খাদ্যের দাম বিশ্বে কমে, দেশে বাড়ে

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ২১
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯: ০৬

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে স্বস্তিতে আছে বিশ্ববাসী। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (এফএও) জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে ছিল। যদিও একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে প্রায় দিশেহারা ছিল বাংলাদেশের মানুষ। কারণ, এখানে গত তিন বছরে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলু, চিনিসহ কয়েকটি পণ্যের দাম ন্যূনতম ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই বাড়ার চিত্র খোদ সরকারি হিসাবে। বাস্তবে তা আরও বেশি।

গত শুক্রবার এফএও তাদের মাসিক ‘ফুড প্রাইস ইনডেক্স’ বা খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক প্রকাশ করেছে। সেই সূচকে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে থাকা খাদ্যপণ্যের মূল্য মার্চ মাসে এসে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যসূচক ছিল ১১৭ পয়েন্ট (১০০ পয়েন্ট হচ্ছে ভিত্তি)। আর মার্চ মাসে তা সামান্য বেড়ে হয়েছে ১১৮ পয়েন্ট। ফেব্রুয়ারির খাদ্য মূল্যসূচক ১১৭ পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যসূচক এই স্তরে ছিল। এফএও বলছে, মার্চ মাসে যে বিশ্ববাজারে খাদ্য মূল্যসূচক সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা মূলত ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদার কারণেই হয়েছে। তবে এখনো বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমতির দিকে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

বিশ্ববাজারের ঠিক উল্টো চিত্র দেখা গেছে বাংলাদেশের বাজারে। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে এখানে কয়েক বছর ধরে জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বাড়িয়েছেন আমদানিকারকেরা। এরই ধারাবাহিকতায় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন পণ্যের দাম।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির ২০২১ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৪ মার্চ সরু চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা। একই চাল তিন বছর পর ৭৬ টাকায় বিক্রি হয়। দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। তিন বছরে খোলা আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৭১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এ ছাড়া লুজ সয়াবিন তেলের দাম ২৫ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ ও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ২৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। বড় দানা ডালের দাম বেড়েছে ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। দেশি ডালের দাম বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৪০ শতাংশ। দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ১২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে ৯১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। দেশি আদার দাম বেড়েছে ২২০ শতাংশ। আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ১০৯ শতাংশ। গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আলুর দাম বেড়েছে ১২৫ শতাংশ ও চিনির দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশ।

প্রতিবার দাম বাড়ানোর সময় একেক অজুহাত দেখিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কখনো কোভিড, কখনো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আবার ডলারের দর বাড়া। তবে বাজার বিশ্লেষকেরা জানান, যতই তাঁরা যুক্তি দেখান না কেন, এখানে অতিমুনাফালোভী চক্র সক্রিয় থাকার কারণেই মূলত জিনিসপত্রের দাম এত লাগামহীন বেড়েছে। কারণ এ সময়ে আমদানি করা পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে, একই তালে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়েছে। অথচ এসব পণ্য আমদানিতে ডলার লাগেনি, জাহাজভাড়া দিতে হয়নি কিংবা যুদ্ধের কারণে সরবরাহব্যবস্থায় কোনো বাধা তৈরি হয়নি।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুল হক কাজল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হারের যে অস্থিতিশীলতা, জিনিসপত্রের দাম অসহনীয় করার ক্ষেত্রে এটিকে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলায় সংকটকেও দায়ী করা হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার পেছনেও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়া, আমদানি করা কাঁচামালের দাম বাড়া ও পরিবহনের খরচকে দায় দেওয়া হয়।

এসব কারণ অবশ্যই আছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ যথাযথ হলে দাম বাড়া আরও সহনীয় মাত্রায় রাখা যেত। এই সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা ছিল। সরকার জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে অথচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাহলে এ দাম ঠিক করে দেওয়ার অর্থ কী? এটি একটি ভুল পথ।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সময়ে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কিংবা ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে। অথচ এ সময়ে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দামের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দামের কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে এটি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বলা যায়, তারও প্রায় এক বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এই উচ্চহার বজায় থাকে। অথচ এ বছরের জানুয়ারিতে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় হওয়ায় ভারতের মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৫.১৯ শতাংশ।

প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা রীতিমতো খাদের কিনার থেকে ফিরে এসেছে। দেশটির মূল্যস্ফীতিও ঈর্ষণীয়ভাবে কমেছে। জিনিসপত্রের মূল্যে শক্ত নজরদারির কারণে দেশটির মূল্যস্ফীতি চলতি মার্চে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে এসে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে দেশটির পরিসংখ্যান অফিস।

প্রতিবেশী নেপালের মূল্যস্ফীতির হার চলতি বছরের জানুয়ারিতে হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সময়ে ভুটানের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শুধু প্রতিবেশী দেশ বলেই নয়, জিনিসপত্রের উত্তাপে পানি ঢেলে দিয়েছে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও। দেশটিতে ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশে।

বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম এখনো কেন সহনীয় পর্যায়ে আসেনি জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আসলে আমদানি করা পণ্যের দামের পেছনে তো ব্যবসায়ীদের একটা অজুহাত থাকে। তারা দাম বাড়ায়, আমরা কিছু অভিযান করলে আবার দাম কমে আসে। পেঁয়াজ, ডিম, আলুর অবস্থা তো সবাই জানেন। আসলে কেনাকাটায় সবার সচেতন হওয়ার ব্যাপার আছে।  মানুষ সচেতন হচ্ছেও। তরমুজের দাম কমে যাওয়া কিন্তু সচেতনতারই ফল।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত