৪০০ টাকা পুঁজির চারাগাছ এখন মাসে ৪০ হাজার টাকা আয়ের উৎস

মন্টি বৈষ্ণব
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২১, ১০: ০০
আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৮: ৫৭

পরিবারের বড় সন্তান জান্নাতুন নূর সাইমুম। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল। ভালোবাসতেন ছবি আঁকতেও। ছোটবেলা থেকেই যা দেখতেন, তাই আঁকার চেষ্টা করতেন। ছোটবেলার সেই লুকিয়ে থাকা আগ্রহকে বর্তমানে তিনি প্রকাশ করেছেন অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে। হাতে তৈরি অলংকার নিয়ে শুরু করেছেন অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘চারাগাছ’। মাত্র ৪০০ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু হয় তাঁর এই যাত্রা। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এই চারগাছ থেকেই তিনি এখন মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করছেন। 

চট্টগ্রাম শহরেই সাইমুমের বেড়ে ওঠা। স্কুল ছিল আগ্রাবাদ বালিকা বিদ্যালয়। কলেজ—চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনে অধ্যয়নরত। পরিবারে আছেন মা, ছোট ভাই এবং নানা-নানি। 

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাইমুমের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চারাগাছের জন্ম এক কঠিন বাস্তবতায়। গল্পের শুরু ২০১৯ সালে। শুরুর সেই সময় সম্পর্কে সাইমুম বলেন—‘আমি সব সময় এমন কিছু করতে চাইতাম, যেখানে আমার চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে। ছবি আঁকার পাশাপাশি টুকটাক হাতে বানানো জিনিসের কাজ করতাম। আঁকা-আঁকি করতে ভালোবাসি। নিজের বানানো নানা জিনিসেও সেই ছোঁয়া রাখার চেষ্টা করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। কিন্তু কিছু ঠিক করতে পারছিলাম না। প্রথম বর্ষ গেছে টিউশনি ও স্কুলে আর্ট ক্লাস করিয়েই।’ 

বন্ধুর কাছ থেকে ধার নেওয়া মাত্র ৪০০ টাকা পুঁজিতে চারগাছ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন জান্নাতুন নূর সাইমুমসাইমুমের এই ‘কী করব’ ধরনের দ্বিধা কেটে যায় পারিবারিক এক সংকটমুহূর্তে। সংকটই আসলে অনেক সময় মানুষকে পথ দেখায়। সাইমুমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সাইমুমের পরিবার মূলত তাঁর মায়ের সেলাই থেকে আসা আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাইমুম বলেন, ‘মা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের পরামর্শে সেলাই ছাড়তে হয় তাঁকে। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর আমার পক্ষে আর কোনোভাবেই টিউশন দিয়ে সব চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক তখনই, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মনে হয় নিজের কিছু করা উচিত। মাত্র কয়েক মুহূর্তের সিদ্ধান্তেই হুট করে বন্ধু থেকে কিছু টাকা নিয়ে আমি গয়না বানানোর কাঁচামাল কিনতে চলে যাই। শুরু করি চারাগাছ-এর কাজ।’ 

সাইমুমের এই চারাগাছের অনেকটা জুড়েই আছেন তাঁর মা। মায়ের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই যে চারাগাছ আজ এত দূর এসেছে, এটা কখনোই আমার একার পক্ষে সম্ভব হতো না, যদি না আমার পাশে মা না থাকতেন। এই যে মালার কাজ করি বা আঁকি, সেটার সুতোটা মা লাগিয়ে দেন, পুঁতিটা খুঁজে দেন মা, হাতের কাজের যা কিছু, সবটা সেলাই মা করে দেন। কোন জিনিসের সঙ্গে কোনটি মানাবে, সেই বিষয়েও পরামর্শ দেন আমার মা।’ 

শুরুতেই বলা হয়েছে ‘চারাগাছ’-এর জন্ম হয়েছিল মাত্র ৪০০ টাকা পুঁজি থেকে। সাইমুমের জবানিতে এই ৪০০ টাকাও এসেছিল বন্ধুর কাছ থেকে ধার মারফত। যেহেতু তিনি হঠাৎ করে কাজ শুরু করেন, তাই শুরু থেকেই মায়ের পাশাপাশি বন্ধুরা তাঁকে সব সময় নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে পড়ালেখার পাশাপাশি অন্য কোনো কাজে যুক্ত থাকলে সমস্যায় পড়তে হয়। একদিকে লেখাপড়া, অন্যদিকে ব্যবসার কাজ। 

সাইমুমও এমন সমস্যায় পড়েছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘শিক্ষার্থী হওয়ায় ব্যবসার পুঁজি নিয়ে সমস্যায় পড়তাম। কাজ শুরুর পর উপকরণ সংগ্রহে সমস্যায় পড়তাম। কখনো এটা খুঁজে পাওয়া যেত, তো ওটা পাওয়া যেত না। আবার ডেলিভারি নিয়েও নানা রকম সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। অনেক সময় কেউ কেউ অর্ডার করেও নিত না। তাই একটা কাজের পেছনে যতটুকু সময় ব্যয় হয়, সেই অনুযায়ী মূল্যায়ন পেতাম না। স্বল্প পুঁজিতে বারবার জিনিসপত্র কিনতে হয়। এ রকম অসুবিধায় প্রতিনিয়তই পড়তে হতো। কাজ শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পেজগুলো দেখতাম—কে কীভাবে কাজ করছেন, কীভাবে অনলাইনে তাঁদের পণ্যগুলো তুলছেন। এর পর আস্তে আস্তে দু-তিন মাস পর আমি ‘চারাগাছ’ নামে ফেসবুক পেজটা খুলি।’ 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চারাগাছে পেজ সাইমুমের ব্যবসায় গতি আনে। বললেন, ‘এটা নতুন শুরু এনে দিল। এখন আমি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করি। সময়ে-অসময়ে এই আয়ের পরিমাণে তারতম্য আসে।’ 

নানা উপকরণে নিজেই রিকশাচিত্র, লোকশিল্পের নানা মোটিফসহ নানা চিত্র এঁকে বা সেলাই করে তা আকর্ষণীয় করে তোলেন সাইমুমসাইমুম গয়না নিয়ে কাজ করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশীয় ধাঁচের; যেমন—রিকশাচিত্র, লোকশিল্পের নানা রকম মোটিফ, কাঁথাশিল্প, সুঁই-সুতার কাজ করা গয়না ইত্যাদি তৈরি করেন। আবার মাঝেমধ্যে শাড়ি ও টিশার্টে হ্যান্ড পেইন্টও করেন। 

দীর্ঘ দেড় বছর করোনা মহামারির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ। এই সময়ে চারাগাছ-এর কাজ কীভাবে পরিচালনা করেছেন জানতে চাইলে সাইমুম বলেন, ‘করোনার সময় প্রায় দুই মাস চারাগাছ-এর কাজ বন্ধ রেখেছিলাম। করোনার আগে চট্টগ্রামে কোথাও হোম ডেলিভারি দিতাম না। নির্দিষ্ট পিক-আপ পয়েন্ট থেকেই ডেলিভারি নিত সকলে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে কাজ শুরুর পর পরিচিত একজন কলেজপড়ুয়াকে ঠিক করি। তিনি চট্টগ্রামের সবাইকে হোম ডেলিভারি দিতেন। আর চট্টগ্রামের বাইরে সুন্দরবন কুরিয়ারও সারা বাংলাদেশে হোম ডেলিভারি দিত। এই কাজের ফলে সেই কলেজ শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা অনেকটা লাঘব হয়েছিল।’ 

কোথায় যেতে চান সাইমুম? এক কথায় অনেক দূর। তবে আগে পড়ালেখা শেষ করতে চান। তারপর এই চারাগাছকে এমন এক মহিরুহে পরিণত করতে চান, যা আশ্রয় দিতে পারবে বহু মানুষকে। তিনি চান—চারাগাছের ছায়াতেই হবে বহু মানুষের কর্মসংস্থান। 

উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসকেই সবচেয়ে বড় পুঁজি বলে মনে করেন সাইমুম। নিজের উদাহরণ টেনেই বললেন, ৪০০ টাকা নয় আসলে আত্মবিশ্বাসই তাঁর পুঁজি ছিল। এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে শুরুতেই থমকে যেতে হয়। এ দেশের নারীদের মধ্যে এই একটি বিষয় যদি ঠিকঠাক সঞ্চার করা যায়, তবে অনেক উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি। আত্মনির্ভরশীল হতে এর কোনো বিকল্প নেই। সাইমুম বলেন, ‘নিজে কিছু গড়ে তোলা আর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার যে জায়গা, সেখান থেকেই আমার এই পথে আসা। যারা নতুন করে উদ্যোক্তা হতে চান, তাঁদের বলব—সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কাজে নতুনত্ব আনুন। একজনের দেখাদেখি বাজার বা পণ্যের কথা বিবেচনা না করে, নিজের মতো কিছু করার চেষ্টা করুন। আপনার মধ্যে কাজের একাগ্রতা থাকলে আপনি অবশ্যই সফল হবেন।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত