জটিল সমস্যার সরল সমাধান

কামরুল হাসান
আপডেট : ১৩ মে ২০২৩, ১১: ৪২
Thumbnail image

দিনগুলো বড় অদ্ভুত। কোনো কোনো দিন আসে সকালের নরম রোদের মতো প্রশান্তি নিয়ে, আবার কোনো দিন আসে ঝড়ঝঞ্ঝা নিয়ে। ২০০২ সালের ১ অক্টোবরও ছিল সে রকম শান্তি উবে যাওয়ার দিন। সেই অশান্তি শুরুও হলো বেলা বাড়ার আগে। অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই খবর এল, মোহাম্মদপুরে ওয়ার্ড কমিশনারসহ জোড়া খুন হয়েছে। এই খুনের দুই দিন আগে আরও একজন কমিশনার খুন হন। সেই জ্বালায় মরছিলাম, আবার নতুন খুন। একেকটা আলোচিত খুন মানেই সাত দিনের সুখ হারাম।

যা হোক, রাজ্যের বিরক্তি মাথায় নিয়ে গেলাম অকুস্থলে, মোহাম্মদপুর টাউন হলে। আসাদগেট থেকে যে সড়কটি টাউন হল হয়ে পশ্চিমে বছিলার দিকে চলে গেছে, তার নাম আসাদ অ্যাভিনিউ। মোহাম্মদপুরের ভেতর থেকে আসা রাজা-রানিদের নামে রাখা অলিগলিগুলো এই সড়কের সঙ্গে মিশে গেছে। তার একটি শেরশাহ সুরি রোড। এই দুই সড়ক যেখানে সংযুক্ত, তার কাছেই অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কার্যালয় ছিল। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন এই ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার এ কে এম আহমেদ রাজু এবং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা সানাউল্লাহ।

আমি পৌঁছে শুনি, সানাউল্লাহ মারা গেছেন, কিন্তু রাজু তখনো বেঁচে আছেন। তাঁকে বাংলাদেশ মেডিকেল থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।মোহাম্মদপুর তখন উত্তপ্ত, রাজুর সমর্থকেরা রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের উপস্থিতিও বাড়ানো হয়েছে।

রাজুর সঙ্গে আমার দুবার দেখা হয়েছিল। শেষবার সাক্ষাতের সময় বন্ধু সাংবাদিক লিটন হায়দারও সঙ্গে ছিলেন। রাজু যেখানেই যেতেন, সঙ্গে তিনজন পুলিশ সদস্যও থাকতেন। প্রতি পালায় ৩ জন করে মোট ৯ জন পুলিশ সদস্য দিনে-রাতে তাঁকে পাহারা দিয়ে রাখতেন। রাজুর এই পাহারা শুরু হয়েছিল মিরপুরের ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন খুন হওয়ার পর। এ ঘটনার কয়েক মাস (২০০২ সালের ১০ মে) আগে বিএনপির এমপি নাসিরউদ্দীন পিন্টুর ভগ্নিপতি নিউটন খুন হন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, সব ওয়ার্ড কমিশনার তাঁদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ রাখতে পারবেন। শুরু হয় পুলিশি পাহারা নিয়ে সন্ত্রাসী ওয়ার্ড কমিশনারদের অবাধ চলাফেরা।

কমিশনারদের সন্ত্রাসী বলছি এ কারণে যে নিহত রাজুও ছিলেন ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ প্রবাদটির উল্টো দিকের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা ছিল। ’৯৯ সালে তিনি অবৈধ অস্ত্রসহ ধরা পড়ে অনেক দিন জেলে ছিলেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ঢাকায় ১৮ জন প্রার্থীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, রাজু ছিলেন তাঁদের সামনের সারিতে।

আমরা দেখেছি, রাজু যখন কমিশনার অফিসে বসে থাকতেন, তখনো পুলিশ তাঁর পাশে থাকত। সেই রাজু কীভাবে খুন হলেন? উপস্থিত লোকেরা বললেন, অফিস থেকে তিনি যখন বের হচ্ছিলেন, তখনই এক যুবক খুব কাছে এসে পরপর চারটি গুলি ছোড়েন। দুটি গুলি তাঁর বুকে লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে দৌড়ে তিনি পাশে মসজিদের ভেতরে ঢুকে পড়েন। সেই সন্ত্রাসীর গুলি সানাউল্লাহর গায়েও লাগে। এ ঘটনার সময় রাজুর প্রতিপক্ষ ওয়ার্ড কমিশনার সাঈদ ব্যাপারীও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

মোহাম্মদপুরের অনেক বাসিন্দা আমাকে বলেছিলেন, রাজুর ওপর হামলার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তাঁর সঙ্গে অনেকের বিরোধ। সেই বিরোধ আরও বাড়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর। এলাকার আরেক ওয়ার্ড কমিশনার মতিন তাঁকে সামাল দিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন বলেও শোনা যাচ্ছিল। তবে কমিশনার সাঈদ ব্যাপারীর ছেলের সঙ্গে জমি দখল নিয়ে রাজুর বিরোধ ছিল।

মনে আছে, সে সময় পুলিশ আমাকে বলেছিল, তাদের সন্দেহ, রাজুকে খুন করেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ছাত্রদলের নেতা পিচ্চি হেলাল। এর কারণও ছিল, মোহাম্মদপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কিন্তু ভোটে পাস করার পর রাজু সেই নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেন। এতেই শেষ হয়নি। হেলালকে জেলে পাঠান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হেলাল তাঁর কিলার এনা ও তপুকে দিয়ে রাজুকে খুন করান। রাজু যখন খুন হন, হেলাল তখন হাসপাতালের কারাকক্ষে ছিলেন। আরেকটা কথা বলি, রাজুর লাশ দেখতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে গিয়েছিলেন।

রাজু খুনের পর ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনারদের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সব ওয়ার্ড কমিশনার পুলিশি পাহারায় চলাফেরা করতে শুরু করেন। এর আরেকটি কারণ ছিল, রাজু খুনের মাত্র ৪৪ ঘণ্টা আগে উত্তরা সড়কে খুন হয়েছিলেন পোস্তগোলার ওয়ার্ড কমিশনার শাহাদত শিকদার। তাঁকে খুন করেছিলেন বলে সংবাদপত্র অফিসে ফোন করে দাবি করেছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর।

কমিশনারদের সেই আতঙ্ক কমাতে ৪ অক্টোবর নগর ভবনে বৈঠক ডাকেন তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। সেই বৈঠকে কমিশনাররা দাবি করেন, ঢাকা অচল করার কর্মসূচি দিতে হবে। তাঁরা সামরিক অভিযানও চান। সে সময় সাদেক হোসেন খোকা বলেন, পুলিশের যোগসাজশেই সন্ত্রাসীরা খুন করছে। আমিও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। আমার মনে আছে, খোকা বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসীরা খুন করছে আর পুলিশ ঘুমাচ্ছে।’ সেই বৈঠকে ওয়ার্ড কমিশনাররা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। পরিস্থিতি এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে সাদেক হোসেন খোকা অনেক অনুনয় করেও সবাইকে সামাল দিতে পারছিলেন না।

শুধু খোকা নন, বিএনপি সরকারও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিল না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট তখন ক্ষমতায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে। মানুষের মনে আতঙ্ক, উদ্বেগ, ক্ষোভ আর হতাশা।

বিএনপির আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ তাঁর বই ‘বাংলাদেশ: আ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস’-এ লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া পুলিশ বাহিনী পরিবর্তন করে বিএনপি তাদের অনুগতদের দিয়ে পূর্ণ করলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি।’ একই সঙ্গে বিএনপি সরকার মনে করেছিল, পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা পুলিশকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতে সারা দেশে অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। এই অভিযান শুরুর আগে পুলিশকে কিছুই জানানো হয়নি। সেনাসদস্যরা রাস্তায় নামার পরই পুলিশ জানতে পারে, এটাই ছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’।

তারপর? তার আর পর নেই। শুধু আছে চন্দ্রবিন্দুর গান, ‘…আর জানি না, জানি কী কেন কবে কোথায় কিসের প্রশ্নগুলো হাতে গোনা…।’ 

আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত