Ajker Patrika

আউটসোর্সিংয়ের কর্মী

ছাঁটাই নিয়ে টেলিকম খাতে অস্থিরতা

  • মৌখিক চুক্তিতে বছরের পর বছর কাজ করছেন শত শত প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান।
  • আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান চাকরিচ্যুত
  • আন্দোলনে কর্মীরা। মোবাইল ফোনসেবা বিঘ্নের শঙ্কা।
আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৬: ৩৭
অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ ও বকেয়া পরিশোধের দাবিতে জিপি হাউসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মীরা। ফাইল ছবি
অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ ও বকেয়া পরিশোধের দাবিতে জিপি হাউসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মীরা। ফাইল ছবি

দেশের টেলিকম খাতের কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতির ঘটনায় খাতজুড়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি স্থায়ী ও বকেয়া পাওনা পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন দেশের বৃহৎ তিন টেলিকম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের সঙ্গে যুক্ত কয়েক শ আউটসোর্সিং-কর্মী। কর্মী ছাঁটাই বন্ধ এবং চাকরি স্থায়ী না করলে দেশের মোবাইল ফোনসেবা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তাঁরা। এতে যেকোনো সময় টেলিযোগাযোগ সেবায় বিপর্যয় নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্দোলনরত কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে সংকট সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে, মূলত তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টির হয়ে টেলিকম খাতের কাজে নিযুক্ত কর্মীরাই এসব দাবিতে এক হয়েছেন। বছরের পর বছর অস্থায়ী চুক্তিতে কাজ করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ এনে এর সমাধানের জন্য আন্দোলন করছেন তাঁরা।

দেশের প্রতিটি মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের টাওয়ার ও সাইট রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেখভালের জন্য তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বা ইজারা দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ দিয়ে সেবা পরিচালনা করে। তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে ও চুক্তিতে প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়। এই প্রক্রিয়ায় শত শত কর্মী চুক্তিতে কাজ করে মোবাইল ফোনসেবা অব্যাহত রাখেন। তবে থার্ড পার্টি এসব কর্মীর সঙ্গে মজুরি পাওনা ও ভাতা নিয়ে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা করে বলে অভিযোগ তাঁদের।

টেলিকম সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক তাদের টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণসহ ফিল্ড অপারেশনের জন্য ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ লিমিটেড, সার্চলাইট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও আইএমএস লিমিটেড নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী নিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে তিন মাস বা নব্বই দিন করে চুক্তি করে বাংলালিংককে সেবা দেয়। এসব কর্মী দেশব্যাপী বাংলালিংকের টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করেন। তবে গত ২৬ জানুয়ারি ও ২ ফেব্রুয়ারি এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ১৩২ জনকে পূর্বঘোষণা ছাড়াই চাকরিচ্যুত করার নোটিশ দেওয়া হয়।

চাকরিচ্যুত কর্মীদের একজন প্রকৌশলী মানিক উদ্দিন বলেন, ফ্রন্টডেস্ক লিমিটেড কর্তৃপক্ষ কোনো ঘোষণা ছাড়াই মার্চ থেকে সবাইকে চাকরিচ্যুত করার নোটিশ দিয়েছে মেইলে। রোজার ঈদের আগেই এভাবে চাকরিচ্যুত করাটা আইনবিরোধী। শ্রম আইন ও বিধিমালা অনুসারে যেসব সুবিধা তাঁদের পাওয়ার কথা, তা তাঁরা পাননি। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর শ্রম আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করে আসছে।

চাকরিচ্যুতির নোটিশ পাওয়ার পর প্রতিকার চেয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি লেখেন ১৩০ প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান।

ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে বাংলালিংকে নিয়োগ পাওয়া প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান শিকদার বলেন, প্রতিকার চেয়ে আমরা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানেও চিঠি লিখেছি।

জানতে চাইলে ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ শামীম আহমেদ আজকের পত্রিকা'কে বলেন, চাকরিচ্যুতদের বিষয়টি অফিশিয়াল একটি প্রক্রিয়া ছিল। তাই তাঁদের চাকরিচ্যুতির নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁদের চাকরিতে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলালিংকের একটি নির্দেশনা আছে। সে জন্য কাজ চলছে।

এদিকে চাকরিচ্যুতির নোটিশ পাওয়া রাজধানীসহ ১৬ জেলার কর্মীরা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে ১১ ফেব্রুয়ারি দেখা করেন। তাঁর কাছে নিজেদের অভিযোগের কথা জানান। উপদেষ্টা তাঁদের আশ্বস্ত করেন। এভাবে সরকারের বিভিন্ন মহলে চাকরিচ্যুতরা চিঠি দেওয়ার পর নড়েচড়ে বসে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন তৌহিদ আহমেদ বলেন, কর্মীদের চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই।

আরেক বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি নিজেদের নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, পিপলস্কেপ লিমিটেড, ই-জোন লিমিটেড এবং এইচএস ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী আউটসোর্সিং করে থাকে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ১২ ফেব্রুয়ারি একযোগে ২২০ জনকে চাকরিচ্যুত করে। তাঁরা সবাই ১২ থেকে ১৪ বছর ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের হয়ে রবির ফিল্ড অপারেশনের কাজ করতেন। এক যুগ আগে নিয়োগের সময় তাঁদের সঙ্গে কেবল ৯০ দিনের লিখিত চুক্তি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে এরপর আর চুক্তি নবায়ন করা হয়নি। মৌখিক চুক্তিতেই কাজ করছিলেন তাঁরা।

জানা গেছে, ইডটকো এসব কর্মীকে নিয়োগ দিলেও এরপর অপর তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে তাঁদের ভাগ করে দেয়। তাঁদের মজুরিও পরিশোধ করত ওই তিন প্রতিষ্ঠান। মূলত কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই কৌশলী অবস্থান নেয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

ইডটকোর হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার পর সম্প্রতি চাকরিচ্যুত হয়েছেন প্রকৌশলী (রিজিওনাল অপারেশনাল ম্যানেজমেন্ট) আল আমিন বিদ্যুৎ। তিনি জানান, এক যুগ আগে পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি ইডটকোতে নিয়োগ পান। এরপর থেকেই রবির নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছেন। নিয়োগের সময় একবার ইডটকো তিন মাসের জন্য তাঁর সঙ্গে চুক্তি করেছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি করেনি। মৌখিক চুক্তিতে কাজ করছেন এক যুগ ধরে। নিয়োগ ইডটকোর হলেও তাঁকে পিপলস্কেপের হয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তারাই বেতন দিচ্ছে। তবে কোনো কারণ ছাড়াই ১২ ফেব্রুয়ারি পিপলস্কেপ একটি গণপদত্যাগপত্রে তাঁদের সবাইকে স্বাক্ষর করতে বলেছে।

রবির নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা এমন ২২০ জনকে সম্প্রতি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁদের চাকরি রয়েছে। চাকরিচ্যুতরা ইতিমধ্যে প্রতিকার চেয়ে বিটিআরসির মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারীর কাছে একটি আবেদন দিয়েছেন। এ ছাড়াও তাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে পিপলস্কেপের মানবসম্পদ বিভাগের এক্সিকিউটিভ সৈয়দ আলী আহসান বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান ১২০ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে। তিন মাস পরপর চুক্তি করার কথা থাকলেও তিনি গত সাত মাসে চুক্তি করতে দেখেননি।

আউটসোর্সিং-কর্মীদের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, বিটিআরসির অন্যতম লাইসেন্সপ্রাপ্ত টাওয়ার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইডটকোর কাছে দীর্ঘমেয়াদি ইজারার মাধ্যমে রবি টেলিযোগাযোগ সেবা দেন। রবি টাওয়ার কোম্পানিগুলোর সহায়তায় তারা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে চলেছে।

বাংলালিংক ও রবি ছাড়া গ্রামীণেও চলছে অস্থিরতা। ‘চাকরিচ্যুত ও অধিকারবঞ্চিত গ্রামীণফোন শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে কয়েক শ কর্মী আন্দোলন করছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে ৩ হাজার ৩৬০ কর্মীকে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ৫ শতাংশ লভ্যাংশ পরিশোধের দাবি তুলে ধরেন চাকরিচ্যুত কর্মীরা।

চাকরিচ্যুত ও অধিকারবঞ্চিত গ্রামীণফোন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আবু সাদাত মো. শোয়েব বলেন, ৫ শতাংশ লভ্যাংশ না দিলে ২৫ তারিখ থেকে গুলশানের জিপি হাউসের সামনে তিন হাজার কর্মী অবস্থান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস আংকিত সুরেকা বলেন, ‘গ্রামীণফোনের কিছু সাবেক কর্মী চাকরি সংক্রান্ত কিছু দাবি–দাওয়া নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে জিপি হাউসের সামনে সমবেত হচ্ছেন। আমাদের জানা মতে, তাঁদের বেশিরভাগ বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যান এবং আইন অনুযায়ী তাঁদের প্রাপ্য গ্রহণ করেন। এছাড়া তাঁরা যে দাবিগুলো তুলেছেন সেগুলো বর্তমানে মহামান্য আদালতে বিচারাধীন। বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি গ্রামীণফোন শ্রদ্ধাশীল। তাই আদালতে এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে।’

তিনি বলেন, ‘দেশজুড়ে গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানে সংকল্পবদ্ধ গ্রামীণফোন। গ্রামীণফোন শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ওই ব্যক্তিরা জিপি প্রাঙ্গণের প্রবেশ ও বহির্গমনের পথ অবৈধভাবে অবরুদ্ধ করেছে। এর ফলে আমাদের কর্মী ও গ্রাহকদের অবাধ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্রামীণফোন দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কর্মী ও গ্রাহকদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। ব্যক্তি ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিপি হাউস সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আইএমইডির নভেম্বর মাসের প্রতিবেদন: এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা

  • পাঁচ মাসেই ব্যয় কমেছে ৬ হাজার কোটি।
  • শুধু নভেম্বরে ব্যয় কমেছে ৪ হাজার কোটি।
  • সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট।
  • নির্বাচন ইস্যুতে প্রকল্পের গতি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ১৪
আইএমইডির নভেম্বর মাসের প্রতিবেদন: এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের উন্নয়ন ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়ে, তেমনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বড় হলেও বাস্তব অগ্রগতি একেবারেই হতাশাজনক।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ১১.৭৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ৩৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় পিছিয়ে আছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প যেন এগোচ্ছেই না। সরকারি তহবিল, বৈদেশিক সহায়তা ও সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন—প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন ব্যয়ের এ তিন উৎসের প্রতিটিতেই যেন মন্থরতা লক্ষণীয়।

শুধু অর্থবছরের সার্বিক পরিস্থিতিই নয়, এডিপির মাসওয়ারি অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নভেম্বর মাসের তথ্য আরও চিন্তার। এই এক মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৮ হাজার ১৬৫ কোটি টাকার মতো, যেখানে আগের বছরের নভেম্বরেই ব্যয় ছিল ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক মাসেই ব্যয় কমে গেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতির হার মাত্র ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধীরগতি কোনো স্বাভাবিক মৌসুমি প্রবণতা নয়; বরং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ভেতরে জমে থাকা নানা অচলাবস্থার ফল।

প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব, টেন্ডারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া, দক্ষ ঠিকাদারের অভাব, মাঠপর্যায়ে প্রকৌশল বিভাগগুলোর সংকোচন—এসব মিলেই উন্নয়ন ব্যয় জমে থাকছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনে তৈরি হওয়া মন্থরতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা। আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে পুরো প্রশাসনিক কাঠামো একধরনের অচল অবস্থায় ছিল, যার ধাক্কা এখনো পুরোপুরি কাটেনি।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ব্যয়ে বৈষম্যও স্পষ্ট। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সংসদবিষয়ক সচিবালয় মন্ত্রণালয় পাঁচ মাসে এক টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। কিছু বিভাগ অগ্রগতি দেখালেও, তা সমগ্র চিত্র বদলে দেওয়ার মতো নয়। বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ ১৩২.৭৮ শতাংশ ব্যয় করেছে, যা বরাদ্দের চেয়েও বেশি ব্যয়—এটি চলমান প্রকল্পগুলোর প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইএমইডির মতে, প্রকৃত ব্যয় ও আর্থিক প্রতিবেদনের মধ্যকার এ ধরনের ব্যবধান ভবিষ্যতে প্রকল্প মূল্যায়নকে আরও জটিল করে তুলবে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলছেন, ‘বাস্তবায়নের হার স্পষ্টতই কম। শুধু সংখ্যা নয়, কেন এই অবস্থা, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় ব্যবস্থাপনায় আরও ধীরতা দেখা দিতে পারে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে বলেন, অর্থবছরের শুরুতে সাধারণত কিছুটা ধীরতা দেখা গেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকালীন প্রশাসন সাধারণত ঝুঁকিনির্ভর হয় না, ফলে প্রকল্পের গতি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

সব মিলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দ্বিধা এবং মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণহীনতা মিলিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন খুব কঠিন—এমনটি ধারণা করা হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের ভেতরেও।

