গাবতলী থেকে সোয়ারীঘাট: ছিনতাইয়ের স্বর্গরাজ্য ১৩ কিলোমিটার সড়ক

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩, ১৭: ৩০
আপডেট : ১০ মে ২০২৩, ১৮: ৩৫

রাজধানীর গাবতলী থেকে সোয়ারীঘাট। মাত্র ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সড়ক। এই পথটুকু ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক ছিনতাইকারী চক্র। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়—পুরো সময়টা এ সড়ক থাকে ছিনতাইকারীদের দখলে। তারা বেড়িবাঁধ সড়ক ও সংলগ্ন থানা এলাকায় সারা বছর ছিনতাই করে। নির্বিঘ্নে ছিনতাই করতে নিজেরাই অকেজো করে রাখে সড়কবাতি। গত এক বছরে এই সড়ক ও সংলগ্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৮৮৮ ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যাদের সবারই বসবাস ও যাতায়াত ছিল বেড়িবাঁধকেন্দ্রিক। এতসংখ্যক ছিনতাইকারী গ্রেপ্তারের পরও ছিনতাই কমেনি।

অভিযোগ রয়েছে, ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা পান খুবই কম। ছিনতাইকারীরা দিনে বেড়িবাঁধঘেঁষা ঝুপড়ি বস্তিঘর, ট্যানারিপল্লি, অটোস্ট্যান্ড-লেগুনাস্ট্যান্ড-ট্রাকস্ট্যান্ড ও রায়েরবাজার কবরস্থান এলাকায় ঘাপটি মেরে থাকে। সেখানে বসে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা পার হয়ে কেরানীগঞ্জেও চলে যায়। 

গত ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমি পরিদর্শনে যান দুই জাপানি নাগরিক। তাঁরা সেখানে ছবি তোলেন এবং ঘুরে দেখেন। এ সময় একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাঁদের সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হোটেলে চলে যান ওই দুই জাপানি নাগরিক। পরদিন ২৫ এপ্রিল দুপুরে হোটেলের ম্যানেজার তারেক আহমেদ মোহাম্মদপুর থানায় ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান। বিদেশি দুই নাগরিকের বিষয়ে পুলিশ নড়েচড়ে বসে। ঢাকা, কক্সবাজার ও সীতাকুণ্ডে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় তাঁদের পাসপোর্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও ফোন।

বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশ দেওয়ার পর দ্রুত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করে থানা-পুলিশ। তবে ভুক্তভোগী সবার ভাগ্য এমন হয় না। দ্রুত কাজও করে না পুলিশ। গত ২৫ ডিসেম্বর বেড়িবাঁধ নবীনগর হাউজিংয়ের বাসা থেকে রিকশায় মোহাম্মদপুরের তিনরাস্তার দিকে যাচ্ছিলেন প্রকৌশলী খালিদ সাইফুল্লাহ। পথে বেড়িবাঁধের চাঁদ উদ্যানে ছিনতাইয়ের শিকার হন তিনি। ছিনতাইকারীরা দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে তাঁর স্মার্টফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তিনি মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তবে চার মাসেও তাঁর ফোন উদ্ধার হয়নি। 

আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাবতলী থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। বেড়িবাঁধকেন্দ্রিক এই ছিনতাইকারী চক্র দারুস সালাম, আদাবর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার, নিউমার্কেট, শেরেবাংলা নগর, কলাবাগান, তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় গিয়েও ছিনতাই করে।

র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন খান বলেন, ‘এটি রিমোট এলাকা, উন্নয়ন চলমান। অপরাধীরা অপরাধ করেই দ্রুত গা ঢাকা দিতে পারে। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে ছিনতাই করে থাকে। র‍্যাব প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে।’

গত এক বছরে বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে যেসব ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের কেউ ব্যাটারিচালিত অটোচালক, কেউ রাজমিস্ত্রির সহযোগী, কেউ বাসচালকের সহকারী, কেউ সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবার কেউ ট্রাক ও লেগুনার সহকারী। এদের বেশির ভাগ মাদকসেবী। তারা সুযোগ পেলেই ছিনতাই করে। গত চার মাসে বেড়িবাঁধসংলগ্ন এই এলাকা থেকে ২৫৬ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-২। র‍্যাব জানায়, ছিনতাইকারীরা রায়েরবাজার বিশাল কবরস্থানকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছে।

র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন খান বলেন, ‘এটি রিমোট এলাকা, উন্নয়ন চলমান। অপরাধীরা অপরাধ করেই দ্রুত গা ঢাকা দিতে পারে। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে ছিনতাই করে থাকে। র‍্যাব প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে।’

কেন এত ছিনতাইকারী বেড়িবাঁধে

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বেড়িবাঁধকে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ছিনতাই, হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায় এটি রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে একটি বলে জানিয়েছে ডিএমপি সদর দপ্তরের ক্রাইম বিভাগ। সদর দপ্তরের দাবি, গাবতলী থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের দুই পাশে অবৈধ দেড় শতাধিক লেগুনা, ট্রাক, বাস, অটোরিকশা ও রিকশাস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। কাগজপত্র ও ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি এই সড়কে চলাচল করে। এদের চালক ও হেলপার—সবাই এই বেড়িবাঁধসংলগ্ন বস্তিতে থাকেন। বেড়িবাঁধের বাইরে ও ভেতরে ছোট ছোট বস্তি গড়ে উঠেছে। সেখানে থাকা অপরাধীরাই এসব ছিনতাই করছে। এরা সুযোগ পেলেই ছিনতাই করে। বেড়িবাঁধ সড়কের বাতি ছিনতাইকারীরা নিজেরাই ভেঙে রাখে, যাতে অন্ধকারে ছিনতাই করা যায়।  

বেড়িবাঁধে ছিনতাইয়ের হট স্পট হিসেবে পরিচিত গাবতলী বালুরঘাট, স্লুইসগেট, ঢাকা উদ্যান, নবীনগর, চাঁদ উদ্যান, ভাঙা মসজিদ, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, ট্যানারি মোড়, সেকশন, কামরাঙ্গীরচর ২ নম্বর ব্রিজ ও সোয়ারীঘাট। এসব এলাকায় র‍্যাব-পুলিশ টহলে থাকলেও ছিনতাই কমছে না।  

গত চার মাসে এই বেড়িবাঁধ ও এর আশপাশের এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৯টি থানায় ১৮৪টি মামলা করেছে র‍্যাব-২। সবচেয়ে বেশি ১০৯টি ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। এরপর হাজারীবাগে ২৪টি এবং আদাবরে ২১টি। এ ছাড়া ধানমন্ডিতে পাঁচটি, নিউমার্কেটে সাতটি, শেরেবাংলা নগরে নয়টি, কলাবাগানে পাঁচটি, তেজগাঁও থানায় দুটি এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দুটি মামলা হয়। তবে বেশির ভাগ ভুক্তভোগী মামলা করেন না। কারণ, অনেকেই যাত্রাপথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। তাঁরা আর থানায় যান না। কেউ কেউ ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মোবাইল ফোন হারানোর জিডি করেন।

ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হওয়া থানাগুলোর পাঁচটিই ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মধ্যে রয়েছে। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার আজিমুল হক ছিনতাইয়ের বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেলেই আমরা অভিযান পরিচালনা করি। বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত