১০১টা খুন করতে চেয়েছিলেন তিনি

বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০৯: ০০
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১৩

লুইস গারাভিটোর নাম অনেকেই শুনে থাকবেন। কারণ, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার, বাংলায় যাকে বলি ক্রমিক খুনি। কলম্বিয়ার এই নাগরিক ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিন শতাধিক খুন করেন, যাদের প্রায় সবাই ছিল শিশু। গ্রেপ্তারের পর লুইস ১৮৯টি খুনের কথা নিজেই স্বীকার করেন। ৮৩৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এই খুনি এখন কলম্বিয়ার ভ্যালেদুপার কারাগারে বন্দী।

লুইসের বৈশিষ্ট্য হলো, খুনের আগে তিনি শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করতেন। তাঁর টার্গেট করা শিশুদের প্রায় সবাই ছিল পথশিশু। এসব খুনের কোনো ক্লু সহজে পাওয়া যেত না। কিন্তু একটি খুনের বেলায় অকুস্থলে তাঁর বান্ধবীর লেখা একটি চিরকুট পকেট থেকে পড়ে যায়। সেটাই কাল হয় লুইসের। সেই সূত্র ধরে পুলিশ তাঁকে পাকড়াও করে।

লুইসের সঙ্গে বাংলাদেশের চাঁদপুরের সিরিয়াল কিলার রসু খাঁর কস্মিনকালেও দেখা হয়নি, হওয়ার কোনো কারণও নেই। অথচ অদ্ভুত মিল আছে দুই খুনির। রসু খাঁ খুন করতেন শুধু নারীদের। সেই নারীরা সবাই ছিলেন দরিদ্র পরিবারের। যাঁদের খুন করেছেন, তাঁদের একজন ছাড়া সবাইকে তিনি খুনের আগে ধর্ষণ করেছেন। আবার সব খুন করেছেন রাতে। শুধু তাই নয়, কোনো না কোনো খালের কিনারে নিয়েই তিনি এঁদের খুন করেছেন। এসব খুনের কোনো ক্লু ছিল না। তার পরও লুইসের মতো রসু খাঁকে পুলিশ শনাক্ত করে একটি মোবাইল সিমের সূত্র ধরে।

গ্রেপ্তারের পর রসু খাঁ নিজেই ১১ খুনের কথা স্বীকার করেন। পুলিশের ধারণা, তাঁর খুনের সংখ্যা আরও বেশি। রসু খাঁর বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। এর মধ্যে তিনটি মামলার রায়ে তাঁর ফাঁসি হয়েছে, একটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন।

ক্রাইম রিপোর্টার হওয়ার সুবাদে জীবনে অনেক পেশাদার ও অপেশাদার খুনির সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু রসু খাঁ আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছেন। সব খুনের ঘটনা তিনি স্বীকার করেছেন অকপটে, কোনো রাখঢাক নেই। কীভাবে খুন করেছিলেন, তা-ও বলেছেন প্রতিটির খুঁটিনাটি, ধরে ধরে। শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, লোকটা আমাকে বোকা বানাচ্ছে না তো! কিন্তু বর্ণনায় কোথাও কোনো খামতি নেই, অবিশ্বাস করব কী করে?

রসু খাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর চাঁদপুর কারাগারে। এই দেখা হওয়ার চার দিন আগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম সিরিয়াল কিলার গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছিলেন চাঁদপুরের সাংবাদিক আলম পলাশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের বর্তমান অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় তখন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার। তাঁকে ফোন করতেই রসু খাঁর কথা বললেন। পরদিন আশীষ উর রহমান শুভকে নিয়ে গেলাম চাঁদপুরে।

চাঁদপুর জেলখানাটা শহরের ভেতরে, খুবই সাদামাটা। জেলারের কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই কাজ হলো। তিনি রসু খাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দিলেন। আমরা গেলাম জেলের ভেতরে। রসু খাঁ তখন নিজের সেলে শুয়ে শুয়ে গান গাইছিলেন।

নাম ধরে ডাকতেই উঠে বসলেন। নির্মেদ শরীর, একহারা গড়ন। সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো উচ্চতা। মাথায় খুলি কামড়ে আছে ছোট করে ছাঁটা চুল। ডিম্বাকৃতির মুখমণ্ডল; কিন্তু চোখের দিকে তাকাতেই বুক কেঁপে ওঠে। ভাবলেশহীন স্থিরদৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকলেন। শুরু হলো কথোপকথন।

রসু খাঁর আসল নাম রশিদ খাঁ। বাবা আবুল হোসেন ওরফে মনু খাঁ ছিলেন একজন খেতমজুর। বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের মদনা গ্রামে। অভাবের সংসার। আয় বলতে নির্দিষ্ট কিছু ছিল না। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে কিছুদিন যাওয়া-আসার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সাত বছর বয়সে পাশের বাড়ির একজনের মুরগি দিয়ে চুরিজীবনের শুরু। চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েন কয়েকবার। এলাকায় তাঁর চোর পরিচয় পোক্ত হতে থাকে। এরপর ঢাকায় আসেন। তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। চুরির দায়ে চাকরিও চলে যায়। দিনের বেলায় তিনি ঢাকায় থাকতেন। সন্ধ্যা হলে চলে যেতেন চাঁদপুরে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি চুরি করে ভোর হওয়ার আগে ঢাকায় রওনা হতেন।

খুনের নেশা মাথায় এল কী করে? বললেন, বিয়ের আগে এক মেয়েকে ভালোবাসতেন। একদিন সেই মেয়ের ভাইয়েরা ধরে তাঁর হাত ভেঙে দেয়। সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে ১০১টি খুন করবেন, তারপর সন্ন্যাস নিয়ে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াবেন।

তাহলে এত দিন কী করলেন? রসু খাঁ বলেন, তারপর বিয়ে করলাম, ছেলেমেয়ে হলো। চিন্তা করলাম, ছেলেমেয়েরা আগে বড় হোক, তারপর এই পথে নামব। বাচ্চারা বড় হওয়ার জন্য খুনের প্রতিজ্ঞা পূরণে ১২ বছর অপেক্ষা করতে হলো।

রসু খাঁর এসব কথা শুনতে বড় অদ্ভুত লাগে। রসু খাঁ বলে যান। খুনে প্রথম হাত পাকালেন নিজের শ্যালক মান্নানের স্ত্রী শাহিদাকে খুন করে। এই খুনে অবশ্য মান্নান তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ২০০৭ সালে টঙ্গীর মুদি দোকানি মানিকের প্রেমিকাকে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে এনে চুবিয়ে মেরে ফেলেন। এক নারী পোশাকশ্রমিক তাঁর ছেলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। একদিন তাঁকেও খুন করেন। এক নারীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাঁকেও চাঁদপুরে ডেকে এনে খুন করেন। এভাবে একটার পর একটা খুনের গল্প বলে যান অবলীলায়। বলতে বলতে ভুলে যান। আবার বলেন একই গল্প। যখন এসব গল্প বলেন, তাঁর দৃষ্টি থাকে শূন্যের দিকে, কারও দিকেই তাকান না।

রসুর কাছে জানতে চাইলাম, খুনের আগে ধর্ষণ বা নির্যাতন করেন কেন? তাঁর একটাই জবাব: মাথা ঠিক থাকে না, কী করব, স্যার? এর পরের টার্গেট কে ছিল—জানতে চাইলে রসু বললেন, ‘সেটা ঠিক করার আগেই তো পুলিশ আমাকে জেলে ভরল।’

কাউকে খুনের সময় সহানুভূতি জাগেনি—এমন প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না, ভেবে নিয়েও করে ফেললাম। রসুর জবাব, আগে লাগেনি, এখন খুব খারাপ লাগে।

পরদিন আদালতে তোলা হলো রসু খাঁকে। আদালতের বারান্দায় রসুর স্ত্রী রিনা আর তিন সন্তান—পরি, রুবেল ও সাব্বির। কেউ কোনো কথা বলে না। শুধু ১৪ বছরের সাব্বির বলল, ‘বাবা তো এ রকম নন।’

রিনা স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, ‘কেমনে তুমি এত কিছু করলা? আমরা এক দিনের জন্যও টের পাইলাম না?’ স্ত্রীর কথা শুনে রসু খাঁ খানিকটা উদ্‌ভ্রান্ত। মাথার চুল দুই হাতে খামচে ধরে বলেন, ‘আমার আশা ছাইড়া দাও, আমার ফাঁসি হইব। তুমি কিন্তু আর বিয়া বইসো না, পোলাপানগুলারে মানুষ কইরো।’

রিনা বেগমের বিস্ময় বাকি সবার কৌতূহল, ঔৎসুক্য আর জিজ্ঞাসাকে ছাপিয়ে যায়। নীরবে চোখের পানি মোছেন রিনা, কিছুই বলতে পারেন না। তাঁকে জড়িয়ে থাকে তিন সন্তান। আদালতের বারান্দায় আমিও দাঁড়িয়ে থাকি নীরব হয়ে, কী আর বলব?

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত