুরু করে চীন।

এদিকে, চীনা পশুখাদ্য উৎপাদনকারীরা আমদানি করা সয়াবিনের ওপর নির্ভরতা কমাতে সয়ামিলের ব্যবহার হ্রাস করেছে। একই সময় উৎপাদন বাড়াতে জেনেটিক্যালি মডিফাইড সয়াবিন ও ভুট্টার অনুমোদন দিয়েছে।

মেট্রিক টনে চীনের সয়াবিনের আমদানি পরিমাণ। গত এক দশকে চীনের বাজারে মার্কিন সয়াবিন বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ছবি: সংগৃহীত
মেট্রিক টনে চীনের সয়াবিনের আমদানি পরিমাণ। গত এক দশকে চীনের বাজারে মার্কিন সয়াবিন বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ছবি: সংগৃহীত

চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ট্রাম্পের একজন মুখপাত্র চীনে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানি কমে যাওয়া নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি ট্রাম্পের একটি বক্তব্যের উল্লেখ করেছেন, যেখানে ট্রাম্প শুল্ককে ‘সুন্দর শব্দ’ বলে অভিহিত করেছেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ থেকে বিপুল রাজস্ব পাবে।

অন্যদিকে, হ্যারিসের ক্যাম্পেইন ওয়েবসাইট বলেছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কোনো অন্যায্য বাণিজ্য নীতি সহ্য করবেন না।

কৃষিপণ্য মজুত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন পরবর্তী উত্তেজনার আশঙ্কায় সম্প্রতি চীনা ক্রেতারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানি বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকেরা। প্রাণী খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত সয়াবিনের আমদানি চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৮ শতাংশ, বার্লি ৬৩ শতাংশ ও সোরঘামের আমদানি ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানির পরিমাণ। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানির পরিমাণ। ছবি: সংগৃহীত

চীনে শস্য ও তেলবীজ বিক্রিকারী একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই সময়টি ভিন্ন। প্রয়োজনীয় পণ্যে চীন ভালোভাবেই মজুত রেখেছে। এবার কোনো সরবরাহের ধাক্কা দ্রুত লাগবে না। পরিকল্পনা ও কেনাকাটা পুনর্নির্দেশ দিতে চীনের হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন রপ্তানি বর্তমানে গত ১৪ মাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে, কারণ শস্য ব্যবসায়ীরা নির্বাচনের আগে রেকর্ড ফসল সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় রয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্যে ইটের বদলে যুক্তরাষ্ট্রকে পাটকেল মারার জন্য চীন খাদ্যশস্যকে বেছে নেবে না, কিন্তু বড় কোনো সংঘাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী বাধ্য হতে পারে বলে মত দেন নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ওয়েনডং ঝাং। তিনি বলেন, বাণিজ্যে সমতা বজায় রেখে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যে শুল্ক আরোপ করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে আঘাত হানতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য উদ্বৃত্ত শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসেই ৩৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছিল, ফলে চীন ভেবেচিন্তেই পা বাড়াবে।

চীনের ট্রিভিয়াম কনসালটেন্সির কৃষি বিশ্লেষক ইভেন পে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনের খাদ্য নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় বেইজিং অনেক বেশি নিরাপদ মনে করছে। এখন যেকোনো বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের চাপ দিতে পারবে না। এটি একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ।’

তবে কমনওয়েলথ ব্যাংকের বিশ্লেষক ডেনিস ভোজনেসেনস্কি চীন বলেছেন, মার্কিন কৃষিপণ্যের ওপর চীনের নির্ভরতা কিছুটা কমাতে পারে, কিন্তু তা সীমিত মাত্রায়। কিছু বিকল্প পণ্য পাওয়া গেলেও উৎসের সংখ্যা খুবই কম।’

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকেরা ঝুঁকিতে

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নতুন শুল্ক আরোপ করা হলে মার্কিন কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দিক থেকে।

জরিপে হ্যারিস ও ট্রাম্পের লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হলও বেশির ভাগ কৃষিপ্রধান রাজ্যে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্পের আগের মেয়াদে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের জন্য ক্ষতিকারক ছিল। ওই সময় ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন কৃষকদের প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।

মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে সয়াবিন রপ্তানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আয় ১৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর এর প্রায় অর্ধেকই চীনে রপ্তানি করা হয়েছে। আমেরিকার কৃষকেরা শস্যের কমদাম নিয়ে উদ্বিগ্ন ও শস্যের বিশ্ব সরবরাহ পর্যাপ্ত হওয়ায় তাঁরা ক্ষতির আশঙ্কা করছে।

উত্তর ইলিনয়ের একজন সয়াবিন চাষি মার্ক টাটল বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা পৃথিবীর একমাত্র সয়াবিন উৎপাদক নই। দক্ষিণ আমেরিকা প্রচুর সয়াবিন উৎপাদন করছে। যদি আমরা আরও শুল্ক আরোপ করি তাহলে তা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত