সাইপ্রাসে পরিচালিত ‘২২ বেট’ নামের একটি জুয়ার অ্যাপ দিয়ে দেশ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে দেশি-বিদেশি একটি চক্র। সেই টাকা হংকংয়ের তৈরি ডলার কনভার্টার অ্যাপ ‘পারফেক্ট মানি’ দিয়ে কয়েকটি দেশে পাচার করা হয়। চক্রটি প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৮ লাখ টাকা পাচার করে, এভাবে গত চার মাসে প্রায় কোটি টাকা পাচার হয়েছে। জুয়ার অ্যাপটি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশি এজেন্ট ছাড়াও নাইজেরিয়া ও মালির কিছু নাগরিক ঢাকায় আছেন। বাংলাদেশি এজেন্ট গ্রেপ্তার হলেও নাইজেরিয়ার নাগরিককে ধরতে পারেনি পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানায়, জুয়ার অ্যাপটি ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ৬৩টি দেশে চালু আছে। একই সময়ে বিশ্বের ৪ লাখ জুয়াড়ি নিজস্ব মুদ্রায় জুয়া খেলেন এই অ্যাপে। প্রতিটি দেশে গোপনে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটির এজেন্ট। সিটিটিসি ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বৈশ্বিক এই অ্যাপে বাংলাদেশি জুয়াড়িরা মোবাইল ও ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশি মুদ্রায় অংশ নেন। বাংলাদেশে প্রায় ৬০ হাজার লোক এতে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তাঁদের মধ্যে ২০-৩০ হাজার জুয়াড়ি নিয়মিত খেলেন। অ্যাপটির বাংলাদেশি এজেন্ট মো. সাব্বির আহমেদ সুজনকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের ইন্টারনেট রেফারেল টিম। তাঁর বিরুদ্ধে রমনা মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। সাব্বিরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়, থাকেন ঢাকার পল্লবীতে ভাড়া বাসায়।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাব্বির আহমেদ বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। চক্রের আরও কিছু ব্যক্তি নজরদারিতে আছেন। অ্যাপটি অ্যানড্রয়েড ও আইফোন উপযোগী। চক্রটি বাংলাদেশিদের জন্য বাংলা ভাষায় একটি ওয়েবসাইটও চালু করেছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেয়। বিভিন্ন অফার দিয়ে জুয়া খেলতে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে জুয়াড়িরা নিবন্ধন করেন। পরে বাংলাদেশি এজেন্টদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠিয়ে ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনে তা দিয়ে বেটিংয়ে অংশ নেন। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ক্রীড়া টুর্নামেন্ট ঘিরে অ্যাপটিতে জুয়াড়িরা বেশি তৎপর থাকেন।

সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের উপকমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে, মামলাটি তদন্তাধীন। নাগরিকদের এই ধরনের জুয়া খেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই জুয়ায় প্রথম প্রথম দু-একজন জিতলেও পরে কেউ জেতে না। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চক্র এটি। চক্রের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।

সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, অ্যাপটিকে ১ মার্চ থেকে নজরদারিতে রাখে সিটিটিসি। সাব্বির আহমেদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি এক বছর ধরে ২২ বেট জুয়ার সঙ্গে জড়িত। তিনি বাংলাদেশের এজেন্ট। জুয়ার অ্যাপটি ২০২১ সালের দিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন নাইজেরিয়া ও মালির কয়েকজন ব্যক্তি। নাইজেরীয় ফ্রেড নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়েন। জুয়াড়িরা সাব্বিরের বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় অ্যাপে টাকা পাঠান। বিনিময়ে তাঁরা ভার্চুয়াল মুদ্রা পান। জুয়াড়িদের পাঠানো টাকা সাব্বির আহমেদের ১০টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে জমা হতো।

সূত্রমতে, সাব্বিরের কাছে টাকা আসার পর নিজের কমিশন রেখে বাকি টাকা ‘পারফেক্ট মানি’ নামের ডলার কনভার্টার অ্যাপের মাধ্যমে বিদেশে এজেন্টদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এক সপ্তাহে ৮ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। মালি ও নাইজেরিয়া ছাড়াও বেশ কিছু দেশে গত চার মাসে প্রায় কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মানি ট্রান্সফার ও কনভার্টার অ্যাপ আছে। এগুলো চোরাকারবারি, জুয়াড়ি, মাদক কারবারি ও কালোটাকার মালিকেরা ব্যবহার করেন। এসব অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুলে এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থ নেওয়া যায়। পারফেক্ট মানি তেমনই একটি অ্যাপ। এটাতে অ্যাকাউন্ট খুলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাকা পাঠানো যায়। বাংলাদেশে অসংখ্য ব্যবহারকারী আছে। এদের আইনের আওতায় আনা উচিত।