চলতি অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম পাঁচ মাসে যে গতি দেখা গেছে, তাতে বছরের শেষে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্ন এখন আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ডলারের বিপরীতে রুপির আরও দরপতন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার। ছবি: সংগৃহিত
ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার। ছবি: সংগৃহিত

যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান আরও ২৩ পয়সা কমে ৯১ দশমিক ০১-এ পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে এখন পর্যন্ত এটিই রুপির সর্বনিম্ন দর। ধারাবাহিক বিদেশি তহবিলের প্রস্থান, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনায় স্থবিরতা এবং স্থায়ী ডলার ক্রয়কে এই পতনের মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, গতকাল মঙ্গলবার দিনের শুরুতে রুপি ৩৬ পয়সা কমে ৯১ দশমিক ১৪-এ পৌঁছায়, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন, পরে সামান্য পুনরুদ্ধার হয়। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে এবং ডলারের শক্তি কিছুটা কমেছে, তারপরও রুপির পতন অব্যাহত রয়েছে।

গত ১০টি লেনদেনের দিনে রুপি ৯০ থেকে ৯১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। শুধু গত পাঁচ দিনে রুপির মান ডলারের তুলনায় ১ শতাংশ কমেছে। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম চলতি মাসে ৯২ ছাড়িয়ে যাবে।  

আজ মঙ্গলবার আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রুপি ৯০ দশমিক ৮৭ থেকে লেনদেন শুরু হয়। পরে ৯০ দশমিক ৭৬ থেকে ৯১ দশমিক ১৪-এর মধ্যে ওঠানামা করে। শেষে ৯১ দশমিক ০১-এ বন্ধ হয়। গত সোমবার রুপি ৯০ দশমিক ৭৮-এ বন্ধ হয়েছিল, যা আগের দিনের তুলনায় ২৯ পয়সা কম।

ফিনরেক্স ট্রেজারি অ্যাডভাইজার্সের হেড অব ট্রেজারি অনিল কুমার বানসালি বলেন, ‘ডলারের ক্রয় অব্যাহত থাকায় রুপি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের নতুন বাণিজ্য প্রস্তাব মেনে না নেওয়ায় চুক্তি স্থগিত রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের আবেদন করল পেপ্যাল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৬
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের আবেদন করল পেপ্যাল

ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানি পেপ্যাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, এটি পেপ্যাল ব্যাংক তৈরি করার জন্য ইউটাহ ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস এবং ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনে আবেদন জমা দিয়েছে।

পেপ্যালের প্রধান নির্বাহী অ্যালেক্স ক্রিস বলেন, ‘পুঁজির নিরাপত্তা ছোট ব্যবসাগুলোর বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা। পেপ্যাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা ছোট ব্যবসার উন্নয়ন এবং মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।’

১৯৯৮ সালে ইলন মাস্ক ও পিটার থিয়েল পেপ্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি গ্রাহককে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। মার্কিন ব্যাংকিং লাইসেন্স পাওয়ার পর কোম্পানি তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে গ্রাহকের আমানতকে ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনে বিমার আওতায় আনতে পারবে।

পেপ্যালের আবেদন এসেছে এমন সময়ে, যখন একাধিক ক্রিপ্টো কোম্পানি এবং নিওব্যাংক এই বছরে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি সুবিধা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকিং খাতে প্রবেশের সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করছে। এ বছরের মধ্যে নুবাঙ্ক, কয়েনবেসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং চার্টারের জন্য আবেদন করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সোনার দাম ভরিতে ১৪৭০ টাকা বাড়ল

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশের বাজারে সোনার দাম আরও বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) সোনার দাম বাড়ানো হয়েছে ১ হাজার ৪৭০ টাকা। এতে এক ভরি সোনার দাম ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৭ টাকা হয়েছে।

স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পাকা সোনা) দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই দাম বাড়ানো হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।

সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটি বৈঠক করে এই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরে কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এর আগে ১৪ ডিসেম্বর ভালো মানের প্রতি ভরি সোনার দাম বাড়ানো হয় ৩ হাজার ৪৪২ টাকা এবং ১২ ডিসেম্বর ভালো মানের প্রতি ভরি সোনার দাম বাড়ানো হয় ১ হাজার ৫০ টাকা। এই দাম বাড়ানোর ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে এখন আবার দাম বাড়ানো হলো।

এখন সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনায় ১ হাজার ৪৭০ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৭ টাকা। ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনায় ১ হাজার ৪১১ টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৭ হাজার ২১১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনায় ১ হাজার ২৪৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনায় ১ হাজার ৬৩ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ টাকা।

বিষয়:

দামসোনা
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত