সবুজ অর্থায়নে বিপ্লব

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
Thumbnail image

সবুজ অর্থায়নে দেশে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সরকারি ও বেসরকারি সব পরিকল্পনায় এখন সবুজ অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসা টেকসই করতে উদ্যোক্তাদের সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগ ঝোঁক বেড়েছে। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক দশকের ব্যবধানে এ খাতে তাদের ঋণ বিতরণ আগের তুলনায় ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সবুজ অর্থায়নের সার্বিক বিনিয়োগে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতে অর্থায়ন বেড়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে দেশে টেকসই সবুজ অর্থায়নের প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

সবুজ অর্থায়ন হলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা। যেখানে গৃহীত শিল্প কিংবা কোনো অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনায় পরিবেশগত ঝুঁকি এবং পরিবেশগত ঘাটতি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়; যা সরাসরি পরিবেশগত অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) গ্রিন ইকোনমি পর্যালোচনা বলছে, ‘সবুজ হতে হলে একটি অর্থনীতিকে কেবল দক্ষই নয়, ন্যায্যও হতে হবে ৷ ন্যায্যতা মানে বৈশ্বিক এবং দেশীয় পর্যায়ের সমতার মাত্রাকে স্বীকৃতি দেওয়া, বিশেষ করে একটি অর্থনীতিতে ন্যায্য রূপান্তর নিশ্চিত করা; যা কম কার্বন, সম্পদ দক্ষ এবং সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আন্তর্জাতিক চাপে দেশে এই সবুজ অর্থায়নের বিপ্লবে গতি আসে। এতে বদলে যায় দেশে শিল্পোদ্যোক্তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা। সবার জন্য কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখতে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লানের আওতায় শিল্প-কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কার আনার পাশাপাশি ভেতরে-বাইরের দৃশ্যপটেও লাগে সবুজের ছোঁয়া। অর্থাৎ কমপ্লায়েন্স উন্নয়নের লক্ষ্যে সবুজ অর্থায়নের এই বিপ্লব শুরু হওয়ার পর দেশকে আর বিশ্ব দরবারে বদনামের ভাগীদার হতে হয়নি; বরং আগে যেখানে একটি সবুজ অর্থায়নের বিনিয়োগ প্রকল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিলের ব্যাপার হতো, সেখানে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে শিল্প খাত তথা সরকারি-বেসরকারি যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা অন্য কোনো পরিকল্পনা তৈরির আগেই সবুজ বিনিয়োগের কথা সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাবিদ বা বিনিয়োগকারীকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে। সেটি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে; যার সুফলও পাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ সবুজ কারখানার ৫৪টিই এখন বাংলাদেশের দখলে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দখলে এখন ২২৯টি সবুজায়ন কারখানা।

শুধু শিল্প বিনিয়োগেই নয়, সরকারি কর্মপরিকল্পনায় এখন অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততার ঝুঁকিগুলো কমাতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর সরকারি-বেসরকারি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে সম্পৃক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সবুজ অর্থায়নে শুধু দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা; যা মার্চ প্রান্তিকে ছিল ৮৮ হাজার ৬৯৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে টেকসই খাতে ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করেছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮০৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা, এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করেছে ২ হাজার ৯৯২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স পলিসি অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সাসটেইনেবল ফিন্যান্সের ১১টি ক্যাটাগরিতে মোট ৬৮টি পণ্যের বিপরীতে এই ঋণ দিচ্ছে, যার অধিকাংশই সবুজ অর্থায়নের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এনবিএফআই) উৎসাহিত করে আসছে। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাসটেইনেবল রেটিং বা টেকসই মান প্রকাশ করছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই মান যাচাই করা হয়। সূচকগুলো হলো টেকসই অর্থায়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম, পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন, টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচক এবং ব্যাংকিং সেবার পরিধি। তারই অংশ হিসেবে অনেক ব্যাংক তাদের শাখা ও এটিএমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়িয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক কাগজের ব্যবহারও কমিয়ে এনেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সম্পর্কিত কার্যকর নীতি উদ্যোগ দেশে সবুজ অর্থায়নের এই বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এখানে পুনঃঅর্থায়ন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও ঋণ ও সিএসআরের অর্থ দিচ্ছে। আগের চেয়ে এটা অনেক বেড়েছে, আরও বাড়বে; যা সবুজ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত