রোকন উদ্দীন, ঢাকা
প্রকৃতির এক আশ্চর্য উপহার মধু। মিষ্টি স্বাদ আর গুণাগুণের জন্য মানুষের মনে এর জায়গা চিরকালীন। এক ফোঁটা মধু জিহ্বায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মন থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত গভীর আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
মধু শুধু স্বাদের জন্য নয়, উপকারিতার জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছে। এটি ‘সব রোগের মহৌষধ’ হিসেবে পরিচিত। পুষ্টিবিদেরা বলেন, মধুতে গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, খনিজ লবণ, অ্যামাইনো অ্যাসিডসহ প্রায় ৪৫টি পুষ্টি উপাদান থাকে। ১০০ গ্রাম মধুতে ২৮৮ ক্যালরি শক্তি থাকে, যা শরীর চাঙা রাখতে সাহায্য করে।
একসময় বন-জঙ্গল থেকে মৌয়ালেরা মধু সংগ্রহ করতেন, যা দাদি-নানিরা বোতলে জমাতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মধু উৎপাদন থেকে বাজারে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে এবং শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে মধু নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে গবেষক, চাষি, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মাঝে সেতুবন্ধ গড়ে উঠেছে। এর সদস্যসংখ্যা ২৬ হাজারের বেশি। প্রতিবছর জাতীয় মৌমাছি ও মধু সম্মেলন, প্রদর্শনী, সেমিনার, মধুমেলা এবং সুন্দরবনে হানি ট্যুরিজমের কার্যক্রমও চলছে।
বর্তমানে দেশে মধুর বার্ষিক বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে প্রাকৃতিক ও চাষ থেকে ২০-২৫ হাজার টন মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০-৯৫% চাষের। তবে দেশে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংগ্রহের আধুনিক ব্যবস্থা কম, তাই প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার টন মধু আমদানি করা হচ্ছে।
গবেষক ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, মধু শুধু পুষ্টি ও স্বাদের বিষয় নয়, এটি একটি বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। একটু পরিকল্পনা ও যত্ন নিলে এই শিল্পকে দেশের অর্থনীতির এক শক্তিশালী খাতে রূপান্তর করা সম্ভব। যদি এই খাতে উন্নতি ঘটে, দেশের বার্ষিক মধু উৎপাদন ২ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে, যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকায়।
মৌমাছি চাষের ইতিহাস
মৌমাছি চাষের প্রাচীন ইতিহাস খ্রিষ্টপূর্ব ৬ হাজার অব্দে পাওয়া গেলেও পদ্ধতিগতভাবে এটি শুরু হয় ১৬ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আধুনিক মৌচাষের ভিত্তি স্থাপন করেন ল্যাংস্ট্রোথ, ১৮ শতকে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক মৌচাষ শুরু হয় ১৯৬১ সালে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে। এরপর ১৯৬৩ সালে বিসিক প্রথম মৌ চাষের উদ্যোগ নেয়। ভারতে মৌমাছি চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। আশির দশকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যুক্ত হয় এবং ২০০০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন শুরু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিসিক ১৭ হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মধু চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাড়ছে উৎপাদন-চাহিদা
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের আল আমিন আট বছর আগে মধু ব্যবসা শুরু করেন। তখন তাঁর এলাকায় ১০-১২ জন বিক্রেতা ছিলেন। আজ সেই সংখ্যা বেড়ে কয়েক হাজার হয়েছে। প্রথমে দৈনিক ২-৩ কেজি মধু বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ১৫-২০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ‘ভিটালিক্স’ও বাজারে পরিচিত।
আল আমিন জানান, করোনাকালে মধুর বাজার দ্রুত বেড়েছে। আগের পাঁচ বছরে যে চাহিদা ছিল, করোনার এক-দুই বছরে তা অনেক বেড়েছে। কারণ, মানুষ এখন শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (ইমিউনিটি) বাড়ানোর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে।
মধুর বাজারের আকার
দেশে মধু উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য এখনো অস্পষ্ট। সরকারি-বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণের তথ্যে ভিন্নতা রয়েছে। বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সাড়ে ১০ হাজার টনের বেশি মধু উৎপাদিত হয়, যা ২০১৮-১৯ সালে ছিল ২ হাজার টনের কম। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার টন মধু আমদানি করা হয়।
তবে গতকাল শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চম মৌমাছি ও মধু সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৪ সালে প্রাকৃতিক ও চাষ থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টন।
বাংলাদেশ বি কিপার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি মধুর গড় মূল্য ৭০০ টাকা ধরে ১০ হাজার ৬৫৫ টন মধুর বাজারমূল্য প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। প্রতিবছর আমদানি করা মধুর মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা এবং মৌচাক থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য উপকরণ বিক্রি হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকায়। সুতরাং উৎপাদিত, আমদানি, অন্যান্য মধুর পণ্যসহ দেশে মধুর বাজার ৮৫০ কোটি টাকার বেশি।
বর্তমানে বিসিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চাষির সংখ্যা ৬ হাজার। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রায় ২ হাজার চাষি মধু উৎপাদন করছেন। এসব চাষি সাধারণত ৮০-১০০টি বাক্স ব্যবহার করে মধু উৎপাদন করেন। শখের বশে কিছু বাক্স কিনে ব্যক্তিগতভাবে মধু উৎপাদনকারীও রয়েছেন। এর ফলে বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী মধুর বাজারের আকার আরও বড়। যার বার্ষিক বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
কোথায় বেশি উৎপাদন
মধুর ৯৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় চাষের মাধ্যমে, যার মধ্যে প্রাকৃতিক মধুর বড় উৎস সুন্দরবন। বন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ টন মধু আহরণ করা হয়। সরকারিভাবে মধু চাষ করে বিসিক, যার ছয়টি মধু সংগ্রহকেন্দ্র রয়েছে গাজীপুর, দিনাজপুর, বাগেরহাট, বরিশাল, সিলেট ও কুমিল্লায়। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, পাবনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশি মধু উৎপাদিত হয়; বিশেষত সরিষা, ধনিয়া, কালিজিরা ও লিচু ফুলের মৌসুমে।
মধুর ধরন, ব্র্যান্ড ও দাম
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরিষা, লিচু, কালিজিরা, সুন্দরবনের বাইং, বরই, ধনিয়া, শজনেসহ ৮-১০ ধরনের ফুলের মধু পাওয়া যায়। সবচেয়ে দামি হলো সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু, যা ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি বিক্রি হয়। এরপরেই সুন্দরবনে বাক্সে উৎপাদিত মধু ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ এবং বাইং ফুলের মধু ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি। সরিষা ফুলের মধুর দাম সবচেয়ে কম, ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। কালিজিরার মধু বিক্রি হয় ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি।
বিক্রেতারা বলেন, মধুর দাম কিছুটা বেশি হলেও এটি স্বাস্থ্যোপকারিতার জন্য অনেকের কাছে সাশ্রয়ী। এ ক্ষেত্রে ২০ গ্রাম মধু খাওয়ার খরচ মাত্র ১২ টাকা, যা অনেকের জন্য সাশ্রয়ী হতে পারে। বাজারে পাওয়া যায় দেশীয় ব্র্যান্ড যেমন স্বপ্ন মধু, ট্রপিকা, এপি মধু ছাড়াও আমদানি করা বিদেশি ব্র্যান্ড; যেমন ভারতের ডাবর, সাফোলা; পাকিস্তানের বি হাইভস; অস্ট্রেলিয়ার অজিবি; সৌদি আরবের আল শিফা; নিউজিল্যান্ডের মানুকা হানি। বিদেশি মধু সাধারণত ৫০০ থেকে ২৫০ গ্রাম কাচের জারে বিক্রি হয়, যার দাম কেজিতে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা।
ভেজালে বাড়ছে আস্থাহীনতা
মধুর বাজার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ভেজালের পরিমাণও বাড়ছে, যা ক্রেতাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভেজাল মধু খাঁটি মধু হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, ফলে ক্রেতারা সঠিক পণ্য নির্বাচন করতে পারছেন না। এই আস্থাহীনতা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় খাঁটি মধু কেনার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। তা ছাড়া ভেজাল মধু বিক্রির কারণে খাঁটি মধুর দামও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। ফলে বাজারে মধুর চাহিদা ও বিশ্বাসে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
মানসনদেও জটিলতা
গোপীবাগ এলাকার মাহবুবা আলম বলেন, বাজারের মধু খাঁটি কি না, তা নিশ্চিত করা কঠিন। যদি সরকারি সংস্থা নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে ক্রেতার সংখ্যা আরও বাড়ত। দেশে মধুর বিপণনে মান বজায় রাখার দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের। বিএসটিআই কর্তৃক মানসনদপ্রাপ্ত ১৮১টি পণ্যের মধ্যে মধু রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সনদ নিয়ে মধু বিক্রি হলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেকে সনদ নেন না। লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ করলে বাজারে আস্থাহীনতা অনেকটা কমে যেত।
বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, মধুর মানসনদ নিতে উদ্যোক্তাকে একটি প্রতিষ্ঠিত কারখানা, ট্রেড লাইসেন্স, ট্রেডমার্ক সার্টিফিকেট, স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট ও মোড়ক তৈরি করতে হয়। এসব কাগজপত্রসহ বিএসটিআইয়ে আবেদন করতে হয়, যেখানে উৎপাদিত পণ্যের নমুনা জমা দিতে হয়। বিএসটিআই নিজস্ব ল্যাবে ১৩টি পরীক্ষা এবং সরেজমিন তদন্তের মাধ্যমে মানসনদ দেয়। বিএসটিআইয়ের পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, ‘এখানে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস রয়েছে, তবে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই হবে, অন্যথায় সনদ দেওয়া সম্ভব নয়।’
সমস্যা ও সম্ভাবনা
কিছু বাধার কারণে দেশে মধু উৎপাদন এখনো পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারেনি। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, মৌমাছির জাত উন্নয়ন ও গবেষণার অভাব প্রধান সমস্যা। গাভির জাত উন্নয়ন করে দুধের উৎপাদন যেমন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, তেমনি মৌমাছির জাত উন্নয়ন হলে মধুর উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। মৌচাষিরা এক মৌসুমে ৩৫-৪০ কেজি মধু উৎপাদন করতে পারেন, যেখানে চীন ও ভারতের চাষিরা ১০০ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন করতে সক্ষম।
বাংলাদেশ বি কিপার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবও বড় বাধা। বিসিক প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিলেও তা যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া মধু বিক্রি ও মানসম্পর্কিত আইন না থাকায় বাজারে আস্থা কম। এ ছাড়া দেশে মধু খাতের জন্য কোনো আলাদা বোর্ড বা দপ্তর না থাকায় কার্যকর নীতিমালা তৈরি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সাবেক কর্মকর্তা ও মৌ চাষ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক খোন্দকার আমিনুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যথাযথ উদ্যোগ নিলে দেশের মধু খাত রপ্তানি উপযোগী হয়ে ২ লাখ টন পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব। এতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ অন্য দেশগুলোতে রপ্তানি করা যাবে।’
খোন্দকার আমিনুজ্জামান আরও জানান, ‘দৈনিক ১০ গ্রাম মধু খেলে দেশের বার্ষিক চাহিদা ৪০ হাজার টন হতে পারে, কিন্তু সচেতনতার অভাবে মানুষ মধু খায় না। মৌমাছি চাষে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এটি শুধু মধুর উৎপাদন বাড়াবে না, কৃষি ফসলের উৎপাদনও ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে।’
প্রকৃতির এক আশ্চর্য উপহার মধু। মিষ্টি স্বাদ আর গুণাগুণের জন্য মানুষের মনে এর জায়গা চিরকালীন। এক ফোঁটা মধু জিহ্বায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মন থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত গভীর আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
মধু শুধু স্বাদের জন্য নয়, উপকারিতার জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছে। এটি ‘সব রোগের মহৌষধ’ হিসেবে পরিচিত। পুষ্টিবিদেরা বলেন, মধুতে গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, খনিজ লবণ, অ্যামাইনো অ্যাসিডসহ প্রায় ৪৫টি পুষ্টি উপাদান থাকে। ১০০ গ্রাম মধুতে ২৮৮ ক্যালরি শক্তি থাকে, যা শরীর চাঙা রাখতে সাহায্য করে।
একসময় বন-জঙ্গল থেকে মৌয়ালেরা মধু সংগ্রহ করতেন, যা দাদি-নানিরা বোতলে জমাতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মধু উৎপাদন থেকে বাজারে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে এবং শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে মধু নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে গবেষক, চাষি, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মাঝে সেতুবন্ধ গড়ে উঠেছে। এর সদস্যসংখ্যা ২৬ হাজারের বেশি। প্রতিবছর জাতীয় মৌমাছি ও মধু সম্মেলন, প্রদর্শনী, সেমিনার, মধুমেলা এবং সুন্দরবনে হানি ট্যুরিজমের কার্যক্রমও চলছে।
বর্তমানে দেশে মধুর বার্ষিক বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে প্রাকৃতিক ও চাষ থেকে ২০-২৫ হাজার টন মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০-৯৫% চাষের। তবে দেশে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংগ্রহের আধুনিক ব্যবস্থা কম, তাই প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার টন মধু আমদানি করা হচ্ছে।
গবেষক ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, মধু শুধু পুষ্টি ও স্বাদের বিষয় নয়, এটি একটি বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। একটু পরিকল্পনা ও যত্ন নিলে এই শিল্পকে দেশের অর্থনীতির এক শক্তিশালী খাতে রূপান্তর করা সম্ভব। যদি এই খাতে উন্নতি ঘটে, দেশের বার্ষিক মধু উৎপাদন ২ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে, যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকায়।
মৌমাছি চাষের ইতিহাস
মৌমাছি চাষের প্রাচীন ইতিহাস খ্রিষ্টপূর্ব ৬ হাজার অব্দে পাওয়া গেলেও পদ্ধতিগতভাবে এটি শুরু হয় ১৬ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আধুনিক মৌচাষের ভিত্তি স্থাপন করেন ল্যাংস্ট্রোথ, ১৮ শতকে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক মৌচাষ শুরু হয় ১৯৬১ সালে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে। এরপর ১৯৬৩ সালে বিসিক প্রথম মৌ চাষের উদ্যোগ নেয়। ভারতে মৌমাছি চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। আশির দশকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যুক্ত হয় এবং ২০০০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন শুরু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিসিক ১৭ হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মধু চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাড়ছে উৎপাদন-চাহিদা
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের আল আমিন আট বছর আগে মধু ব্যবসা শুরু করেন। তখন তাঁর এলাকায় ১০-১২ জন বিক্রেতা ছিলেন। আজ সেই সংখ্যা বেড়ে কয়েক হাজার হয়েছে। প্রথমে দৈনিক ২-৩ কেজি মধু বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ১৫-২০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ‘ভিটালিক্স’ও বাজারে পরিচিত।
আল আমিন জানান, করোনাকালে মধুর বাজার দ্রুত বেড়েছে। আগের পাঁচ বছরে যে চাহিদা ছিল, করোনার এক-দুই বছরে তা অনেক বেড়েছে। কারণ, মানুষ এখন শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (ইমিউনিটি) বাড়ানোর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে।
মধুর বাজারের আকার
দেশে মধু উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য এখনো অস্পষ্ট। সরকারি-বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণের তথ্যে ভিন্নতা রয়েছে। বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সাড়ে ১০ হাজার টনের বেশি মধু উৎপাদিত হয়, যা ২০১৮-১৯ সালে ছিল ২ হাজার টনের কম। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার টন মধু আমদানি করা হয়।
তবে গতকাল শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চম মৌমাছি ও মধু সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৪ সালে প্রাকৃতিক ও চাষ থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টন।
বাংলাদেশ বি কিপার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি মধুর গড় মূল্য ৭০০ টাকা ধরে ১০ হাজার ৬৫৫ টন মধুর বাজারমূল্য প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। প্রতিবছর আমদানি করা মধুর মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা এবং মৌচাক থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য উপকরণ বিক্রি হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকায়। সুতরাং উৎপাদিত, আমদানি, অন্যান্য মধুর পণ্যসহ দেশে মধুর বাজার ৮৫০ কোটি টাকার বেশি।
বর্তমানে বিসিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চাষির সংখ্যা ৬ হাজার। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রায় ২ হাজার চাষি মধু উৎপাদন করছেন। এসব চাষি সাধারণত ৮০-১০০টি বাক্স ব্যবহার করে মধু উৎপাদন করেন। শখের বশে কিছু বাক্স কিনে ব্যক্তিগতভাবে মধু উৎপাদনকারীও রয়েছেন। এর ফলে বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী মধুর বাজারের আকার আরও বড়। যার বার্ষিক বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
কোথায় বেশি উৎপাদন
মধুর ৯৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় চাষের মাধ্যমে, যার মধ্যে প্রাকৃতিক মধুর বড় উৎস সুন্দরবন। বন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ টন মধু আহরণ করা হয়। সরকারিভাবে মধু চাষ করে বিসিক, যার ছয়টি মধু সংগ্রহকেন্দ্র রয়েছে গাজীপুর, দিনাজপুর, বাগেরহাট, বরিশাল, সিলেট ও কুমিল্লায়। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, পাবনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশি মধু উৎপাদিত হয়; বিশেষত সরিষা, ধনিয়া, কালিজিরা ও লিচু ফুলের মৌসুমে।
মধুর ধরন, ব্র্যান্ড ও দাম
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরিষা, লিচু, কালিজিরা, সুন্দরবনের বাইং, বরই, ধনিয়া, শজনেসহ ৮-১০ ধরনের ফুলের মধু পাওয়া যায়। সবচেয়ে দামি হলো সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু, যা ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি বিক্রি হয়। এরপরেই সুন্দরবনে বাক্সে উৎপাদিত মধু ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ এবং বাইং ফুলের মধু ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি। সরিষা ফুলের মধুর দাম সবচেয়ে কম, ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। কালিজিরার মধু বিক্রি হয় ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি।
বিক্রেতারা বলেন, মধুর দাম কিছুটা বেশি হলেও এটি স্বাস্থ্যোপকারিতার জন্য অনেকের কাছে সাশ্রয়ী। এ ক্ষেত্রে ২০ গ্রাম মধু খাওয়ার খরচ মাত্র ১২ টাকা, যা অনেকের জন্য সাশ্রয়ী হতে পারে। বাজারে পাওয়া যায় দেশীয় ব্র্যান্ড যেমন স্বপ্ন মধু, ট্রপিকা, এপি মধু ছাড়াও আমদানি করা বিদেশি ব্র্যান্ড; যেমন ভারতের ডাবর, সাফোলা; পাকিস্তানের বি হাইভস; অস্ট্রেলিয়ার অজিবি; সৌদি আরবের আল শিফা; নিউজিল্যান্ডের মানুকা হানি। বিদেশি মধু সাধারণত ৫০০ থেকে ২৫০ গ্রাম কাচের জারে বিক্রি হয়, যার দাম কেজিতে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা।
ভেজালে বাড়ছে আস্থাহীনতা
মধুর বাজার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ভেজালের পরিমাণও বাড়ছে, যা ক্রেতাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভেজাল মধু খাঁটি মধু হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, ফলে ক্রেতারা সঠিক পণ্য নির্বাচন করতে পারছেন না। এই আস্থাহীনতা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় খাঁটি মধু কেনার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। তা ছাড়া ভেজাল মধু বিক্রির কারণে খাঁটি মধুর দামও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। ফলে বাজারে মধুর চাহিদা ও বিশ্বাসে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
মানসনদেও জটিলতা
গোপীবাগ এলাকার মাহবুবা আলম বলেন, বাজারের মধু খাঁটি কি না, তা নিশ্চিত করা কঠিন। যদি সরকারি সংস্থা নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে ক্রেতার সংখ্যা আরও বাড়ত। দেশে মধুর বিপণনে মান বজায় রাখার দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের। বিএসটিআই কর্তৃক মানসনদপ্রাপ্ত ১৮১টি পণ্যের মধ্যে মধু রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সনদ নিয়ে মধু বিক্রি হলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেকে সনদ নেন না। লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ করলে বাজারে আস্থাহীনতা অনেকটা কমে যেত।
বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, মধুর মানসনদ নিতে উদ্যোক্তাকে একটি প্রতিষ্ঠিত কারখানা, ট্রেড লাইসেন্স, ট্রেডমার্ক সার্টিফিকেট, স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট ও মোড়ক তৈরি করতে হয়। এসব কাগজপত্রসহ বিএসটিআইয়ে আবেদন করতে হয়, যেখানে উৎপাদিত পণ্যের নমুনা জমা দিতে হয়। বিএসটিআই নিজস্ব ল্যাবে ১৩টি পরীক্ষা এবং সরেজমিন তদন্তের মাধ্যমে মানসনদ দেয়। বিএসটিআইয়ের পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, ‘এখানে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস রয়েছে, তবে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই হবে, অন্যথায় সনদ দেওয়া সম্ভব নয়।’
সমস্যা ও সম্ভাবনা
কিছু বাধার কারণে দেশে মধু উৎপাদন এখনো পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারেনি। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, মৌমাছির জাত উন্নয়ন ও গবেষণার অভাব প্রধান সমস্যা। গাভির জাত উন্নয়ন করে দুধের উৎপাদন যেমন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, তেমনি মৌমাছির জাত উন্নয়ন হলে মধুর উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। মৌচাষিরা এক মৌসুমে ৩৫-৪০ কেজি মধু উৎপাদন করতে পারেন, যেখানে চীন ও ভারতের চাষিরা ১০০ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন করতে সক্ষম।
বাংলাদেশ বি কিপার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবও বড় বাধা। বিসিক প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিলেও তা যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া মধু বিক্রি ও মানসম্পর্কিত আইন না থাকায় বাজারে আস্থা কম। এ ছাড়া দেশে মধু খাতের জন্য কোনো আলাদা বোর্ড বা দপ্তর না থাকায় কার্যকর নীতিমালা তৈরি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সাবেক কর্মকর্তা ও মৌ চাষ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক খোন্দকার আমিনুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যথাযথ উদ্যোগ নিলে দেশের মধু খাত রপ্তানি উপযোগী হয়ে ২ লাখ টন পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব। এতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ অন্য দেশগুলোতে রপ্তানি করা যাবে।’
খোন্দকার আমিনুজ্জামান আরও জানান, ‘দৈনিক ১০ গ্রাম মধু খেলে দেশের বার্ষিক চাহিদা ৪০ হাজার টন হতে পারে, কিন্তু সচেতনতার অভাবে মানুষ মধু খায় না। মৌমাছি চাষে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এটি শুধু মধুর উৎপাদন বাড়াবে না, কৃষি ফসলের উৎপাদনও ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে।’
সাধারণ বীমা করপোরেশন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লভ্যাংশ বাবদ ৫০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে। আজ রোববার (২২ ডিসেম্বর) করপোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে লভ্যাংশের চেক হস্তান্তর করেন।
১ ঘণ্টা আগেচলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে ২০০ কোটি মার্কিন (২ বিলিয়ন) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার বা ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের এ ধারা...
১ ঘণ্টা আগেশীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ইস্পাহানি মির্জাপুরের উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মেধাভিত্তিক টিভি রিয়্যালিটি শো ‘ইস্পাহানি মির্জাপুর বাংলাবিদ’ ষষ্ঠ বর্ষের ময়মনসিংহ বিভাগের বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিগত কয়েক দিনে আরও ২০০ কোটি ডলার কমেছে। যার ফলে দেশটির রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ৬৫২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারে। যা বিগত প্রায় ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) থেকে গত শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে
৬ ঘণ্টা আগে